somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঞ্চাশ টাকা

২৭ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কমলাপুর স্টেশনে নেমেই মেজাজটা তাঁতিয়ে উঠল আমার । চৈত্রের সূর্যটা যেন ইচ্ছা করে আমার সাথে শত্রুতা করছে । মনে হচ্ছে কামারের হাঁপর দিয়ে অনবরত কেউ বাতাস দিচ্ছে গায়ে।
শিখা এক্সপ্রেস এর তাপানুকুল লেখা বগি থেকে বের হয়ে এসে গরমের হল্কার ফলাগুলো যেন বেশীই বিঁধছে গায়ে । সঙ্গে থাকা ভারী লাগেজটাকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে গলার কাটা । দাত কিড়মিড় রাগ নিয়ে সেটাকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে হাটতে শুরু করলাম ।

আজ আবার হরতাল। গত কয়েকদিন যাবত হরতালে যে পরিমাণ গাড়ি পোরানো হয়েছে তাতে আমার সাধের কোটি টাকার লেক্সাস গাড়িটি বের করার দুঃসাহস একদম করি নি।
রিকশায় ই যেতে হবে । হাটতে হাটতে সূর্য , রাজনীতি ঢাকার গাঘেঁষা দালান সবগুলোকে শাপ শাপান্ত করছিলাম মনে মনে। কিছুদুর হাটার পর ই একটা রিকশা পেলাম , “ এই খালি... হাক ছাড়লাম , কিন্তু রিকশাওয়ালা আমার দিকে একবার তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
...... মনে মনে একটা বাজে গালি দিলাম ।

আর কিছুদুর হাটতেই গাছের নিচে ছায়ায় দারানো কয়েকটা রিকশা দেখলাম । একটা ছোট ঠেলাওয়ালার থেকে তরমুজ কিনে খাচ্ছিল কয়েকজন রিকশাওয়ালা । তরমুজ ফালির প্রত্যেকটিতেই তার বীচির দ্বিগুণসংখক মাছি তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বেস্ত ।

এই , গুলশান গোল্ডেন টাওয়ার , হাত দিয়ে ইশারা করলাম ।
না ভাই, ওইদিকে যামু না ।
গরমে কিম্বা অপমানে জানি না রাগে আমার পিত্তি জ্বলে উঠল । অফিসের বড়কর্তা আমি । সবাই আমার কথায় উঠে বসে । না শোনার অভ্যাস বহুদিন যাবতই আমার নেই ।

হন হন করে হাটা শুরু করলাম আমি । হাটতে হাটতে বড় রাস্তার কাছা কাছি এমন সময় কই যাইবেন ? শুনে পাশে তাকালাম । পানের দোকানের সামনে দাড়িয়ে টাকপরা তেল চিটচিটে , কাল বেটে এক রিকশাওয়ালা। হাতে এক খিলি পান ।
- গোল্ডেন টাওয়ার , ভাড়া কত নিবা ?
- সত্তুর টাকা ।
- এই খানে দারালে গোল্ডেন টাওয়ার দেখা যায় , আর তুমি মিয়া ভাড়া চাও সত্তুর টাকা ! পঞ্চাশ দিব ।
দরাদরি করতে লাগলাম । আমি সবজায়গায় জিততে পছন্দ করি । আফসার চৌধুরীকে কেউ ঠকিয়ে গেছে এমন নজির নেই ।লোকটা পান মুখে দিল, কিছু একটা চিন্তা করল তারপর বলল
-আচ্ছা উডেন ।
আমি উঠে বসলাম । আর যাত্রী টানার সাথে ব্যাগ টানা ফ্রি এমন তত্ত্ব থেকে হোক বা দায়িত্ব থেকে হোক যত্নসহকারে রিকশাওয়ালা ব্যাগটা তুলে দিল ।
- হুডটা তুলে দিও তো ।

রিকশা চলতে শুরু করল । মাথার উপরে হুড তোলা থাকলেও সূর্য যেন আমার স্যান্ডেলের ফাক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা চামড়ায় গরম খুন্তির ছ্যাকা দিচ্ছিল । আমি তুলনামূলক কম ভাড়াতেই পেয়েছি বলে মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করলাম। গোল্ডেন টাওয়ারের দূরত্ব একদম কম না । তার উপরে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও খানাখন্দের আশীর্বাদ তো আছেই ।

রিকশাওয়ালা পা টেনে টেনে প্যাডেল চালাচ্ছিল । উচ্চতা একটু কম বলেই হয়ত । আমি তার তেল চিট চিটে পায়ের দিকে তাকালাম । স্যান্ডেলহীন পা আর তাতে অসংখ্য ফাটল । শার্টটার রং এতটাই চটে গেছে এককালে কি রং ছিল বোঝা কঠিন। সারা গায়ে ঘাম ঝরছে , শার্টটা ভিজে জবজবে । মুখের চামড়ায় অনেক ভাজ । কপালের দুপাশটা চাপা আর শিরশিরে আঙ্গুল । আমি দেখেছি, সব গরিব ই একই রকম । তাদের চেহারাও কেমন যেন এক ।

পিচিক করে রাস্তায় সে পানের পিক ফেলল । কিছুখন পর পর শার্টের হাতায় ঘাম মুছছে সে। পরিবেশ বিষয়ক দু’একটা উপদেশ দিতে গিয়েও চুপ রইলাম । এই শ্রেণীর মানুষ কথা বাড়ালেই সাহায্য চাবে ।
- স্যার , এইবার ঢাকায় গরম বেশি পড়ছে ।
- হুম।
- আপনাগো ঢাকায় তো গাছপালা বেশি নাই হেইজন্য গরম আরও বেশী ।
- হুম।
- স্যার তিনমাসের লইগা ঢাকায় আইছি , এই তিনমাস খেতের কাম নাই, গাড়ি চালামু কিছু টাহা কামামু হেইর পর আবার বাড়ি যামু ।
- বাড়ি কে কে থাকেন ?
- আমার বুড়া মায় , বউ আর তিনডা ছাওয়াল । ছোড ছাওয়ালডা দুধের বাচ্চা , মধ্যেরডা ইস্কুলে যায় । মায়রে ভাইরা দাহে না কিন্তু আমি মায়রে হালামু না ।
- হুম ভাল ।
- স্যার , দুঃখ বড় পোলাডারে লইয়া । হ্যাঁর মায় মারছে দেইখা রাগ কইরা দেশান্তরী হইছে । চাইর বছরে একফির ও বাড়ি আয় নাই ।

চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই আমার রিকশার সাথে আরেকটা রিকশার ঠোকাঠুকি হল । ওই শালা ...হারামির পুত ...চউখে দেখিস না , ইত্যাদি নন সেন্সর গালির বৃষ্টি হল ।
বাকিটা পথ আর কোন কথা হল না । আমার বাসার সামনে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন তিনটা বেজে গেছে । ভাড়া টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম সব বড় নোট । ভাংতি আছে জিগ্যেস করতেই পান খাওয়া দাঁতে একটা হাসি দিল সে । ঘামে মুখ জবজবে ।
- মাত্র নামছি স্যার । বিসমিল্লাই হয় নাই এহনও ।
দারওয়ান দুটোর একতাকেও দেখতে পেলাম না । অগত্যা কি আর করা বললাম ,
- ভাই তুমি একটু দাড়াও , বাসা থেকে নিয়ে আসছি ।

লিফটে উঠে গেলাম । গোল্ডেন টাওয়ারের সবচেয়ে বড় ফ্ল্যাটের একটিতে থাকি আমি । ১০ বছর আগে পঞ্চাস লাখে কেনা ফ্ল্যাটটির এখন মূল্য তিন কোটিরও বেশি ।
দরজা খুলতেই আমার বাচ্চা তানিসা দৌরে এল । আমার দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বেলাও আমায় ঠাণ্ডা জুস খাওয়ানোতে বাতিবেস্ত হয়ে পড়ল । আমি দুপুরে খেলাম, সাওয়ার নিলাম এসি ছেড়ে ঘুমিয়ে গেলাম । ভ্রমনক্লান্তির কারণে বোধ হয় একটা ভাল ঘুম হোল । মাগরিবের আযানের সময় যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল তখন ই আমার রিকশা ভাড়ার কথা মনে এল ।

ঘোরের বসেই আমি দৌড়ে নিচে নামলাম। গার্ডরা বলল যে এক কাল ছোট খাট রিকশাওয়ালা ঘণ্টাখানেক দাড়িয়ে ছিল। একজন সাফারি পড়া ফর্সা , লম্বা লোককে খুঁজছিল যাকে সে মধ্য- দুপুরে কমলাপুর থেকে নিয়ে এসেছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আস্তে আস্তে রিকশা চালিয়ে চলে গেছে । আমি পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম । আমার হাতটি খুব ভারি লাগছিল ।

বিশ্বাস করুন, আজও পঞ্চাশ টাকার নোট খুললেই আমি ছোট খাট টেকো কাল এক রিকশাওয়ালা কে দেখি ঘামে জবজবে শরীর , মন খারাপ করা পান খাওয়া মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে আমার বাসার সামনে থেকে প্যাডেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে ।
১৯টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বামিঙ্গিয়ান উপাখ্যান

লিখেছেন যুবায়ের আলিফ, ১০ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০




মাঝ রাতে কড়া একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো জ্যাকের৷ ঘুমের ঘোরে দেখতে পেল কেউ চোখ ধাঁধানো পোষাক পরে ডাইনিংয়ে একটা চামচ রেখে দরজা গলিয়ে চলে যাচ্ছে৷ গা ও পোষাকের উজ্জ্বলতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×