আমার মা।
সাধারন। রাগী। খুঁতখুঁতে।
ঘুরতে বেড়াতে খুব একটা পছন্দ করে না। সারাদিনই বলতে গেলে রান্নাঘরে কাটিয়ে দেয়। বাবাও মায়ের হাতের রান্না ছাড়া খেতে পারেনা। বাবার প্রতিদিন বাজারের অভ্যাস। তাই হয়তো মায়ের ফেভারিট হবি রান্না।
আমাদের সাথে, বিশেষ করে আমার সাথে প্রায় সারাদিনই ক্যাটক্যাট করতে থাকে....
চুল বাঁধিনা কেন?
ঘর গুছাইনা কেন?
খাই না কেন?
ঘুমাই কেন?
ঘুমাই না কেন????????
আমিও গজগজ করি, মাঝে মাঝে হেসে ফেলি ধমকের নতুনত্ব দেখে, মাঝে মাঝে চিৎকার করি রাগে, ঝগড়াও করি...
এই আমার 'মেয়ে মানুষ' মা!
হিন্দি সিরিয়াল দেখেনা ঠিকই, কিন্তু খুব মনযোগ দিয়ে জি বাংলায় 'খনা' দেখে। আমি এটা নিয়েও চিৎকার করি। খনাকে জলদস্যুরা ধরে নিয়ে গেলে ওর বাবা মায়ের সাথে আমার মাও কেঁদেছিলো, আর আমরা সবাই ক্ষেপিয়েছিলাম...
খুব বেশি সাদামাটা, বসনে- বাসনে, খুব অল্পতেই রিঅ্যাক্ট করে।
আবার একই সাথে আমুদে, শৌখিন, আড্ডাবাজ।
কিভাবে জানি এই বৈপরিত্বটা মেইনটেইন করে।
আমার ফ্রেন্ডদের দারুন পছন্দ আমার নির্ভেজাল কালো মা কে...
আমার বাসায় এসে আমাকে বাদ দিয়ে মায়ের সাথে আড্ডা জুড়ে দেয়...
আর আমি হাসতে থাকি, কিভাবে মা নিমিষেই তরুণী হয়ে যায় তা দেখে!
নিজের মায়ের রান্নাতো সবাই ভালোবাসে, কিন্তু আমার মা যে একটু বেশি ভালো রাঁধে তা বুঝি অন্যদের খুব তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে।
মা বই পড়ে না, ফিলোসফি ঝাড়ে না, লেখালেখি শুধু হিসাবের খাতা আর টেলিফোন ডিরেক্টরিতেই সীমাবদ্ধ, এতই অগভীর আমার মা!
এভাবেই ভেবে এসেছিলাম, যখন আশে পাশে দেখতাম চকচকে ঝকঝকে ইন্টেলেকচুয়াল আন্টিদের। মাকে মনে হত ক্ষ্যাত। ভেবেছিলাম, জুতার ফিতা বাঁধা - এ আর এমন কি? ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নাশতা বানিয়ে টিফিন রেডী করা তো সব মায়েরদের কাজ। চুল কাটতে দেয় না, লম্বা চুলে তো মা ই বেনী করে দেবে!
মাকে পাত্তা না দিয়ে প্রিয় বান্ধবীর সাথে ঘুরে বেরিয়েছি, ওর কথায় উঠেছি, বসেছি...
মা খুব ক্ষোভ নিয়ে বলতো, 'আরেকবার জন্ম নিলে মা না, বান্ধবী হয়ে জন্মাতে চাই!'
আমার অগভীর মায়ের এতো গভীর একটা কথার মানে বুঝিনি তখনো, যতক্ষণ না আমার সেই প্রিয় বান্ধবীর কাছে আমি পুরানো ও ইউজলেস হয়ে গেলাম।
দিনের পর দিন বাসায় বসে কাটিয়েছি এরপর...।
মা কে খুব কাছ থেকে দেখেছি, যেভাবে গত ২৩ বছরে দেখা হয়নি! বা দেখা উচিৎ ছিলো...
বুঝতে পারলাম, কেন মা মুরগীর পাখনা ভালোবাসে!
না, টেস্টি বলে না, সবচেয়ে কম মাংস থাকে বলে! আমার বিস্ময় আর কাটে না!
মায়ের স্মার্টনেসের পরিচয় পেলাম তার সরলতার মধ্যে! কিভাবে যে সবরকম বিরূপ পরিস্থিতিতেই মাথা ঠান্ডা রাখে আমার রগচটা মা, আমি আসলেই বুঝি না! তার উদারতা দেখানোর না, বরং অনুভব করার! আশ্চর্য একটা মানুষ, যে সারাক্ষণ আমাকে বোঝায়, "মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষের মতো থাকবা।" আবার মনে প্রানে চায় আমার মতো থাকি যখন দুপুর বেলায়ও ঘুম থেকে না উঠলে আমাকে জ্বালায় না!
মা যে কতটা ইন্টেলেকচুয়াল বুঝলাম যখন একটা উড়োফোন আমার সারা পৃথিবী এলোমেলো করে দিলো...
আমি হয়তো এর ধকল কখনোই সামলাতে পারতাম না, যদি না আমার প্রাচীনপন্থী মা সবকিছুর পরেও আমাকেই না বিশ্বাস করতো...
আমিও আবারো বিস্মিত! মা আমাকে ধংস্বস্তূপ থেকে তুলে আনলো একটা ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকা চারাগাছের মতো! আমাকে ভালোবাসা দিয়ে বেড়ে উঠতে দিলো, মমত্ব দিয়ে সুরক্ষা দিলো....
আমার সাধারণ, রাগী, কালো, বোকামতো মা!
"মা, তুমি এত শক্তি কোথায় পাও?"
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১১ রাত ১১:০৯