
বাতাসে রমাদানের মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, জানান দিয়ে যাচ্ছে তার আগমনী বার্তা। আরবি মাসসমূহের নবম মাস হচ্ছে পবিত্র রমাদান মাস। রোজা হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম, বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। পরিভাষায় সওম হলো আল্লাহর সন্তুটি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার থেকে বিরত থাকা।
ছেলেবেলায় শবে বরাতের পর থেকেই আমরা রমাদান কে স্বাগত জানাবার জন্য আঙ্গুলের গিট গুণে দিন ফুরানোর হিসেবে লেগে যেতাম। তখন রমাদান মানেই ছিল হেসে-খেলে বেড়ানোর দিন, রমাদানের রাত মানেই ছিল পড়াশোনা বিহীন। সেই সময় নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের দিকে রোজা শুরু হবার কারণে পড়াশোনার খুব একটা চাপ থাকত না। রমাদানের আগেই আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত, ফলে আমরা পুরো রমাদান সহ একেবারে ঈদের ছুটি পেয়ে যেতাম স্কুল থেকে। সেইসময় টা ঈদের টানটান উত্তেজনা নিয়ে পুরো রমাদান আমরা পড়ালেখা কে শিকেয় তুলে কাটিয়ে দিতাম। অবশ্য এই নির্ভাবনায় থাকার মূল কারণ ছিলেন আমার আব্বা। আমার আব্বা নরমালি ভয়াভহ রকমের রাগি মানুষ ছিলেন। তার বিকট চিৎকারে চিল-কাক উড়ে যেত অন্য পাড়ায়। আমরা সবসয় তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম। উনি আমাদের লেখাপড়ার বিষয়ে এতো কড়া ছিলেন যে সপ্তাহে একদিনও আমরা টেলিভিশন দেখার অনুমতি পেতাম না। কিন্তু এই মানুষ টা রমাদান এলেই ভোরের নদীর মতো একেবারে শান্ত হয়ে যেতেন, নিচু গলায় কথা বলতেন। রমাদানের যে শান্তি আছে তা প্রথম আমরা তার মধেই আবিষ্কার করেছিলাম।
ভোর রাতে মসজিদে রান্নার জন্য সাইরেন দেবার সাথে সাথেই আমরা বাচ্চা-কাচ্চারা মা-চাচীদের সাথে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতাম। তারপর ব্রাশ করতে করতে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম এবং আমাদের সমবয়সীদের ডেকে তুলতাম। বিশেষ করে আমি, আমার ফুপু আর আমার ছোটভাই একসাথে এই কাজ গুলো করতাম। এই ফুপু সেই ফুপু যার কথা এর আগেও আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি। আসলে ফুপু আমার ছেলেবেলার সাথে এভাবে মিশে আছে যে তাকে বাদ দিয়ে আমার ছেলেবেলার কোনো স্মৃতিই আমি চারণ করতে পারিনা। তো যা বলছিলাম, এ বাড়ি ও বাড়ি সবাইকে জ্বালাতন করে এসে আমরা সাহরি শেষ করে আবার মর্নিং ওয়াকে বের হতাম। শীতের সময় রোজা হবার কারণে ভোর বেলায় চারদিকে ঘন কুয়াশা পড়ে একেবারে সাদা হয়ে থাকত, এতোটাই ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ে থাকত যে কয়েক হাত দূরে কিছুই দেখা যেত না। আমরা সেই কুয়াশার বুক চিরে লুকোচুরি খেলতাম।নিজেদের কে তখন হ্যারি পটার মনে হতো। খুব সহজেই আমরা একটু জায়গার মধ্যেই নিজেদের কে মিলিয়ে দিতে পারতাম যাদুর ধোঁয়ার মতো দেখতে কুয়াশার মধ্যে।
চারদিকে আলো ফুটে উঠলে আমরা বাড়ি ফিরে এসে হিসেবে বসে যেতাম ইফতারের সময় নিয়ে। অবশ্য ইফতারের আগেই কতকিছু যে মনের ভুলে পেটে চলে যেত তার হিসেব নেই। অবশ্য সবসময় যে মনের বেখেয়ালে এটা সেটা খেয়ে ফেলতাম তা কিন্তু না। কখনো কখনো সারাদিন যা যা খেতে ইচ্ছে করত যেমন গাবের বিচি, তালের আঁটি, বরই, ছোলা সেদ্ধ,পেঁয়াজু, খেজুর, বেগুনী এসবকিছু নির্দিষ্ট একটা জায়গায় রেখে দিতাম এবং ইফতারের পর সেগুলো বের করে গরুর মতো জাবর কাটতে থাকতাম। এইসব অনুভূতি আসলে লিখে প্রকাশ করার মতো না। যোহরের সালাত ও মক্তব পড়ে আমরা রান্নাঘর আর আর খাবারের টেবিলের পাশে ঘুরে ঘুরে রান্নার ঘ্রাণ নিতাম। আমি রান্নার ঘ্রাণ নিয়ে তুষ্ট থাকলেও আমর ছোট ভাই শুধু ঘ্রাণে তুষ্ট থাকত না। সে টেবিলে থাকা প্রতিটি খাবার বাটির ঢাকনা খুলে টপাটপ এটা সেটা মুখে পুরে নিত, এমন ভাবে মুখে দিত যাতে কেউ দেখতে না পায়। সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে বিকেলের দিকে ফুপু, আমি আর আমার ভাই আমাদের স্থানীয় বাজারে যেতাম ইফাতারের দোকান ঘুরে দেখার জন্য। আশেপাশে সাজিয়ে রাখা বাহারি ইফতারের রঙ ও ঘ্রণ জিভে জল এনে দিত। ঢোক গিলতে গিলতে বাসায় এসে আমারা সবার সাথে ইফতারে বসে যেতাম। যথা সময়ে ইফতার শেষ করে সবার মাগরীবের নামায শেষ হয়ে, রেডিওতে নাতে রাসূল শেষ হয়ে দুর্বার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যেত এরপরও আমরা এটা সেটা খেতেই থকতাম।
গলা পর্যন্ত ইফতার খেয়ে আমি আর আমার ছোট ভাই ঢুলতে ঢুলতে মসজিদে তারাবি পড়তে যেতাম। আসলে ঠিক তারাবি পড়তে না , পাড়ার ছেলেপুলেরা একত্র হয়ে বদমাশি করতে যেতাম। মসজিদে মুরুব্বিরা প্রথম দিকে দাঁড়াতেন আর আমরা বাচ্চারা একেবারে পেছনের দিকে। নামাযের মধ্যে ঈমাম যখন তেলাওয়াত করা শুরু করতেন, আমরা তখন পিছনের লাইট অফ করে মেতে উঠতাম চড়, লাথি, কিল-ঘুষি আর লাফালাফির আনন্দে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের যখন বকা দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হত তখন আমরা আমাদের স্থানীয় স্কুল মাঠে গিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা দিতাম আর গলা ছেড়ে নিজেদের তাৎক্ষণিক সুর করা ও বানানো গান গাইতাম। কি ভাষায় যে গাইতাম তা নিজেরাও জানতাম না।
এই একই রুটিনে ধীরে ধীরে রমাদান শেষ হয়ে যেত সেই সাথে শেষ হয়ে যেত আমাদের আনন্দের দিন। আসলে সারাবছর আমরা এতো কড়া শাসনের মধ্যে থকতাম যে, সপ্তানে একদিন টেলিভিশন দেখা তো দূরে থাক খেলাধুলার সময়ও পেতাম না। ভোরভেলা উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে মক্তবে যেতাম, তারপর কোচিং, স্কুল, প্রাইভেট, হোম-ওয়ার্ক এসবের মধ্যে সকাল থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সময় ব্যয় হয়ে যেত। রমাদান না থকলে হয়ত আমরা জানতেও পারতাম না যে, কুয়াশা জড়ানো ভোর কত সুন্দর হয়, কত সুন্দর হয় বিকেলের রক্তিম আকাশ, কত সুন্দর হয় খোলা মাঠের চাঁদনী রাত।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৩:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



