somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্পঃ সৃষ্টিকর্তা তুমি আমায় সাহায্য কোরো ।

২৬ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুহানার দাফন হয়েছিল ১৯ শে শ্রাবণ বৃষ্টির দিনে । তার প্রিয় শহরেই । সুহানা তার জন্ম ও বেড়ে উঠার শহরকে সুন্দর একটা নাম দিয়েছিল “ ঝুম বৃষ্টির দেশ”।

আমি যখনই গাড়ি চালিয়ে দীর্ঘঘণ্টার যাত্রা শুরু করতাম সুহানা
সুর করে বলত ঝুম বৃষ্টির দেশে যাই রে ...
সুহানা অবশ্য সব কিছুরই একটা গালভরা নাম দিত । আমারও একটা গালভরা নাম দিয়েছিল “ টিন্নিপুটুস” ।

প্রায় সবসময়ই আমার আগে ঘুম থেকে উঠত সে । আমার ঠোঁটে ছোট করে চুমু খেয়ে বলত ,
টিন্নিপুটুসটা উঠ তো ।

আমার ব্যাংকার শ্বশুরমশাইয়ের অত্যন্ত আদরের মেয়ে ছিল সে । তিনি সুহানাকে এতটাই ভালবাসতেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সুহানা যখন ঢাকায় চলে এসেছিলো সেই থেকে আর মুরগির মাংস খান নি তিনি । মুরগির মাংস সুহানার খুব প্রিয় ছিল যে !

সুহানার সাথে আমার পরিচয় টাও হয়েছিল অন্যরকমভাবে । আমি তখন মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষে । আমি টুটুল নামে যে ছাত্রটিকে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি পড়াতাম তার হাতে একদিন দেখলাম কিছু বাংলা নোট । জানতে পারলাম ওটা ওর বাংলা ম্যাডাম তৈরি করেছেন ।

এত সুন্দর হাতের লেখা ও উপস্থাপন আমি কমই দেখেছি । লেখক ম্যাডামকে দেখার এক সুপ্ত বাসনা তৈরি হল । মনে মনে তার একটা ছবিও আঁকলাম। ছাত্রের অভিভাবককে বললাম যে ছাত্রের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দু’জন শিক্ষকের একত্রে বসে আলোচনা করা দরকার । ছাত্রের অভিভাবককও ছাত্রের ভবিষ্যতের চিন্তায় আমাদের দুজনকে মিটিং এ বসিয়ে দিল ।

এবং তাকে দেখলাম আমি , মধ্যম গড়নের , লম্বা চুল , ফর্সা রঙ , স্বচ্ছ দৃষ্টি । তার সৌন্দর্যের অধিকাংশ ই ঢেকে রেখেছে তার শালীন পোশাক । কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে তার বুদ্ধিমত্তা । কথা শুনেই বুঝলাম যে মেয়েটি অজস্র বই পড়েছে এবং শিল্প সংস্কৃতিতে তার জ্ঞান সাঙ্ঘাতিক তীক্ষ্ণ ।

কথার মাঝখানে কি কারণে সে হেসে উঠল আর আমি তার নামের সার্থকতা পেলাম “সুহানা”।

ছাত্রের ভবিষ্যত নিয়ে মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতাম তার সাথে । আস্তে আস্তে ছাত্র আর ছাত্রের ভবিষ্যতের জায়গায় কথার বিষয়বস্তুতে আমি আর আমার ভবিষ্যত এসে জায়গা করে নিল ।

কেমন জানি একটা বুক ঢিপঢিপ অনুভূতি নিয়ে সে আমার সমস্ত সত্তায় মিশে গেল। তাকে দেখার ইচ্ছা আর তার সাথে কথা বলার তৃষ্ণা সবকিছু মিলে আমি বুঝলাম , আমার হয়ে গেছে ।

তাকে প্রভাবিত করার কোন উপলক্ষ বাদ দিতাম না । ঈদ, শবে কদর , মেরাজ , সরস্বতী পূজা , মাঘী পূর্ণিমা আর বাংলাদেশের খেলা জেতা ,সব কিছুতেই মেসেজ পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাতাম ।

সুহানা সবসময় একটা মার্জিত দূরত্ব বজায় রাখত। আর আমার চেষ্টা ছিল সেটা অতিক্রমের ।


ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবের পর সুহানার বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার মেডিক্যাল কলেজের টীম তৈরি হল । এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি সুহানার সারল্য আর পবিত্রতা অনুভব করতে লাগলাম । এ যেন এক সাক্ষাত দেবী ।

এই আরাধ্যকে আমার পেতেই হবে । আস্তে আস্তে জানলাম আমি একা নই , তাকে চাওয়ার তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ । তার মধ্যে আমার বেশ কজন বন্ধুও আছে ।

অবশেষে তাকে আমি পেলাম । এবং কিভাবে পেলাম সে কাহিনী দিয়ে কমপক্ষে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছিনেমা বানানো যাবে । তাকে প্রথম চুম্বনটি করেছিলাম শ্রাবণের দিনে ঝুম বৃষ্টিতে রিকশায় । গাঢ় চুম্বন আর প্রগাঢ় আলিঙ্গনে সুহানাকে সম্পূর্ণ করে পাওয়ার ইচ্ছা তৈরি হল । খুবই দ্রুত বিয়ে করলাম তাকে । ভাবলে অবাক লাগে একটা স্বাক্ষর আর কিছু দোয়া দরূদ পাঠের পর সুহানার পাশে ঘুমানোর অনুমতি পেলাম আমি ।

আমি এক প্রচণ্ড সুপুরুষ , সুহানা এক উচ্ছল হরিণীর মত , আমাদের দাম্পত্য জীবন সে এক নিরবিচ্ছিন্ন সুখের গল্প ।
সুহানার ভাগ্য নাকি আমার জানি না , বিয়ের পর আমি দ্রুত এফসিপিএস শেষ করলাম । আমার হাতযশ চারদিকে ছড়িয়ে গেল । বড় হসপিটালে কাজের সুযোগ হল আমার । আমিও অর্থ আয়ে আর আমার কেরিয়ারে মননিবেশ করলাম ।

আমার আন্ডারওয়্যার থেকে শুরু করে পঞ্চাশ কেজি চালের বস্তা , চেম্বারের দেয়ালের রঙ থেকে শুরু করে আমার পড়ার বিষয়বস্তু ইন্টারনেট থেকে নামানো , সবই সে করত সুনিপুনভাবে । এমনকি আমার খুঁতখুঁতে মা আর পাগলাটে বাবা সবাইকে মানিয়ে চলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার । আমার আত্মীয় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছিল সে । সে যেন ছিল এক সৌর জগতের কেন্দ্র । আমার ভাল লাগত আবার হিংসেও হত খুব ।

সংসার সামলেও সে এক উজ্জ্বল ফলাফল নিয়ে বের হল ।
সমস্যাটা তৈরি হল ক্যারিয়ার নিয়ে । ঘরের বউকে বাইরে কাজ করতে দিলে ঘর কে সামলাবে ? তাছাড়া অধিকাংশ কর্মজীবী মায়েদের সন্তানরা মানুষ হয় না আমি তাকে বোঝালাম । সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিগুলোর কথা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল । আমি শক্ত রইলাম পাইন গাছের মত, আমার পরিবারও আমার পাশে রইল এই যুক্তিতে যে মেয়েদের সংসারেই মানায় ।

সুহানা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায় প্রতিদিন । বাচ্চা হলে এমনিতেই আটকে যাবে , মা আমায় বলল ।
আমি বীজ বুনে দিলাম । কিছুদিনের মধ্যেই সন্তানসম্ভবা হল সুহানা । কিন্তু ক্যারিয়ার বিষয়ে তার ভাবনার কোন পরিবর্তন নেই ।

আমি প্রচণ্ড একগুঁয়ে জেদি , সুহানাও আমায় যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করত যাতে আমি বিষয়টি মেনে নেই । কিন্তু খুব রাগ হয় আমার, বেঁকে যাই আমি । বাবার কাছ থেকে জীনগতভাবে একগুঁয়েমি আর জিদ পেয়েছি আমি , আমার বাবা আমার মাকে খুব মারতেন , মারতে মারতে মেরেই ফেলতেন এমন।


এক ১৮ ই শ্রাবণে, আমি অনেক পরিশ্রম করে বাসায় ফিরলাম । সুহানা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এমনটা হয় । আমরা একে বলি ব্লু ম্যাটারনিটি টাইম ।

আমি কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আবার পুরনো রেকর্ডটা বাজাতে শুরু করল । আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না । পিঠ বরাবর এক ঘুষি লাগিয়ে দিলাম । বিস্ময়ে আতঙ্কে সুহানা ঘুরে গেল ।ঘুষিটা সজোরে গিয়ে ওর পেটে লাগল । সাড়ে চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা পেট আঘাতটি সইতে পারল না । চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে গিয়ে সদ্য কাটা মুরগির মত লাফাতে লাগলো । হসপিটালে গিয়েও কোন লাভ হল না । রাত সাড়ে চারটায় মারা গেল সুহানা ।


আমি পাথর হয়ে গেলাম । আমার মা আমার মুখ বন্ধ রাখতে বলল । প্রসুতি অবস্থায় এরকম কত মেয়ে মারা যায় ! শ্বশুরবাড়িতে আমি চুপ রইলাম কাঠের পুতুলের মত । সুহানার বাবা মা আর ভাইয়ের চোখের পানি ওই দিনের শ্রাবণের বৃষ্টিকে হার মানিয়ে দিল ।

শুনেছি আমার শ্বশুরের নাকি মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে ।
সুহানার কথা খুব মনে পড়ে আমার । বারান্দায় ওর লাগানো হাস্নাহেনা গাছটায় এখন ফুল ফোটে । ওর বইগুলো এখনও শোকেস ভর্তি । মাঝে মাঝে ওর ডাইরি খুলে পড়ি । আমার মা আমায় সাহস দেয় প্রতিদিন । অতীতকে মনে রাখতে নেই বাবা । আমিও টোলপড়া সেই হাসিমুখটা ভুলে যেতে চাই , কাটা মুরগীর মত মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর কিম্বা মৃত নিথর সব রকম সুহানাকে ভুলে যেতে চাই আমি,


সৃষ্টিকর্তা তুমি আমায় সাহায্য কোরো ।
২০টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×