বাবা-মা কখনো ছায়াদার বটবৃক্ষ, কখনো আঘাতের বিপরীতে ঢাল, নিকষ আঁধারে আলোর মশাল, বিষাদে স্বস্তির নিঃশ্বাস, বিপদে পরম আশ্রয়, আবার কখনো-বা শত্রুর বিপক্ষে মহাপ্রলয়। বাবা-মায়ের হাতে অদ্ভুত এক ক্ষমতা রয়েছে। কথাটিকে অদ্ভুত না বলে অলৌকিক বলাটা বোধ হয় যথাযথ হবে। তারা এই অলৌকিক ক্ষমতা বলে সন্তানের জন্য প্রায় সবকিছুই জয় করে ফেলতে পারেন; যমদূতের দ্বার থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রাণ। যখন পুরো পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নেয়, দুধের মাছি ধরনের মানুষগুলো গা-ঢাকা দেয়; তখনো বাবা-মায়েরা ছায়া হয়ে মায়ায় জড়িয়ে রাখে, আত্মবিশ্বাস জাগায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। এই মানুষগুলোর সমতুল্য তো দূরের কথা, কার্বন কপিও সারা ভুবনজুড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমাদের ঠিক পাশের বাসায় মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক থাকেন। অফিস ফেরার পথে, বাসার সামনের রাস্তায় প্রায়ই তাদের সঙ্গে দেখা হয় আমার। আসলে তারা রোজ সন্ধ্যায় তাদের ২০-২২ বছরের ছেলেকে হাঁটতে শেখাতে বের হন। পাখি যেমন তার ছানাদের একটু একটু করে উড়তে শেখায়, বাবা-মা যেমন তার ছোট্ট শিশুটিকে এক-পা দু-পা করে হাঁটতে শেখায়; ঠিক সেই আঙ্গিকে তারা তাদের ছেলেকে হাঁটার কৌশল শেখায়। কী, শুনে খুব অবাক লাগছে? ভাবছেন, এত বড় ছেলেকে আবার হাঁটার কৌশল শেখানোর কী আছে? প্রথম যেদিন তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, আমিও বেশ অবাক হয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে ছিলাম। আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম, দৃশ্যের পেছনের ঘটনা ঠিক কী হতে পারে!
সেদিন আমার আন্দাজের তির খুব গভীরে প্রবেশ করতে না পারলেও এটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম, যে মানুষ দুটি ছেলেটিকে হাঁটতে শেখাচ্ছেন, তারা বাবা-মা ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না। তাদের চোখেমুখে আমি ইচ্ছেশক্তির যে আগ্নেয়গিরি দেখেছি, তা অকস্মাৎ নিভে যাওয়ার মতো নয়; বরং জয় করার নেশায় টগবগ করে ফুটছে। একমাত্র বাবা-মা’ই তার সন্তানকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন, সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রাণভোমরা।
যেহেতু প্রায়ই তাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, এই দেখা হওয়ার সুবাদে তাদের পেছনের গল্প জানার প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয় আমার। কিন্তু কোনোভাবেই জানার সুযোগ হচ্ছিল না; অন্ততপক্ষে তাদের থেকে তো নয়ই। রাস্তা দিয়ে চলার সময় তারা এতটাই হন্তদন্ত থাকেন, পাশ ফিরে তাকানোর ফুরসত হয় না। এমতাবস্থায় তাদের দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা সমীচীন মনে হয়নি। কিন্তু ভেতরে জানার আগ্রহটা সুপ্তই থেকে গেল; তাদের সঙ্গে দেখা হলেই তা নড়েচড়ে ওঠে। আমি বিপরীত পন্থা খুঁজতে শুরু করলাম এবং একটি মাধ্যম পেয়েও গেলাম।
সেখানে কথা বলে জানতে পারলাম, ছেলেটি প্রায় দুই বছর আগে পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল এবং সেখানে গিয়ে বাইক দুর্ঘটনায় এই নিদারুণ অবস্থায় পতিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জানলাম, আমার আন্দাজ ঠিকই আছে; রোজ সন্ধ্যায় যে ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা ছেলেটিকে নিয়ে হাঁটতে বের হন, তারা ছেলেটির বাবা-মা। অবশ্য এখানে আন্দাজের কোনো কৃতিত্ব নেই; পৃথিবীতে এমন কিছু স্বচ্ছ জিনিস আছে, যাতে চোখ পড়লেই ভেতর-বাহিরের বার্তা পাওয়া যায়।
সেই মাধ্যমে কথা বলে আরও জানতে পারলাম, ছেলেটির অবস্থা আরও করুণ ছিল। দিন দিন বাবা-মার অক্লান্ত পরিশ্রম, ভালোবাসা আর আল্লাহর রহমতে সে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে।
ছেলেটিকে স্বাভাবিক করে তুলতে কত সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হচ্ছে, কত রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে, কত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হচ্ছে—তার হিসেবে মনে হয় না-ফুরানো রাতের মতোই দীর্ঘ। আমি তো কেবল কয়েকটি সন্ধ্যার সাক্ষী হয়েছি মাত্র। এরকম অনেক সন্ধ্যা-বিকেল, ভোর-রাত আছে, যার সাক্ষী তারা ছাড়া আর কেউ নেই। অবশ্য এসব হিসেব কষায় তাদের কোনো আকুলতা নেই। তারা কেবল ছেলেটিকে স্বাভাবিক দেখার অপেক্ষায় দিন গুণে যাচ্ছেন; দিন গুণে যাচ্ছেন দীর্ঘ তিমির রাত শেষে একটি আলোরাঙা নতুন ভোরের অপেক্ষায়…
তারা হাঁটার সময় আরেকটি বিষয় খেয়াল করেছি, ভদ্রলোক আর তার ছেলে সমানতালে হেঁটে গেলেও ভদ্রমহিলা তালে ঠিক পেরে উঠেন না; হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের খানিকটা পেছনে পেছনে হাঁটেন। ভদ্রলোক পেছন ফিরে তাকে বাসায় ফিরতে বললেও তিনি ফেরেন না, ওভাবেই হাঁটতে থাকেন। এই হচ্ছে মা! ফুটফুটে কলিজার টুকরো নাড়িছেঁড়া ধনকে রেখে বাসায় ফিরতে চান না। অথচ এই মানুষগুলোকে যদি নিজেদের অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য এভাবে মেহনত করতে বলা হতো, তারা কখনোই এমন একাগ্রতার সাথে তা করতেন না—যেমনটা ছেলের জন্য করছেন।
মানুষগুলো শিশু অবস্থায় ছেলেটিকে যে আগ্রহ, ধৈর্য, মায়া আর ভালোবাসায় বড় করে তুলেছেন; এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি, এই বয়সেও ঠিক সেভাবেই আগলে রাখছেন। বাবা-মায়ের কাছে সন্তানেরা বড় হয়ে যায় না। বাবা-মা সন্তানদের সক্ষম-অক্ষম, ভালো-মন্দ, ফর্সা-কালোর মাপকাঠিতেও মাপেন না। তাদের কাছে সন্তানের পরিচয় কেবলই সন্তান, সাত রাজার ধন। অথচ আমরা সন্তানেরা একটা সময় গিয়ে সব বেমালুম ভুলে যাই!
যারা আমাদের এতগুলো বছর সকল আঘাত থেকে আড়াল করে বুকে আগলে রাখেন, তাদের বুকেই আঘাত করে দূরে সরে যাই। বাবা-মা সন্তানদের যে অকৃত্রিম ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে, তার একভাগ যদি সন্তানেরা বাসে—তাহলে পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রম বলে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। টিভি পর্দায় কিংবা নিউজের পাতায় বাবা-মা সন্তানের দ্বারা নিপীড়নের শিকার—এমন নিউজও চোখে পড়বে না। বাবা-মা যে আঙ্গিকে সন্তানকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার বিশুদ্ধ বাতাসে পৃথিবীর প্রতিটি সন্তান মহামারির মতো আক্রান্ত হোক। পৃথিবী ছেয়ে যাক ভালোবাসা আর শান্তির দূর্বাঘাসে…
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:৪৯