রূপের ডালি খেলা - নামের শৈশবের একটা রাশিয়ান বইয়ের একটা গল্প - বীরব্রতী ভাসিয়া ! মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাশিয়ান বইগুলো বুকের মাঝখান থেকে আচমকা বের হয়ে আসতে চায় লেখায়। খুব ছোটবেলায় যখন আব্বা আমাকে বই পড়ে শোনাতেন , যখন আমি বানান করেও পড়তে পারতাম না , যখন আমি স্কুলেও যেতাম না -- তখন থেকেই রাশিয়ান বইগুলো আবার সাথেই আছে। তাই সেই 'ছোটমানুষের ' বইগুলোকে মাঝে মাঝে আমি শৈশবের স্কুল বলে ডাকি !
বীরব্রতী ভাসিয়া
বন্ধুরা ওকে বলতো জরদগব। তার ঢিলেঢালা , জবুথবু , ভ্যাবাচ্যাকা স্বভাবের জন্য।
ক্লাসে কোনো সাপ্তাহিক পরীক্ষার সময় কখনোই ওর সময়ে কুলাতো না, প্রশ্নটা মাথায় ঢুকতে ঢুকতে ঘন্টা পরে যেত।
চা খেতে বসলে তার টেবিলে পিরিচের চারপাশে জমতো চায়ের ডোবা।
চলতো এদিক ওদিক হেলে দুলে, নির্ঘাত ধাক্কা খেত টেবিলের কানায় , নয়তো উল্টে পড়তো চেয়ার।
নতুন জুতো হপ্তার মধ্যেই তুবড়ে যেত ওই পরে সে সেনাপতি সুভোরভের সঙ্গে আল্পস পর্বত পেরিয়েছে।
মুখের ভাব ঢুলুঢুলু , যেন এই মাত্র ঘুম ভাঙলো , নয়তো এখনই ঘুমিয়ে পড়বে।
সবকিছুই ওর খসে পড়তো হাত থেকে কিছুই উৎরাত না। এককথায় জরদগব।
গায়ে আঁট হয়ে আসতো কোট, প্যান্টে পা ঢুকতো কোনক্রমে।
মুটকো মুখের ওপর থলেথলে তিন থাকে-মাংস : দুটি চোখের ওপরে , ভুরুর গোড়ায় ,
তৃতীয়টি নাক আর ওপরের ঠোঁটের মাঝামাঝি।
যখন ও উত্তেজিত হয়ে উঠতো অথবা বাইরের হিম থেকে ফিরত , তখন থাকে গুলো লালা হয়ে উঠতো সবার আগে।
সবাই ভাবতো ওর স্থূলতার কারণ ওর পেটুকত্ব : নইলে অতো মোটা সে হলো কি থেকে ?
আসলে কিন্তু খেত সে খুবই কম। ভালো লাগতো না তার খেতে। ও কম্মটি সে সইতে পারতো না।
ও যে জরদগব সেটা লেখা ছিল ওর মুখে , জানানি দিতো তার শিথিল , এলিয়ে পড়া ভাবভঙ্গিতে , শোনা যেত চাপা-চাপা গলার স্বরে। অসুন্দর এই মোটা দেহের তলে কি লুকিয়ে ছিল সেটা কেউ জানতো না।
অথচ বুকের তলে ওর স্পন্দিত হত বীরব্রতীর মহানুভব হৃদয়। নিজের নিভৃত স্বপ্নে ও নিজেকে দেখতে পেত
ঝকমকে ইস্পাতের বর্ম পরা , পালক ওড়ানো শিরস্ত্রাণের মুখবরণ নামানো , চেপে আছে স্ফুরিত-নাসা শাদা ঘোড়ার পিঠে।
এই বেশে সে ছুটে বেড়াচ্ছে দুনিয়ায় , দুর্বল ও অন্যায়- পীড়িতদের রক্ষা করে অসংখ্য কীর্তি স্থাপন করছে।
ও হল নামহীন এক নাইট। কেননা নাইটদের সাধারণত থাকে গালভরা বিদেশী নাম --- রিচার্ড , রোদ্রিগো অথবা আইভ্যানগো।
আর ওকে ডাকে সবাই ভাসিয়া বলে , ওই নামটা মোটেই কোনো নাইটকে মানায় না।
স্বপ্নে তার ধুমসো বেঢপ চেহারা হয়ে ওঠে সুঠাম আর নম্র , গতিতে দেখা দে ক্ষিপ্রতা আর নৈপুণ্য।
ঝকমকে বর্মের তলে সব ত্রুটি ওর চাপা পড়ে যায় মুহূর্তে।
তবে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আবার সবই ফিরে আসতো স্বস্থানে। অপরূপ এক নাইটের বদলে সে সামনে দেখতে পেত জালার মত একটা ছেলে , গোল মুটকো মুখে তার লাল হয়ে উঠেছে থাক তিনটে।
নাইটের অযোগ্য চেহারা জন্য সে এ রকম সময় নিজেকেই ক্ষমা করতে পারতো না।
বিদ্রুপ-পরায়ণ আয়নাটা ছাড়াও তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতো তার মা। তার পদপাতে গেলাসগুলো করুন আর্তনাদ তুলেছে শুনতে পেয়ে মা রান্নঘর থেকে চেঁচাতো :
'' সাবধান ! একেবারে হাতি ঢুকেছে চিনামাটির দোকানে। ''
এমন কথা কি এক মহানুভব নাইটকে?
বন্ধুর কাছে তার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়েছিলো সে, কিন্তু কোনো সমর্থন পেলে না।
বর্মের কথা শুনতেই বন্ধু ঠোঁট বেকিয়ে বললে :
" অমন মোটা শরীর কোনো বর্মেই ঢুকবে না। ''
বন্ধু ভাবতেও পারে নি সে ভাসিয়ার একেবারে আঁতে ঘা দিয়েছে।
সময় পেলেই সে ছুটতো মিউজিয়ামে। বড়ো বড়ো হলে এখানে ভারী ভারী ফ্রেমে ছবি টাঙানো , কোণে কোণে হলুদ হয়ে আসা মর্মরের মূর্তি। মহাশিল্পীদের ক্যানভাস গুলো সে পেরিয়ে যেত নির্বিকার ভাবে, যেন সেগুলো বহু পরিচিত পোষ্টার মাত্র , চলে যেত তার স্বপ্নের ঘরটিতে। কোনো ছবি ছিলোনা এখানে। দেয়ালে টাঙানো তরোয়াল আর বর্শা, মেঝেয় দাঁড়িয়ে বর্মাবৃত সব নাইট-মূর্তি।
ডিউটি-রত বুড়িটাকে লুকিয়ে সে ছুঁয়ে দেখেছিলো বর্মের ইস্পাত , আঙুলে পরোক্ষ করেছিল তরোয়ালের ধার কেমন। কালো নাইটের কাছে থেকে সোনালী , সোনালী থেকে রুপোলী নাইটের কাছে সে চলে যেত সে আপন মনে। কতকগুলোর সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব , কারো প্রতি সংযত উদাসীনতা। মাথা নাড়তো সে তাদের দিকে , তারপর মনে মনে চলতো তাদের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। তার মনে হত, নামানো মুখবরণের ফাঁক দিয়ে নাইটরা তাকে চেয়ে দেখছে , কেউ থাকে ঠাট্টা করছে না , বলছে না সে জরদগব।
কেন যে ভুল হয় প্রকৃতির , ডন-কুইকজোটের গর্বিত প্রাণ টাকে সে দিয়ে বসে সাঞ্চো- প্যানসার মুটকো বেঢপ দেহে ?
বীরকীর্তির স্বপ্ন দেখতো সে , যোবন কিন্তু বয়ে চলল একঘেয়ে মামুলী খাতে।
রোজ সকালে ও অনিচ্ছায় বিছানা ছাড়তো , আর ' তাড়াতাড়ি কর , নইলে দেরি করে ফেলবি' --- মায়ের এই তাড়ায় প্যান্ট শার্ট চাপতো গায়ে।
তারপর মুখ ধুতে গিয়ে নাকটুকু ভেজাতো জলে --- ' এই তোর মুখ ধোয়ার ছিরি ?!'
--- এবং অনিচ্ছায় বসত টেবিলে। চামচ দিয়ে কিছু মোহনভোগ ঘেঁটে ---- 'খেতে এসে ঘুমতে হবে না! ' --- উঠে পড়তো এবং চলে যেত ইশকুলে। হুড়মুড়িয়ে নামতো সিঁড়ির ধাপ থেকে ধাপে , সবকটি ফ্ল্যাটের জানা থাকতো কে যাচ্ছে।
ক্লাসে সে পৌঁছত দ্বিতীয় ঘন্টার পর। বইয়ের ভারী ব্যাগটা ধপ করে ফেলে সেঁধত বেঞ্চিতে , ডেস্কটা ঠেলে সরিয়ে দিত সামনে।
এ সবই সে করত একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত এমন একটা লোকের নিরুদ্বেগ প্রশান্তি নিয়ে যে অপ্রত্যাশিতের কোনো আশাই রাখে না।
ক্লাসে সে গোলমাল করতো না , কেননা কথা বলা তার এমনিতেই আসে না, তাহলেও অবিরাম ধমক খেতে অসুবিধা হত না কোনো।
'রীবাকভ , মন তোর কোথায় , কি ভাবছিস ?'
'রীবাকভ , কি বললাম বল ?'
'রীবাকভ , বোর্ডে এসে অঙ্কটা বুঝিয়ে দে ?'
পা দিয়ে ডেস্কে ধাক্কা মেরে সে চলে যেত বোর্ডে , আঙুল দিয়ে খড়িটা চিপত অনেক্ষণ , যেন তা থেকে রস নিঙড়াতে চাইছে। অংকটা কষার সময় এমন হাঁস-ফাঁস করতো, যেন খড়ি নয় হাতে ওর একটা ভারী পাথর , ক্রমাগত সে ওটা ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। ভাবতে তার এতো সময় যেত আর কষ্ট হতো যে শিক্ষয়িত্রীর ধৈর্যে কুলাত না , ফেরত পাঠাত তার নিজের জায়গায়।
এসে বসত সে, মুহূর্তেই ডেস্কটা পরিণত হত এক জঙ্গী ঘোড়ায় , বেঁটে মোটা - মোটা আঙ্গুলগুলো
নিজেরাই এঁকে নিত তরোয়াল আর বর্ম।
ব্যায়ামের ক্লাসে ছিল সে সার্বজনীন উপহাসস্থল। ওর যখন বারে হাঁটার পালা আসত , আগে থেকেই হাসি শুরু হয়ে যেত ছেলেদের মধ্যে। বহু কষ্টে কয়েক পা গিয়ে সে ভারসাম্য হারিয়ে অসহায়ের মত বাতাস খামচে শেষ পর্যন্ত ধপাস করে ঝাঁপিয়ে পড়ত মেঝেয়। ভল্টিং হর্সও সে ডিঙিয়ে যেতে পারতো না , আটকে যেত তার কালো চামড়ায় বাঁধানো পিঠ। কিছুক্ষন সেখানেই সে বসে থাকত জীনে বসা সওয়ারের মত। হেসে উঠতো ছেলেরা আর আনাড়ীর মত পেটে ভোর দিয়ে নেমে গিয়ে ও দাঁড়াত তাদের লাইনে।
একেবারে কিছুই তার উৎরাত না। ইশকুলের অনুষ্ঠানে সে আবৃত্তি করে 'নীপার কে বললে মানুষ' কবিতাটা , তাতেও গোলমাল ঘটে যায়। গোটা হপ্তা ধরে সে কবিতাটা রপ্ত করে। বিশেষ করে শেষ ছত্রগুলো ওর বেশ হত। বুক ভোরে দম নিয়ে সে আবেগ ফুটিয়ে বলত :
'সরণিতে গৃহকোণে যেন
সন্ধ্যায় জ্বলে উঠে আলো। '
মঞ্চে এসে যখন সে দাঁড়াল, উবে গেলো সমস্ত 'আবেগ'। তাড়াতাড়ি করে শেষ ছত্রে পৌঁছবার চেষ্টা করলে সে। কিন্তু ঠিক শেষটাতেই সর্বনাশ হল। হঠাৎ নার্ভাস হয়ে কাঁধ নাচিয়ে সে বলে উঠল :
'সরণিতে গৃহকোণে যেন
সন্ধ্যায় নিভে যায় আলো। '
হেসে উঠল দর্শকেরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ধপ করে নেমে এল মঞ্চ থেকে।
ব্যর্থকামের ভাগ্যে সে অভ্যস্ত। ব্যর্থরা সাধারণত রাগ করে অন্যের ওপর , ওর রাগ হত ওর নিজের ওপরেই। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল স্বভাব বদলাবে , নতুন ভাবে চলবে। চেষ্টা করেছিল চটপট হাঁটবে , কথা কইবে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে , পেছিয়ে থাকবে না কারো কাছ থেকে। কিন্তু তাতে সুফল কিছু হল না। বাড়িতে পেয়ালা ভাঙতে লাগল , ক্লাসে উল্টে পড়তে লাগলো জালির দোয়াত , আর চটপটে হতে গিয়ে কোর্তাটা ফেটে গেল বগলের তলায়।
.... হেমন্ত আর শীতের মধ্যে সীমারেখা টানা মুশকিল। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় যে গাছের পাতা তখনো সব ঝরে যায় নি , অথচ মাটিতে পরে আছে প্রথম শীতের মৃদু তুষারকণা। মাঝে মাঝে রাতে খুব ঠান্ডা পরে যায়, সকালে দেখা যায় যদি ঢেকে গেছে বরফে। পাতলা আয়নার মত সে বরফ ছেলেদের হাতছানি দিয়ে ডাকে , মাইকে তখন হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে বরফের ওপর হাঁটা বিপজ্জনক।
কিন্তু সে হুঁশিয়ারি তো আর সব ছেলের কানে যায় না। তাই বরফের ওপর দেখা দেয় প্রথম একদল দুঃসাহসী। দেবে যায় বরফ , ভয়ঙ্কর সব ফাটল দেখা দেয় , আর ওরা ভাবে তাদের সবারই জন্ম খুব শুভলগ্নে। কিন্তু শুভলগ্নও তো মাঝে মাঝে ডোবায়।
নদী থেকে আসা একটা চিৎকার কানে এলো জরদগবের । দ্রুত পা চালিয়ে হাঁস-ফাঁস করে সে পৌঁছলো তীরে।
সেখানে সে দেখতে পেলে দিমকা কভালেভ হাত নেড়ে চেঁচাচ্চে :
' ডুবছে ! ডুবে যাচ্ছে !"
' কে ডুবছে ? একটুকু তাড়া না দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলে জরদগব।
' দেখতে পারছিস না?' খেকিয়ে উঠল দিমকা , ' বাচ্চাটা ডুবে যাচ্ছে। বরফ ভেঙে জলে পরে গেছে। দাঁড়িয়ে রইলি যে। ?'
অন্য কেউ হলে দিমকা কভালেভকেই বলতো , ' আর তুই নিজে যেতে পারছিস না ?'
কিন্তু ও যে জরদগব, তাই এ কথাটা ওর খেয়ালই হলো না। জমে যাওয়া নদীটার দিকে চাইলে সে , চোখে পড়ল প্রথম শ্রেণীর একটা বাচ্চা কোমর পর্যন্ত জলে ডোবা , কোনো রকমে বরফের কানাটা আঁকড়ে ধরে আছে হাত দিয়ে।
দিমকার চেয়ে জরদগব মোটা ও ভারী , তাহলেও সে এগিয়ে গেল বরফের ওপর দিয়ে। বরফের স্তরটা সামান্য দেবে গেল, কিন্তু ভাঙল না। তীরের কাছাকাছি স্তরটা নিশ্চয় অনেক শক্ত।
উত্তেজিত হয়ে উঠলো দিমকা কভালেভ। হাত নেড়ে ফের চেঁচাতে লাগলো :
' ডাইনে যা ! ... সাবধান ! অমন জোরে জোরে পা ফেলিস না , নইলে নিজেই ... '
চেঁচাচ্ছিলো সে নিজের ভয়টা চাপা দেয়ার জন্যে।
আর জরদগব এগিয়ে গেলো বরফের ওপর দিয়ে। চেঁচানি তার কানে যাচ্ছিল না। দেখছিলো সে কেবল মরণাধিক আতঙ্কিত বাচ্চাটাকে , মুখ দিয়ে যার একটা কোথাও সরছিল না।
কিনারের কাছাকাছি বরফ চাঙের ওপর জল জমেছে। সেখান পর্যন্ত গিয়ে সে এতোটুকু দ্বিধা না করে পা বাড়িয়ে দিলে।
সঙ্গে সঙ্গেই জুতো ভরে উঠলো জলে। মনের কোন গভীরে সে টের পাচ্ছিল।, এক্ষনি বরফ ভেঙে যেতে পারে , নীল হয়ে যাওয়া বাচ্চাটার সঙ্গে সেও গিয়ে পরবে জলে। কিন্তু তাতে সে থামলে না। দ্বিতীয় পা-টাও সে এগিয়ে আনলে , জল উঠলো গোড়ালি ছাপিয়ে।
এখন আর চেঁচাচ্ছিলো না কভালেভ , হাত নাড়ছিল না , টান-টান হয়ে অপেক্ষা করছিল কী হয়। দেখতে পাচ্ছিল বাচ্চাটার হাত ধরছে জরদগব , বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা উঠে এল বরফের ওপর। অবশ হাতে তার পরিত্রাতাকে আঁকড়ে ধরে আসছিলো সে। দাঁত ঠক-ঠক করছিলো। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিলো মুখ বেয়ে।
ওরা তীরে পৌঁছতে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো কভালেভ।
' বরফ জলে তোর পা একদম ভিজে গেছে ,' বললে সে বন্ধুকে , ' শিগগির ছুতে বাড়ি যা। বাচ্চাটাকে আমি পৌঁছে দেব। '
উদ্ধার-করা ছেলেটার দিকে চাইলে জরদগব , নিজের ভেজা জুতোর দিকে চেয়ে বললে :
'বেশ পৌঁছে দে !'
আতংকিত ভেজা বাচ্চাটাকে ধরে কভালেভ কোথায় তাকে নিয়ে গেলো।
বাড়িমুখো ফিরলো জরদগব। উত্তেজনা ওর দ্রুত চাপা পরে গেছে ক্লান্তিতে।
এখন আছে শুধু তার ভেজা পা আর হি- হি করা সমন্বয় কাঁপুনি।
বাড়ি ফিরে বহু কষ্টে জুতো খুলল সে। গলগলিয়ে জল বেরলো জুতো থেকে।
' এ আবার কী কান্ড?' ভেজা মেঝে দেখে জিজ্ঞেস করলো মা।
' পা ভিজে গিয়েছিল। ' টেনে টেনে সে জবাব দিলে।
' কোথায় এসব বাধাস বল তো?' বিরক্তিতে কাঁধ ঝাকিয়ে ন্যাতা আনতে গেলো মা।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল ঘটনাটা মাকে বলে , কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল তার , কেবলি হাই উঠছিল, গরম ঘরের মধ্যেও গায়ের কাঁপুনি যাচ্ছিল না। কিছুই বললে না সে, সোফায় শুয়ে চোখ বুঁজলে।
হঠাৎ তার মনে হল , গায়ে তার নাইটের ভারী বর্ম পরা থাকলে তো বরফটা তক্ষনি ভেঙে যেত, বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেত না।
চট করেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
পরের দিন দ্বিতীয় ঘন্টির পর ক্লাসে এসে কাউকেই সে সেখানে দেখতে পেল না। জানা গেল সবাই ওপরের বড়ো হলে গেছে পাইনিয়র জমায়েতে। ডেস্কে বইয়ের ব্যাগ ফেলে সে উঠলো চারতলায়।
হলে ঢুকে সে দেখলো সবাই দাঁড়িয়ে আছে লাইনবন্দী। ঠেলে- ঠুলে সে পেছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন কথা কইছিলেন ইশকুলের হেডমাস্টার। তিনি বললেন যে গতকাল প্রথম শ্রেণীর একটা ছেলে নদীতে বরফ ভেঙে পড়ে যায় , ছাত্র দিমকা কবালেভ তাকে বাঁচিয়েছে , ছাত্রের এই নির্ভীকতায় তিনি , হেডমাস্টার উচ্ছ্বাসিত বোধ করছেন।
তারপর বক্তৃতা দিলেন জ্যেষ্ঠা পাইওনিয়র পরিচালিকা। তিনি পাইওনিয়রের দায়িত্ব , লাল টাইয়ের কথা বলে জলে-পড়া বাচ্চাটার মায়ের চিঠি পড়ে শোনালেন, তাতে দিমকাকে তার ছেলের উদ্ধারকর্তা বলা হয়েছে।
চারদিক থেকে ছেলেপিলেদের চাপে জরদগব দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শুনে গেল সবাই তারিফ করছে দিমকা কভলেভের। একসময় তার ইচ্ছে হয়েছিল বলে যে , দিমকা মিথ্যে কথা বলছে , কাউকে সে বাঁচায় নি , শুধু হাত নেড়ে চেঁচিয়েছে।
কিন্তু তাতে সবার দৃষ্টি তার উপর পড়বে এই কথা ভাবতেই তার লজ্জা লাগল, লাল হয়ে উঠলো তার তিনটে থাক।
শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই বিশ্বাস হতে লাগলো যে দিমকাই গতকালকার ঘটনার নায়ক :
ডুবন্ত ছেলেটাকে ওই তো দেখেছিল প্রথম। আর সবাই যখন হাততালি দিলে দিমকাকে , জরদগবও তাতে যোগ দিলে।
জমায়েত শেষ হলো। হুকুম হলো যে-যার ক্লাসে যাবার। জরদগবও বন্ধুদের সাথে ঠেলাঠেলি করে ফিরে এল দোতলায়।
কষ্ট করে তার সীটে সিধঁলো সে , সরে গেলো ডেস্কটা , --- আর পড়া শুরু হতে সে তার মোটা-মোটা খাটো আঙুলে কলম ধরে নাইটের ছবি আঁকতে লাগল অঙ্কের খাতায়।
এ নাইট টা হলো বেগুনী রঙের , ইশকুলের কালি ওই রঙেরই।
--------------------------------------------------------------------------
'একেবারে কিছুই তার উৎরাত না।' - ঠিক যেন আমার মত।
'ব্যর্থকামের ভাগ্যে সে অভ্যস্ত। ব্যর্থরা সাধারণত রাগ করে অন্যের ওপর , ওর রাগ হত ওর নিজের ওপরেই।' -- আমিই নয় কি ?
এখন তো অনেক বড় হয়েছি। ছোটবেলার সেই 'জরদগব ' নিশ্চয় বড় হয়েছে।
আমি কিন্তু 'জরদগব ' রয়ে গেছি। শুধু অপেক্ষায় আছি 'ব্যর্থকামের ভাগ্যে অভ্যস্ত' আমি সত্যি সত্যিই 'বীরব্রতী ভাসিয়া ' হয়ে উঠবো একদিন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৫:১৪