তোমাদের মধ্যে কে কে এই কলেজের শিক্ষক হতে চাও? গনিত পড়াতে এসে বাংলাদেশের খ্যাতনামা এক-কলেজের খ্যাতনামা একশিক্ষকের প্রশ্নে ছাত্ররা মোটামুটি হতবাক। প্রায় ২০০ জন ছাত্রের একটি ক্লাসে একটা হাতও উপরে উঠল না। এই ঘটনা অস্বাভাবিক না, বরং হাত উপরে উঠলে সেটা হতো অস্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা কানের কাছে মন্ত্র পড়ে দেয়, আশে পাশের লোকজন বলতে থাকে, এই ছেলে ডাক্তার হবে, ইন্জিনিয়ার হবে। য়ে এসব শুনতেই অভ্যস্থ সে কেন কলেজ লাইফে চিন্তা করবে সে কলেজের শিক্ষক হবে? সেই শিক্ষক তারপর বলতে শুরু করেন, আমি তোমাদের থেকে ভালো শিক্ষক পেয়েছিলাম কলেজ এ থাকাকালীন। তোমরা আমাকে পেয়েছ, আমি মোটামুটি মানের, তোমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পাবে আর একটু খারাপ তার পরেরটা আর একটু খারাপ। এভাবে একসময় ভালো শিক্ষকরা হারিয়ে যাবে। যাদের হাতে দেশের মাথা তৈরি করার দায়িত্ব সেই কারিগর যদি খারাপ হয় তাহলে দেশের মাথা তো খারাপ হবেই। এটা তো মেনে নিতেই হবে।
একজন মানুষ যে পড়ালেখা করে পরবর্তী জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করে সে মোটামোটিভাবে ১৬ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটায়। তার মধ্যে প্রথম ১০ বছর কাটায় সে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তারপর উচ্চ-মাধ্যমিকে আরো ২ বছর কাটানোর পর যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে তখন সে বুঝতে পারে যে, ভালো শিক্ষক একজন ছাত্রকে কতটুকু উপরে তুলতে পারে, একজন ছাত্রের ভেতর থেকে কিভাবে তার সর্বোচ্চটা বের করে ফেলতে পারে। আবার অনেকেই এটাও বুঝতে পারে না, কারন আগের ১২ বছরের মধ্যেই তার মধ্যে থেকে ভালো মন্দ বিবেচনার বোধটিকে সুপরিকল্পিত ভাবে মুছে ফেলা হয়েছে।
দেশে প্রায় গোটা তিরিশেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমার মনে সন্দেহ হয়, এর মধ্যে কতগুলো ভালো, মননশীল মানুষ উপহার দিতে পারবে। ১২ বছর ভুলভাবে চালিত হয়ে আসা, ভুল ভাবে বিচার করতে শেখা একজনকে আপনি ৪ বছরএ শিক্ষিত করতে পারবেন এটা হয়ত সত্য, কিন্তু সুশিক্ষিত কতটা করতে পারবেন - সেটা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছেন? আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটা ছাকনি। এটা প্রতিবছর ছেকে ছেকে মেধা বের করে পরবর্তী স্টেজ এর জন্য। শেষ স্টেজ এ এসে দেশের বাইরে পাঠায় - রেমিটেন্স এর জন্য। কিন্তু যারা ছাকনির চিকন ছিদ্রি দিয়ে বের হতে পারে না, তাদের উন্নয়নের জন্য আর কিছু করে না। ঝাকি দিয়ে ফেলে দেয় কারন তার হাতে তখন এসে যায় আরো কিছু নতুন মুখ যাদের কে ছাঁকতে হবে।
দেশের আজ য়ে অবস্থা, যারা একটু মেধাবী আছে তারা চায় কোনভাবে দেশ ছেড়ে বাইরে চলে আসতে। আমাদের প্রকৌশলীরা তাদের সমস্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অন্যদেশের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি উন্নতকরে, টাকার জন্য। বিদেশের বিভিন্ন কাজের অটোমেশন করে তারা টাকা কামায়। দেশে যাওয়ার কথা তাদের প্রথম কিছুদিন মনে থাকে, তারপর ভুলে যায়। কেউ কেউ দেশে ফেরতও যায়, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়, তার সমসাময়িক মানুষরা তখন দূর্নীতির আশ্রয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে, সে লোকটা হয়ত কিছুদিন চেষ্টা করে কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে আবার বিদেশে ফেরত আসে।
ছাকনি প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ে যারা বাদ পড়ে, তারা একসময় বড় হয়। বেচে থাকার জন্য টাকার দরকার হয়। তখন তাদেরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে তথাকথিত রাজনৈতিক দল। অসম্পূর্ন এবং তথাকথিত শিক্ষিত একটি মস্তিক তখন টাকার নেশায় পড়ে যায়। একের পর এক অপরাধ করতে থাকে কোন প্রকার অপরাধবোধ ছাড়াই। তাদের বোধশক্তি তো অনেক আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে, খুব বেশি দোষ দিয়ে কি লাভ আছে? এই বোধশক্তিহীন মানুষগুলোই একসময় হয়ে উঠে দেশের মাথা। তারা তখন টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে কিনে নেয় ছাকনি যন্ত্রের শেষ পর্যায়ে বাদ পড়া কিছু মাথাকে যারা ভাগ্যের দোষে দেশের বাইরে যেতে পারেনি।
আমরা তথাকথিত সুশীল সমাজ এখন তাদের কর্মকান্ডে বিরক্ত হই। আমরা ভেবে পাইনা - দেশের মানুষ যখন খেতে পায় না তখন কিভাবে তারা শুল্কমুক্ত প্রক্রিয়ার গাড়ী আমদানি করে। আমরা যখন খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারি যে, ঢাকা বিকেন্দ্রীকরন করা ছাড়া কোন গতি নেই, তখন তারা কেন সেটা বুঝতে পারে না সেটা ভেবে আমরা অবাক হই। আমরা আরো অবাক হই - কিভাবে একজন সাংসদ খুন করে তার ছা-পোষা ড্রাইভার এর মুখ দিয়ে বের করে যে, সে খুন করেছে। মাঝে মাঝে আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ গোল টেবিল বৈঠক করে। টিভিতে টক শো হয়, আমরা পরিবেশের কথা বলি ঢাকার কোন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল এর সম্প্রচার কক্ষে বসে। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরনের জন্য সেমিনার হয় ঢাকারই কোন খ্যাতনামা হোটেল এ। ঢাকার বাইরেও যে কোন কিছু করা যায়, সেটা বুঝানোর জন্য কি ঢাকায় বসে মিটিং করা শোভনীয়?
সেবারের এইচ এস সি পরীক্ষায় সেই কলেজ এর সেই ক্লাস থেকে ৭ জন মেধাতালিকায় স্হান করে নেয়। সমগ্র কলেজ থেকে ১৭ জন এর মত। সেই কলেজ এর বেশিরভাগ ছাত্র এর গায়েই লেগে যায় ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ভালো ডিপার্টমেন্টের তকমা। সামনে হয়ত তাদের পকেটে চলে যাবে উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতনামা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একদিন এরাই বাংলাদেশে ফেরত যাবে তাদের সন্তানদের নিয়ে - আর বলবে, এ দেশে থাকা যাবে না, দেশটা থাকার উপযোগী নয়। পনের দিন বা একমাস বা মাস তিনেক থেকে এরা আবার বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশী পিঠা নিয়ে বিমানে উঠে বলবে - 'হলি কাউ'।
আমরা কি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


