২১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সাল। মধ্যদুপুর।
রিজওয়ান নামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের লাশ পাওয়া যায় রেল লাইনের পাশে। তার মাথায় ছিল গভীর একটা ক্ষত।
ধারণা করা হয় মাথায় আঘাত করে থাকে খুন করা হয়।
কিন্তু কেন ?
কোলকাতায় শহরের 'রিজওয়ান রহমান' আর 'প্রিয়াঙ্কা তদি'। হটাৎ পরিচয়। ভালোলাগা। ভালোবাসা । প্রেম।তারপর বিয়ে।
প্রিয়াঙ্কা একটা মাল্টিমিডিয়া সেন্টারে গ্রাফিক্সের স্টুডেন্ট, রিজওয়ান ছিল শিক্ষক। প্রিয়াঙ্কা তদি ধর্মে হিন্দু আর রিজওয়ান মুসলমান।প্রিয়াঙ্কার বাবা ‘আশোক তদি’ ভীষণ সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী একজন লোক।
ওরা লুকিয়ে বিয়ে করে ১৮ আগস্ট। বিয়ের পর ৩১ আগস্ট রিজওয়ান প্রিয়াঙ্কা কে তার বাড়িতে এনে তুলে। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মুসলিম ছেলেকে প্রিয়াঙ্কার প্রভাবশালী বাবা মেনে নেন নি । বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রিয়াঙ্কার বাবা। প্রিয়াঙ্কার জীবন থেকে সরে যেতে বলে বহুবার। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মুসলিম রিজওয়ান আর ধর্মে হিন্দু প্রিয়াঙ্কা বাবার কথার ধার ধারে না। প্রত্যাখ্যান করে। বিত্তের জোরে শিল্পপতির পরিবার রিজওয়ানুর-প্রিয়াংকার ঘর ভাঙ্গতে উঠে আদাজল খেয়ে লাগে।
এরপর থেকেই পুলিশ স্বয়ং হুমকি দিতে থাকে।ভয় দেখায়। মামলায় ফাঁসানোর কথা বলে।
৮ সেপ্টেম্বর রিজওয়ান কে ধরে হয় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এবং একটি পেপারে সাইন নেয়া হলো।
সেই পেপারে বলা ছিল , সাতদিনের জন্য প্রিয়াঙ্কা পরিবারের কাছে যাবেন। রিজওয়ান সাইন দিলো , বাধ্য ছিল সে।
১৫ সেপ্টেম্বর।পেপারসের কথা অনুযায়ী প্রিয়াঙ্কার ফিরে আসার কথা ছিল। রিজওয়ান অনেক চেষ্টা করে প্রিয়াঙ্কার সাথে যোগাযোগ করার জন্য , কথা বলার জন্য। রিজওয়ান ব্যার্থ হয়।
উল্টো তাকে প্রিয়াঙ্কার ফ্যামিলি থেকে বলা হয় তাকে তার জীবন থেকে সরে যেতে।
১৯ সেপ্টেম্বর। প্রিয়াঙ্কাকে আস্তে দেয়া হলো না। অসহায় রিজওয়ান তার স্ত্রীকে ফিরে পেতে একটা এনজিও’র সাথে যোগাযোগ করে এবং অন্যান্য অন্যান্য আইনি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছিল রিজওয়ান। এটা জানা যায় তার ডায়েরি থেকে। এগুলো কিছুই আর হয়ে উঠে নি।
কবীর সুমন 'রিজওয়ানুর বৃত্ত' নাম একটা অ্যালবাম বের করে ২০০৮ সালে। সেই অ্যালবাম এর একটা গান। যার শিরোনাম হচ্ছে "খুন হওয়া গান "।
রাস্তা আটকে দেব থেমে যাবে সব
লোকসংখ্যারা হবে বিশ্রী সরব
প্রাইভেট মিনি আর স্টেট বাস থেকে
টিটকিরি দেবে লোকে আমাদের দেখে।
সানগ্লাস পরা এক খাকি অফিসার
বেতারে জানাবে যেটা আছে জানাবার
স্কুটারে ব্যস্ত এক মিডিয়ার ছেলে
ভাববে এমন শট একবারই মেলে।
ভিখিরির ট্যাক থেকে পরে যাবে টাকা
পথ আটকানো প্রেমে মাধুকরী রাখা
ভিক্ষে কিসের বলো দাবিতেই জোর
দুজনে আটকে দেবো রাস্তার মোড়।
আমাদের আশ্লেষে আইন কামাল
ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট ভিজে বেসামাল
জিভের ভেতরে জিভ বোজা চোখে চোখ
আমাদের প্রেম ছুলো তার সপ্তক।
সাপাট তানের মতো আদরে আদরে
ট্র্যাফিক আইন ভেঙে দেবো প্রেম করে
প্রতি চুম্বনে আমি হবো রিজওয়ান
তুমিই প্রিয়াঙ্কা খুন হওয়া গান।
খুন হয়ে গেল গান আরো একবার
জানিয়ে দিলাম যেটা ছিলো জানাবার
আমার সময় আর আমার শহরে
কারা চুমু খাবে পথ অবরোধ করে।
অরিন্দম মান্না নামে এক তরুণ পুলিশ অফিসার, যিনি রিজওয়ানুরের মৃত্যু-সংক্রান্ত তদন্তে জড়িত ছিলেন, তাঁর মৃতদেহও রিজওয়ানুরের মতই রেল লাইনের ধারে পাওয়া গিয়েছিল। এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি…এতো ভুলে যাচ্ছি – বিশেষ করে নাম, স্থানকাল যে এই মুহূর্তে সন্দেহ হচ্ছে – সেই তরুণের নামটি ঠিক বলছি তো? সকলে আমার এই শারীরিক-মানসিক বৈকল্য ক্ষমা করে দেবেন। সেই তরুণ পুলিশ কর্মীর জন্য আমরা মোমবাতি নিয়ে নীরবে দাঁড়াইনি। তাঁর বাড়িতে কি কোনও নেতা গিয়েছিলেন? কারা? কিভাবে, কেন ঐ তরুণটি (পরে শুনেছি অপমৃত্যুর কিছুদিন আগেই তিনি বিয়ে করেছিলেন) খুন হলেন, কে বা কারা তাঁকে খুন করে রেল লাইনের ধারে ফেলে রেখে গেল – এই প্রশ্নগুলি কি করবেন না কেউ? তাঁর মা? তাঁর বাবা? তাঁর কোনও ভাইকে ভোটের প্রার্থী করা হয়েছে বলে তো শুনিনি। আমি নিজে? রিজওয়ানুরকে নিয়ে আমি এক গুচ্ছ গান বেঁধে, রেকর্ড করে আমার এক বান্ধবীর আর্থিক সহায়তায় সিডি হিসেবে প্রকাশ করেছিলাম। ‘রিজওয়ানুর বৃত্ত’। অরিন্দম মান্নাকে নিয়ে আমি একটি গানও বাঁধতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও আমি তাঁর সম্পর্কে কোনও খবরই জোগাড় করতে পারিনি। ----- কবীর সুমন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৯