প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি, বিশেষ বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে জীবনধারন করে। আমরা তাকে সেই জাতিগোষ্ঠির ভাষা বলি। আমাদের ভাষাটি বাংলা, অনেক প্রাচীন অনেক পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপে এসেছে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী স্বপ্ন দেখে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারনা আর ভাষা অনুযায়ীই, স্বপ্নের সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এটিই। ইংরেজরা ইংরেজিরা ইংরেজিতে, হল্যান্ডেরা ড্যানিশে, তামিলেরা মালায়ামে, শ্রীলংকানেরা সিংহলিতে। সমস্যাটা বোধকরি আমাদেরই, আমরা শুধু বাংলা না, ইংরেজি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায়ও স্বপ্ন দেখি। আমাদের সবচেয়ে নেতিবাচক চরিত্র হচ্ছে অপরের বিষয়বস্তু আমাদের বিষয়বস্তু থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ইংরেজরা সার্থক, কেননা তারা যখন এদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তখন তাদের লক্ষ্যছিল চেহারায় বাঙ্গালী কিন্তু মগজে ইংরেজ তৈরি করা।
‘বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা?’
এখন হয়তবা অনেকের কাছেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, তাদের আঁশ, স্বাদ অন্য ভাষায়ও মেলে। তারা চাইলে বায়রন হবার স্বপ্নে বিভোর মাইকেলের জীবনী পড়তে পারেন (আশার ছলনে ভুলি – গোলাম মুরশিদ এবং মাইকেলের কবি আত্মা – ড। ক্ষেত্র গুপ্ত)। যদি আপনার মনে নীচতা থাকে, যদি বাংলা, বাঙ্গলী ও তার সংস্কৃতিকে নিজের মনে না করেন তবে আপনি সবচেয়ে সুন্দরতম সাহিত্য, সংস্কৃতিকে হারালেন। যদি নিজেকে অনেক বিজ্ঞ, বিদগ্ধ, পণ্ডিত মনে হয় তবে নামগুলিতে চোখ বুলিয়ে যান – রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র, ইসমাইল হোসেন, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, অন্নদা শংকর প্রভৃতি, এরা আপনার মতই বহুভাষা জানতেন, আঁকড়ে ছিলেন বাংলায়ই। সবথেকে সাহসী উচ্চারণটি বোধকরি কবি আব্দুল হাকিমের, -
“যে সব বঙ্গতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
বাংলা ব্যবহারে সামগ্রিক বিষয়বস্তু প্রকাশ যেমন সহজ হয়, তেমনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে শব্দ চয়ন করা যায়। বিপুল শব্দের এক বিশাল সমন্বয়ে আমাদের বাংলা শব্দভান্ডার (অনেকেই হয়ত তৎসম আমাদের না বলবেন তবে তাদের বলি ব্যাকরণের শব্দতত্ত্বে আত্তীকরণ কেন তাহলে?)। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে সর্বাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ভাষা হলো বাংলা, বিজ্ঞান যেমন সূত্রে ব্যাখ্যা করে বাংলাভাষাকেও তেমনভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর। অতএব কেন আমরা বাংলা সর্বজনীনভাবে ব্যবহার করব না? আমাদের লক্ষ্য, আমাদের সামগ্রিক চিন্তা, দর্শন, অনুভূতি সবকিছু হোক বাংলায়। প্রশ্ন আসে সবসময়ই কি বাংলা ব্যবহার করব? না, কখনোই না; বৈশ্বিকভাবে যখন আমরা আমাদের গবেষণা, চিন্তা, দর্শন ব্যাখ্যা করব তখন তা অবশ্যই তা আন্তর্জাতিক (দ্বিতীয়) কোনো ভাষায়ই হতে হবে। আমরা যখন বিদেশিদের সাথে মত বিনিময় করব তখন আমাদের একটি সাধারণ ভাষার প্রয়োজন হবে, আর বৃটিশ উপনিবেশের জন্য সেই স্থানটা ইংরেজির হাতে। তবে সেই সমস্ত দলিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলায় থাকলে ক্ষতি কি (ঠিক একারনেই দেশে অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকলেও তার কি করেছেন, কেনই করেছেন কিছুই জানি না)? ধরাযাক আমি গবেষণা করলাম গোপালগঞ্জের পানিতে আর্সেনিক, ভারী ধাতু ও তার নিরাময় নিয়ে, আমি তা প্রকাশ করলাম নেচার সাময়িকীতে। পেলাম পিএইডি কিন্তু গোপালগঞ্জের অধিবাসীরা কিছুই জানল না! আন্তর্জাতিক ভাষা জানা প্রয়োজন কিন্তু তাই বলে তো কেবল ‘মা’ বলতে শেখা শিশুটিকে ‘মম’ ডাকা শেখানোর জন্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে পারি না; দেশের বিচরক, উকিল, মামলাকারী হওয়া সত্ত্বেও বিচার ইংরেজি ভাষ্য লিখতে পারি না। এ অনীহা কার, শ্রদ্ধেয় বিচারকরা কি এই দায় এড়াতে পারেন? শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো বেহাল দশা ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে দেশের লাভ না ক্ষতি হচ্ছে কেউ বিচার করছিনা বরং বাংলাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো যায় কিনা সেই চিন্তা করছি। কিছু নতুন শাস্ত্র আছে যার নিজস্ব ভাষা আছে স্বীকার করছি, কিন্তু সেই দোহাই দিয়ে শতাব্দ প্রাচীন রসায়ন, গণিত কিংবা চারদশক পার করা ফার্মেসিকে ইংরেজিতে পড়ানোর অর্থ কী? অনেকেই আধুনিকায়নের কথা বলবেন বলে মনে করি। সেই জায়গায় প্রশ্ন, আধুনিকায়নের জন্যই যদি ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হয় তবে ১২ বছর ঘরে ইস্কুলে-কলেজে পড়ানো ইংরেজি বিষয়ের স্বার্থকতা কি শুধুই A+ ? যদি ঐ পদ্ধতি ব্যার্থ বলেই মনে করেন এখন তবে ব্যার্থতা শিক্ষাব্যবস্থার, শিক্ষাগুরুদের। আর যদি ব্যার্থ না হয় তবে তারা বিদেশি জার্নালগুলো পড়তে পারবেন, বোঝানোর বিষয়টি অনেকাংশে উচ্চশিক্ষার শিক্ষাগুরুদের উপরে বর্তায়।
তাহলে, আমরা কি বিশ্বসাহিত্যের অমৃতসন্ধানে বের হবো না! পড়ব না সেক্সপিয়ার, বায়রন, হোমার, ওয়ার্ডসওর্থ, ইয়েটস, কামু প্রভৃতিদের লেখা! না, আমরা পড়ব সন্ধান করব রত্মের-মুক্তার, ঝিনুককে মোড়কে পুরে বাজারে ছাড়ব না।
“For God’s sake hold your tongue,
And let me love.”
এর পরিবর্তে লিখব -
“দোহাই তোদের একটুকু চুপকর,
ভালোবাসিবারে মোরে দে অবসর।”
-- [শেষের কবিতা, শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
অর্থাৎ, সর্বজনীনভাবে বাংলা ব্যবহৃত হওয়া জরুরী। কিন্তু বিতর্ক আছে আরেকটা, কোনটা ব্যবহৃত হবে সাধু না চলিত? যদি চলিত হয় তবে তা কি আঞ্চলিক নাকি প্রমিত। রবীন্দ্রনাথ নিজে সুয়োরানী-দুয়োরানীর মীমাংসা করে গেছেন, নিজে সাধু ভাষ্যে সারাটা জীবন লিখলেও শেষদিকটায় চলিত ভাষায় লিখে গেছেন, কথা বলেছেন যেখানে যেভাবে বলা উচিৎ সেভাবে। লেখার জন্য এখন পর্যন্ত আদর্শ দু’টিই। কিন্তু বক্তব্যের সুবিধার জন্য্ সবাই চলিত রীতিতে চলছেন। সাহিত্যেও এমনটাই, তবে আঞ্চলিক সাহিত্য অঞ্চলিক ভাষার দাবী অবশ্যই রাখে। কথ্যরীতিতে যখন বিদগ্ধজনের সমাবেশ তবে তা অবশ্যই প্রমিতরীতি হওয়া আবশ্যক, কিন্তু রংপুর অঞ্চলের এক যুগলের মাঝে প্রমিতরীতিতে প্রণয়য়ের ভাষা চাওয়া কল্পনারই নামান্তর।
শেষ করছি রামায়ণের হনুমানের চিন্তাজড়িত দুইটি শ্লোক দিয়ে, (সুন্দরকাণ্ড, ত্রিংশ সর্গ ১৮-১৯)
যদি বাচং প্রদাস্যামি দ্বিজাতিরিব সংস্কৃতাম।
রাবণং মন্যমানা মাং সীতা ভীতা ভবিষ্যতি।।
অবশ্যমেব বক্তব্যং মানুষং বাক্যমর্থবৎ।
ময়া সত্ত্বুয়িতুং শক্যা নান্যথেয়মনিন্দিতা।।
অর্থাৎ, সংস্কৃতে বললে সীতা মা, রবণ ভেবে ভীত হতে পারে। তাই পরিচয়ের জন্য, আশ্বাস দেবার জন্য অর্থবান মানুষবাক্য বলা আবশ্যক (এই মানুষবাক্য বলতে অযোধ্যার প্রচলিত ভাষাকে বোঝানো হয়েছে, যা সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাষা।)।
সুতরাং বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার যৌক্তিকতার মানদন্ডে পিছিয়ে নয় বরং এগিয়েই থাকে হাজার মাইল দূরে।