আমার কাজিন আর আমি পিঠাপিঠি। ছোটবেলায় আমাদের সম্পর্ক ছিলো দা-কুমড়োর মতো।
সারাক্ষণ আমাদের ঝগড়া লেগেই থাকতো। ঝগড়া করতে করতে একজন আরেক জনের কাপড় খুলে ফেলতাম। আর ভাইয়া এসে আমাদের থামাতেন আর বলতেন তোদের ঝগড়ার কাছে তো দুই সতীনের ঝগড়াও ফেইল মারবে। আমাদের যাতে ঝগড়া না লাগে তার জন্য রাতে ঘুমানোর সময় ভাইয়া মাঝখানে শুয়ে আমাদের দুইজন কে দুই পাশে রাখতেন। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হতো না। ভাইয়ার উপর দিয়েই মারামারি করে ভাইয়ার বারোটা বাজিয়ে দিতাম।
কিন্তু ধীরেধীরে আমরা যতো বড় হচ্ছিলাম আর আমাদের সম্পর্কও ততো ভালো হচ্ছিলো।
এস,এস,সি পরীক্ষার পর ও আমাকে ফোন করে ওদের বাসায় যেতে বলে। আমিও বলা মাত্রই চলে যাই সেখানে।
যাওয়ার পর ওকে যতোই দেখছিলাম ততোই অবাক হচ্ছিলাম।একটা মানুষের এত্ত পরিবর্তন!
ও তখন এইচ,এস,সি পরীক্ষার্থী ছিলো। নিয়ম করে ওকে ক্লাস করতে হতো। প্রতিদিন ক্লাস করে বাসায় আসার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতো।একেক রাতে একেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতো। কিছুদিনের মধ্যেই একে একে ওর পছন্দের সমস্ত জায়গায় সেই সাথে সমস্ত পছন্দের খাবার খাওয়া শেষ করে ফেলেছিলাম।
ওদের বাসায় থাকা অবস্থায় আমার জন্মদিন চলে আসে, সেদিন ও কলেজ থেকে বাসায় এসে আমাকে একটা প্যাকেট দেয় খুলে দেখি আমার পছন্দের লেখকের বই।প্রথম পেজ উল্টাতেই অবাক! সেখানে লিখা তোর জন্মদিনে আমার এই ছোট্ট উপহার... শুভ জন্মদিন মুখে বলতে পারব না বলে লিখে দিলাম। সত্যি সেদিন মনের অজান্তেই কেঁদেছিলাম। চুপ থেকেছিলাম কিছুই বলতে পারিনি। রেজাল্টের সময় ঘনিয়ে আসাতে আমাকে বাসায় চলে আসতে হয়।
যেদিন আমি চলে আসবো সেদিন সকালে ও আমাকে কিছু না বলেই কলেজে চলে গিয়েছিলো।আমি ঘুম থেকে উঠে ওকে পাইনি।মামী বললেন তুই চলে যাবি বলে ও তোর ঘুম ভাঙ্গায় নি।আমিও চলে এলাম এর পর থেকেই ওর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। বাসায় আসলেই সবটা সময় ওর জন্য। যেখানে মন চাইবে নিয়ে যাবে। একটু পর পর জোকস বলে হাসাবে। সারাদিন বাইরে রেখে রাতে ক্লান্ত করে ঘরে ফেরাবে।
ও যখন বরিশাল মেডিকেলে পড়তো সেই সময় বাসায় আসলেই চলে যাবার সময় আমাকে সদরঘাট পর্যন্ত সাথে করে নিয়ে যেতো।আমি সাথে গিয়ে ওকে লঞ্চে তুলে দিয়ে আসতাম। লঞ্চ ছেড়ে যেতো আমি লঞ্চ ঘাটে দাঁড়িয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখতাম। ও কেভিন রেখে লঞ্চের ছাদে এসে রিলিং ধরে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। যে পর্যন্ত একজন আরেকজন কে দেখতে পেতাম সে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতাম।
আমার কর্মস্থল ওদের বাসা থেকে কাছে হওয়ায় গত এক বছর ধরে আমি ওদের বাসায় থাকছি।এবার জন্মদিনেও আমি ওদের বাসাতেই ছিলাম। ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখ আমার জন্মদিন। ফেব্রুয়ারীর ১৩ তারিখ অফিস করে বাসায় ফিরে দেখি বাসায় বিশাল আয়োজন! কাজিন কে জিজ্ঞেস করলাম কিরে রাত্রিবেলায় এমন আয়োজন? ও বললো ওর কয়েকজ বন্ধু আসবে। জিজ্ঞেস করলাম বাসা ফাকা ভাবিরা কোথায় গিয়েছে? বললো বাইরে কেনাকাটা করতে গেছে। তারপর ও নিজে থেকেই বললো, বাসায় তো কেউ নেই তুই একটু ফ্রেশ হয়ে খাবার গুলো সাজাতে হেল্প কর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্ধুরা চলে আসবে। আমিও ফ্রেশ হয়ে ওকে হেল্প করলাম। বাইরে থেকে ভাবিরা আসলো। এসে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রাত বাজে ১০ টা তখনও ওর বন্ধুরা আসেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কিরে তোর বুন্ধুরা কি মাঝরাতে আসবে? ও বললো কথা হইছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
আমি ভাবি ড্রয়িংরুমে বসে আছি। ভাবি এটা সেটা প্রশ্ন করছে আমিও টুকটাক উত্তর দিচ্ছি। আমার কাজিন তখন ডাইনিং এ কাজ করছে। আমি ওদিকে যেতে চাইলে ভাবি বললো বসেন ওদিকে যেতে হবেনা। ও একাই করতে পারবে সব। আমিও বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর কাজিন ডাকলো আয় আমার বন্ধুরা চলে আসছে। আমি ডাইনিং এ গিয়ে জাস্ট অবাক! এত্তগুলো মোম সহ মস্তবড় একটা কে জ্বলজ্বল করছে। কেকের উপর সেই বিচ্ছিরি নাম যে নামে ও আমাকে ডাকে। আশেপাশে বেলুনের ছড়াছড়ি। ও শ্বাস নিতে পারছেনা এত্তগুলো বেলুন ফুলিয়ে ফোস ফোস করে শ্বাস নিচ্ছে। এতোক্ষণে সব পরিষ্কার আমার সামনে। ১৫ফেব্রুয়ারী ওর একটা প্রোগ্রাম থাকার কারণে বাসায় থাকতে পারবেনা বলেই ১৩ তারিখ আমার জন্মদিনের আয়োজন করেছে।জীবনে ও আমার জন্য অনেক কিছু করেছে,এখনো করছে। কিন্তু আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি শুধু ওর বাসরটা সাজিয়ে দেয়া ছাড়া। অবশ্য ওর ইচ্ছে ছিলো ওর বাসর আমার হাতেই হবে। তাই সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যেও ওর বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলাম।
যা বলছিলাম আজ ও বাসায় এসেছে। বাসার সবাই ব্যস্ত থাকায় আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে বললো।
আমি কিচেনে গিয়ে দেখি চা করা নেই। সবাই ব্যস্ত থাকায় ভাবলাম আমি নিজেই চা টা বানিয়ে দেই। তো যেই ভাবা সেই কাজ। চা বানিয়ে এনে ওকে দিলাম চা তে চুমুক দিয়েই জিজ্ঞেস করলো চা কে বানিয়েছে? বললাম আমি ও মাথা দুলিয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে চা খাচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম কেমন হয়েছে? ও বললো খুব ভালো বানিয়েছিস এটা বলেই আবার চা খাওয়ায় মন দিলো।ওর এতো তৃপ্তি নিয়ে চা খাওয়া দেখে আমারও এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছিলো।
তো আবার কিচেনে গেলাম চা আনতে।কাপে চা ঢেলে যেইনা মুখে দিয়েছি ওমনি চা মুখে লাত্থি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
চাতে এত লিকার হয়েছে যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না।এই হচ্ছে আমার রান্নার হাত। ও কেমন করে এই চা এত্ত তৃপ্তি নিয়ে খেলো?একটু মুখ বাকাও করলোনা! ওকে কিছু একটা বলার জন্য রুমে গেলাম। রুমে ঢোকার সাথে সাথেই ওর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা কিরে আরো এক কাপ চা দে।আমি কিছুই বলতে পারলামনা শুধু বোকার মতো চেয়ে রইলাম।এর মধ্যেই মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো প্লিজ তোর এত্ত ভালো চা খাওয়ার দরকার নাই, চল দুজনে বাইরে গিয়ে খারাপ চা খেয়ে আসি।এটা বলেই দুজনে হো হো করে হেসে উঠলাম।
বাসার সবাই আমাদের সুসম্পর্ক দেখে অবাক হয় ,পাশাপাশি আমদের ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কেমন মারপিটে টাইপের ছিলাম।আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু মহল সবাই ওকে আমার প্রিয় শুত্রু নামে চিনে। আমি ওকে আমার প্রিয় শত্রু বলেই সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেই।আমি চাই বাকি জীবন ও আমার প্রিয় শত্রু হয়েই থাক। এই পৃথিবীতে এমন একটা প্রিয় শত্রু থাকা খুব দরকার যার সাথে সমস্ত ভুল ভাগ করে নেয়া যায়, যার কাছে চোখ বন্ধ করে জমা রাখা যায় বিশ্বাসের সমস্ত দলিল।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৫:১৯