আমার দাদী যখন আমাদের বাড়ির বউ হয়ে আসেন তখন তিনি নাবালিকা ছিলেন। আমার দাদীদের খান্দানী বংশ ছিলো, সেই সাথে সামাজিক মর্যাদা আর প্রতিপত্তিও ছিলো ঢের। লোকমুখে শোনা, অনুমতি ব্যতীত মানুষ তো দূরের কথা কাকপক্ষীও তাদের বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যেতে দুইবার চিন্তা করতো। সেইসময় যেহেতু বিয়ে সহ অন্যান্য বিষয়ে বংশমর্যাদার আলাদা একটা প্রভাব ছিলো সমাজে তাই আমার দাদার নানা তার নাতীর জন্য এমন বাড়ির মেয়েই খুঁজছিলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয় আর কি! তিনি বংশও পেয়েছিলেন সাথে পরীর মতো নাতবোউ।
দাদীর মুখে শোনা, আমাদের বাড়ি থেকে দাদী কে প্রথম যেদিন দেখতে যায় সেদিন তিনি তার খেলার সাথীদের সাথে তাদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা খালের পানিতে আদুল গায়ে ঝাঁপাঝাপি করছিলেন। হঠাৎ দাদী খেয়াল করলেন তার দাদা একটা বাঁশের কঞ্চী হাতে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছেন। দাদী মারের ভয়ে দ্রুত পানি থেকে উঠে খালের পাড়ে খুলে রাখা জামা নিয়ে দৌড়ে বাসায় ঢুকলেন।
দাদী ওই অবস্থায় বাসায় ঢুকেই পড়লেন তার নানা শ্বশুরের চোখের সামনে। মানে আমার দাদার নানার সামনে। যিনি তার একমাত্র নাতীর জন্য পরীর মতো নাতবউ খুঁজতে গিয়ে আমার দাদীর দেখা পেয়েছিলেন।বয়সকালে দাদী আগুনের মতো সুন্দরী ছিলেন যা তার বর্তমান সৌন্দর্য দেখেই অনুমান করতে পারবে যে কেউ। এই বয়সেও তিনি আহামরি সুন্দরী, দুধে আলতা গায়ের রঙ, তীরের মতো নাক, মায়াবী চোখ আর মাথাভর্তি চুল। চামড়ায় বয়সের ভাঁজ পড়লেও সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়নি। আমরা নাতী, নাতনীরা তাকে মাঝেমধ্যেই বলতাম, তুমি দেখতে এতো সুন্দরী কিন্তু দাদার মতো কালো মানুষ কে কেনো বিয়ে করলে? দাদী তখন হেসে উত্তর দিত, মাগি-মর্দারা আমগো কালে পছন্দ করে বিয়া করার সুযোগ আছিলোনা। বাড়ি থিকা যার কাছে বিয়া দিতো তার কাছেই বিয়া বইয়া জীবন পাড় হইয়া যাইতো। এগুলাই ছিলো ভালো বংশের মাইয়াদের ভালো গুণ। এই যুগের মাগিদের মতন বারো ভাতার ধরার সুযোগ আর ইচ্ছাও আছিলো না আমাগো। আমরা এসব শুনতাম আর হেসে গড়াগড়ি খেতাম।
তো যা বলছিলাম, ওই অবস্থায় দেখেই দাদার নানা তার নাতবউ কে পছন্দ করে ফেলেন। সেইদিনই বিয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক করে দাদী কে আশীর্বাদ করে আসেন। এর কিছুদিন পরেই দাদী আমাদের বাড়ির বউ হয়ে আসেন। যে মেয়ে আদুল গায়ে খালের পানিতে নেমে ঝাঁপাঝাপি করে সেই মেয়ের আর যাইহোক স্বামী সংসার বোঝার কথা না। হলোও তাই। তিনি আমাদের বাসায় এসে স্বামী সংসার শিকেয়তুলে রান্নাবাটি আর পুতুল খেলায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমার দাদার মা মানে আমার দাদীর শাশুড়ি মাটির মানুষ ছিলেন। যার গল্প এর আগে আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি। তিনি আমার দাদীর এসব ছেলেমানুষীকে প্রশ্রয় দিতেন সবসময়। দাদীদের বাড়ির সামনে দিয়ে যে খাল বয়ে গেছে সেই খালের উজানে আমাদের বাড়ি। মাঝেমধ্যেই দাদীর খেলার সাথীরা সেই খালে সাঁতার কাটতে কাটতে দাদীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। দাদীও কাউকে কিছু না বলে তাদের সাথে সাঁতার কাটতে কাটতে নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠতেন। দাদীর এবং আমাদের বাড়ি এ পাড়া ও পাড়া হওয়ায় সাঁতরে আসা যাওয়া করা সহজ ছিলো। যখন তিনি সাঁতরে গিয়ে তাদের বাড়ি উঠতেন তখন তার দাদার একটা পরিচিত কথা তিনি সবসময় শুনতেন। কথাটি এরকম ছিলো, হায়! হায়! এই মাইয়া আমার মানসম্মান শ্যাষ কইরা ফালাইবো। নিশ্চয়ই কাউরে না জানাইয়া সাঁতরাইয়া আইয়া পড়ছে! এরপর দাদীকে তার দাদা যত্ন করে খাবার খাইয়ে বুঝিয়ে আমাদের বাসায় দিয়ে যেতেন।
দাদী দাদাকে ভীষণ ভয় পেতেন। সেই বিয়ের রাত থেকে সাবালিকা হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তার শাশুড়ির সাথে এক বিছানায় ঘুমাতেন। দাদা যখন বাসায় থাকতেন না উনি তখন রান্নাবাটি আর পুতুল খেলায় ব্যস্ত থাকতেন। যখনই দাদার শব্দ কানে আসতো তখনই তিনি দৌড়ে গিয়ে আমাদের বাড়ির শস্য রাখার মাচাতে থাকা বড় বড় মাটির কোলার ভেতরে গিয়ে লুকাতেন। দাদা চলে যাবার পর তার শাশুড়ি তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতেন। এভাবে লুকোচুরি করতে করতে দাদা এবং দাদীর মধ্যে ভালোবাসারা দানা বাঁধতে শুরু করে। আর সেই ভালোবাসার ফসল হিসেবে প্রথম তাদের কোল জুড়ে আমার বাবার আগমন ঘটে। এভাবে একে একে তারা দশ জন সন্তানের জনক জননী হয়। কিভাবে তারা দশ সন্তানের জনক জননী হয়েছিলেন সে গল্প অন্য একদিন শেয়ার করব আপনাদের সাথে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি আসাম হওয়ায় দাদা কে জমির দেখাশোনা আর ফসল উৎপাদনের জন্য বছরের অনেকটা সময় আসাম থাকতে হতো। এরকম হয়েছে আমাদের কোনো কাকা বা ফুপু দাদীর পেটে অথচ দাদা সেই সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। উনি আসাম গিয়ে পড়ে আছেন তো আছেন। যখন তিনি কাজকর্ম শেষ করে নৌকা ভরে ফসল নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তখন দেখতেন তাদের ঘরে নতুন আরও একটি ভালোবাসার ফসলের আগমন ঘটেছে। এরকম করে দাদা যে দাদী কে ফেলে এতোদিন করে আসাম গিয়ে পড়ে থাকতেন অথচ দাদীর এ নিয়ে অভিযোগ ছিলো শূন্যের কোঠায়। অথচ আমাদের এই সময়ের মানুষের সংসারে পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয়ে যায় লঙ্কা-কান্ড।
দাদীর দাদাকে নিয়ে অভিযোগ শূন্যের কোঠায় থাকলেও তিনি বেশ অভিমানী ছিলেন এবং যখন তিনি অভিমান করতেন তখন বেশ আয়োজন করেই অভিমান করতেন। অভিমান প্রকাশ করার চিহ্ন হিসেবে তিনি বাপের বাড়ি গিয়ে পাড়ি জমাতেন। ভাইয়েরা বোনের মুখ দেখেই টের পেয়ে যেতেন বোনের অভিমানের খবর। তারা তখন দলবেঁধে আমাদের বাসায় এসে আমার দাদাকে কোলে তুলে তাদের বাসায় নিয়ে বোন-দুলাভাইয়ের অভিমান ভাঙ্গাতেন। শেষের দিকে দাদী একটু বেশীই অভিমানী হয়ে গিয়েছিলেন। একটু কিছু হলেই দাদার সঙ্গে কথা না বলে, নাওয়া খাওয়া ভুলে আলাদা বিছানায় গিয়ে ঘুমাতেন। দাদাকে দেখতাম একদিন, দুইদিন,তিনদিন দাদীর পিছনে ঘুরে ঘুরে দাদীর অভিমান ভাঙ্গাতেন। দাদা দাদী কে চোখে হারাতেন আর দাদীও দাদার জন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারতেন না। আমরা মজা করে বলতাম দাদা মারা যাবার পর তুমি এদিক সেদিক ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়িয়ো। দাদী এসব শুনে আমাদের দিকে তেড়ে আসতেন।
দাদা মারা গেছেন দুইবছর হতে চলেছে, দাদী এখনো দাদার বিছানাপত্র জড়িয়েই বসে থাকেন। কোথাও গিয়ে থাকতে পারেন না। আমরা বলি তুমি দাদার জন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারেতে না, এখন তো দাদা নেই, ফুপুরা নিয়ে রাখতে চায় গিয়ে থেকে তো মন ভালো করে আসতে পারো। তার উত্তর একটাই এই ঘর ছেড়ে গেলে নাকি তার ভেতর হু হু করে। এই হচ্ছে ভালোবাসা! এতো বয়সের পার্থক্য ছিলো দুজনের মধ্যে, চেহারার দিক দিয়ে দাদা কখনোই দাদীর যোগ্য ছিলেন না,এই যে দাদী কে রেখে দাদা দীর্ঘদিন করে আসাম গিয়ে পড়ে থাকতেন তবুও দাদী দাদাকেই ভালোবাসতেন। আর আমাদের সময়ের মানুষের মধ্যে এতো এতো অভিযোগ, এতো হতাশা, এতো না পাওয়া। অধিকাংশ পরিবারের মধ্যেই বৈবাহিক কলহ লেগেই থাকে। মা-বাবার এমন আচরণ দেখে সন্তানেরা বিপথে চলে যায়। চারদিকে এতো এতো বিবাহবিচ্ছেদ যা অকল্পনীয়। আমাদের এই সময়ের সমাজে এমন ঘটনা অগণিত যে পাঁচ থেকে ছয় বছর একটা সম্পর্কে থেকে, একজন আরেকজন কে জেনেশুনে বিয়ে করার পর বছর না ঘুরতে ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠেছে। আমার বাসার আশেপাশে তাকালে আমি শুধু ডিভোর্সি দেখি এমনকি যাদের চোখের সামনে বড় হতে দেখেছি তাদেরও কয়েকদফা বিয়ে হয়েগেছে কিন্তু সংসার টিকেনি! অথচ আমাদের দাদা-দাদীরা তাদের দাদা-দাদীরা একজন আরেকজন কে না দেখেই পরিবারের নেয়া বিয়ের মতো এতো বড় একটা সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে যেতেন এবং সারাটা জীবন ভালোবেসে একজন আরেকজন কে লতার মতো পেঁচিয়ে থাকতেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ আমরা স্বাধীন হতে হতে কখন যে নিজেদের পরাধীন করে ফেলেছি, কখন যে জীবনের সঠিক মানে থেকে ছিটকে পড়েছি-পড়ছি তা টের ই পাচ্ছিনা!
সংসার বলতে আমি আমার দাদা-দাদী কে দেখে যা শিখেছি তা হলো মানিয়ে নেয়া, মেনে নেয়া। সংসার করতে গেলে বাঁধাবিপত্তি আসবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রতিটা মানুষের স্বভাব আর চিন্তাভাবনা এক না। আমি যে ভাবে চিন্তা করছি বা ভালোবাসা প্রকাশ করছি অন্য জনের কাছে এর ভিন্ন সংজ্ঞা থাকতেই পারে এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা যখন মেনে নিতে আর মানিয়ে নিতে পারব তখন আমাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সেই সাথে ভালোবাসারাও বেঁচে থাকবে। ভালোবাসা গুলোর আসলে মৃত্যু হয় না, আমারা নিজেরাই এগুলোকে গলা টিপে হত্যা করি। পারিবারিক কলহ, পারিবারিক ভাঙ্গন আসলে কোনো সমস্যার সমাধান নয় বরং বড় সমস্যার সূত্রপাত। মানিয়ে নেয়া আর মেনে নেয়া বলতে আমি অবশ্যই অন্যায় কে মেনে নেবার কথা বলিনি। যদি কেউ প্রতিবাদযোগ্য কোনো অন্যায় করে তবে তার প্রতিবাদ করেই সমাধান বের করতে হবে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, ছোট ছোট অন্যায়ের জন্য যেনো বড় প্রতিবাদ করে জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে না ফেলি। দিনশেষে আমরা কেবল আমাদের জন্যই বাঁচি না বরং তাদের জন্যও বাঁচি যারা আমাদের ভালো দেখার তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকেন।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:৫২