প্রকৃতিতে শীত শীত গন্ধ অনুভূত হচ্ছে, বাতাসে টের পাচ্ছি মৃদুমন্দ হিমেল পরশ। ভোরবেলা বারন্দায় দাঁড়ালে; সাদা চাদর টেনে দৃষ্টিতে বাধ সাধছে কুয়াশা, ছাদের গাছগুলোর গা ধুয়ে দিচ্ছে শিশির। প্রকৃতিতে মিষ্টি সোনারাঙা রোদ আঁকিবুঁকি করছে; গ্রীষ্মের কাঠফাটা দাবদাহ নেই, নেই বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজে যাওয়াও। এ যেনো শীতের আগমনী বার্তা। শীত এসব আভাসের মাধ্যমে প্রকৃতির কানে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে, আমি এসছি গো তোমার উঠনে; লও হে মোরে বরণ করে।
শীতের আগমনে ধরায় বিষণ্ন সুন্দরের একটি রূপ দৃশ্যমান হয়; মনে হয় প্রকৃতির ডানায় বিষণ্নতা ভর করেছে। বেলা বাড়তে না বাড়তেই কেমন ছায়াপড়ে রাত নেমে আসে ধরণীতে, নেমে আসে সুনসান নীরবতা— শুরু হয় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাকীর উড়াউড়ি। কেনো জানিনা এই বিষণ্ন প্রকৃতির সাথে, আমিও এই সময় বিষণ্নতার সমুদ্রে তলিয়ে যাই। ন্যাফথালিন দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখা নতুন কাপড়ের মতো, যত্ন করে ঢেকে রাখা স্মৃতিরা— দিকভ্রান্ত প্রজাপতির মতো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। হাঁসফাঁশ করতে থাকে পাঁজরের ভেতর থাকা হৃতপিন্ড। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বিষণ্নতার ব্যথা— আমি আগলাতেও পারিনা, ফেলতেও পারিনা। স্মৃতির সাম্পান এসে বিষাদের ঘাটে নোঙর ফেলে, শুরু হয় পাওয়া না পাওয়ার হিসেব-নিকেশ। মনে হয়, জগতে যেনো কিছুই নেই; কোনোদিন আমার জন্য কিছুই ছিল না— বিরান ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ এক হিজল গাছ আমি।
সেদিন সন্ধ্যার মুখে, আকাশ দেখার উদ্দেশ্যে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছি— এ সময়ের আকাশ সাজে নানা রূপে; কখনো নীলাভ সাদা, কখনোবা গায়ে মাখে গোধূলীর নানা রঙ। আকাশে এলোমেলো ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। আমি ছাদের রেলিং এ দু-হাতে ভর করে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে আছি— নীলের বুকে কিছু উদাসী মেঘ পশ্চিম থেকে পূবে ভেসে যাচ্ছে। আমি অপলক তাকিয়ে থেকে নীল-সাদার খেলা দেখছি। যখন আমার বিষণ্নতার বিষে দমবন্ধ লাগে, তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এ আমার অনেক পুরানো অভ্যাস।
পলকহীন আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েই আছি; পশ্চিমের রক্তিম আভা চোখে-মুখে এসে পড়ছে, মৃদু ঠান্ডা বাতাসে ছাদের গাছগুলোর পাতা নড়ার শব্দ টের পাচ্ছি— হঠাৎ কোনো এক পাখির ডাকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, ছাদের কার্নিশে গুটিসুটি হয়ে বসে দোয়েল ডাকছে; কিন্তু এ কেমন স্বর! এমন ভাঙ্গা গলায় তো দোয়াল শীষ দেয় না! ভাবলাম দোয়েলকেও বুঝি প্রকৃতির বিষণ্নতা ছুঁয়ে দিয়েছে, তাই সে একা ছাদের কার্নিশে বসে— বিষাদী সুরে ডাকছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার বিষাদী সুরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু কি মনে করে সে আমার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক ডেকে, ফুড়ুৎ করে উড়াল দিয়ে অট্টালিকার ভীড়ে মিলিয়ে গেল।
চারদিকে অন্ধকার নেমেছে, অট্টালিকার কোটরে কোটরে জ্বলে উঠছে সাঁঝবাতি। অনুভব করলাম অন্ধকার হবার সাথে সাথে বাতাসে শীতলতাও কিছুটা বেড়েছে। ছাদ থেকে নেমে কড়া লিকারে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছি; বাসার পাশে অযত্নে বেড়ে উঠা ছাতিম ফুলের গন্ধে মাতাল মাতাল লাগছে। ডুবে যাচ্ছি গন্ধের মাদকতায়। ছাতিম গাছের তলায় নয়-দশ বছরের এক ছেলে, গোটা কয়েক উনুন জালিয়ে— ভাপা, চিতই আর তেলের পিঠার পসরা সাজিয়ে বসেছে। শীত এলেই এই মানুষগুলো বাড়তি আয়ের একটা রাস্তা খুঁজে পায়। কয়েকদিন আগে সমকর্মীর সাথে পিঠা খেতে গিয়েছিলাম ছাতিম তলায়, পিঠা খাচ্ছিলাম আর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম— ওর বয়সি আমার বাসার বাচ্চাদের এখনো মুখে তুলে না খাইয়ে দিলে তারা হাতে তুলে খেতে পারেনা; আর এই বাচ্চা এক হাতে চার চারটি উনুন সামলে নিচ্ছে! এদের কোনো বিষণ্নতা নেই, নেই জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগও, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবও এরা কষতে জানেনা— দিনশেষে আধপেটা খেয়ে পড়েই, বেঁচে থাকার আনন্দে তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:৪৫