somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহসী রাশিয়ান শৈশব : বীর ছেলে কলিয়া ( ১ম অংশ )

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে - ছোট্ট নাকটা ডগার দিকে উল্টানো , চোয়ালের হাড় দুটো উচু হয়ে উঠেছে , গায়ে কৃত্রিম পশমে – তৈরী লালচে কলারের খাটো ওভারকোট। ঠান্ডা স্তেপের শুকনো হাওয়ায় গোল বড়ি নাকটি তার লাল হয়ে উঠেছে । ফেটে যাওয়া নীল ঠোঁটদুটি হরদম কাঁপছে, তবে কালো ম্লান চোখদুটির পলকহীন ও কিছুটা কঠোর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে।
মনে হলো, যুদ্ধের আগুনে ঝলসানো বয়স্কদের বিরস পৃথিবীর দিকে – এই তের বছর বয়সী অসাধারণ অতিথিকে ঘিরে দাঁড়ানো ব্যাটালিয়ানটির কৌতুহল নৌসেনাদের প্রতি ছেলেটির কোন খেয়াল ই নেই। পায়ে যা পড়েছে ছেলেটি তা মোটেই আবহাওয়ার উপযোগী নয়: ধূসর ক্যাম্বিসের জুতো , তাদের ডগা গেছে ক্ষয়ে. যে নৌসেনাটি ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল সে স্থানীয় সদর - দপ্তরের একখানা চিঠি দিল ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেন যতক্ষন চিঠিখানা পড়লেন , ছেলেটি ততক্ষন ঘন ঘন পা বদলাতে থাকল।

‘- ওকে আটক করা হয়েছিল ভোরে – ওর কথা থেকে বোঝা গেল যে দু’সপ্তাহ ধরে ও ‘নভ পূত ’ রাষ্ট্রীয় খামার এলাকায় জার্মান সৈন্যদের চলাফেরা লক্ষ্য করছে – আপনার কাছে পাঠাচ্ছি – ব্যাটেলিয়নের পক্ষে মূল্যবান তথ্যাদি পেতে পারেন--'


চিঠিখানা ভাঁজ করে ক্যাপ্টন ওভারকোটের পকেটে রেখে দিলেন। তখনও শান্ত ও , অপেক্ষার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটি।



--কি নাম তোর ?
মাথা তুলে ছেলেটি সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার, গোড়ালিতে গোড়ালি মেলাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যাথায় মুখখানি কেঁপে উঠে বেঁকে গেল। ভয়ে ভয়ে সে তাকাল তার পায়ের দিকে, মাথাটি নুয়ে পড়লো।
-- কলিয়া _ কলিয়া ভিখরভ , কমরেড ক্যাপ্টেন , - বলে সে।
ক্যাপ্টেন তার পায়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটির ছেঁড়াখোঁড়া জুতো দেখে তারই কাঁপুনি ধরে গেল যেন।
--- তোর জুতোজোড়া কিন্তু শীতের নয় , কমরেড ভিখরভ। পা জমে যায় নি ?
--- একটু , --- লাজুক ও করুন সুরে কথাটা বলেই ছেলেটি আরও বেশি নুয়ে পড়লো।


সমস্ত শক্তি একত্র করে সে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করছিল। ক্যাপ্টেন ভাবলেন , এই জুতো পরে কি করে সে রাত সে হেঁটে এসেছে হিম –শীতল স্তেপের ওপর দিয়ে। নিজের অজ্ঞাতসারেই তিনি তার গরম উঁচু কানাওয়ালা বুটের ভেতর পায়ের আঙুলগুলি নাড়ালেন। ছেলেটির ঠান্ডায় নীল-হয়ে-যাওয়া গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি এবার নরম গলায় বললেন।
--- মন খারাপ করিস না। আমাদের এখানে জুতোর ফ্যাশনই আলাদা --- ' লেফটেন্যান্ট কবুজ।
নৌসেনাদের ভেতর থেকে ছোটোখাটো চেহারার এক হাসিখুশি লেফটেন্যান্ট বেরিয়ে এসে স্যালুট ঠুকে দাড়াল ক্যাপ্টেনের সামনে।
সবচেয়ে ছোট মাপের একজোড়া বুট শিগগির নিয়ে আসতে বলুন।


জোর কদমে কবুজ চলে গেল হুকুম তামিল করতে। ক্যাপ্টেন ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললেন :
-- চল আমার সঙ্গে। একটু গা গরুম করে নিয়ে আলাপ করা যাবে।
ক্যাপ্টেনের বাঙ্কারে চুল্লীতে ফটফট শব্দে জ্বলছে আগুন। একজন আর্দালি শিক দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে লাল টকটকে কাঠগুলো। দেয়ালে এখানে – ওখানে খেলছে লাল - লাল- গোলাপী আলোর আভা। ওভারকোটটি খুলে ড্রয়ারের কাছে খুলিয়ে রাখলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগল। সম্ভবত, মাটির তলায় এই সাদা ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল আরামের কামরাটি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে।
--- কোট খুলে ফেল, - বলেন ক্যাপ্টেন, -- আমার এখানে খুব গরম। গা’টা গরম করে নে।

ছেলেটি ওভারকোট খুলে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সযত্নে তা ঝুলিয়ে রাখলে ক্যাপ্টেনের কোটের ওপর। পোশাকের ওপর এতোটা যত্ন পছন্দ হল ক্যাপ্টেনের । ওভারকোট ছাড়তেই ছেলেটিকে ভারী রোগা-পটকা দেখাল। ক্যাপ্টেন বুঝলেন ও অনেকদিন ভালমতো খেতে পায় নি।

-- বোস। আগে কিছুটা খেয়ে নে , তারপর বাতচিত হবে। যা দেখছি , তোর পেটে কিছুই পরে নি , এভাবে চললে মরে যাবি . জানিস , বহুকাল আগে এক সেনাপতি ছিল। সে বলত , 'সেপাইকে খেতে দিলেই তার মনের নাগাল মেলে।' বুড়ো কিন্তু হক কথাই বলল। সেপাইয়ের পেট ভরা থাকলে সে জনা পাঁচেক ভূখা দুশমনকে পটকে দিতে পারে – 'কড়া চা চলবে ?'



পোড়া মাটির মত কাপ ভরে ক্যাপ্টেন কালো সুগন্ধি চা ঢেলে দিলেন ছেলেটিকে। ধীরে ধীরে একটুকরো রুটি কেটে তাতে আঙুলের সমান পুরু করে মাখন মাখলেন ও তার ওপর দিলেন মাংসের একটা টুকরো। এত বড় স্যান্ডউইচ দেখে প্রায় ভয় পেয়ে গেল ছেলেটি।
--ডরাস না , -- প্লেটখানা পর দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন ক্যাপ্টেন , -- চায়ে চিনি ঢাল।
তিনি টেবিলে ঠেলে দিলেন নীলাভ , চকচকে চিনির টুকরোয় ঠেসে –ভরা কার্তুজের ছয় ইঞ্চি একটি খোলা। ছেলেটি ভীত ও সতর্ক দৃষ্টিতে ক্যাপ্টনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটুকরো চিনি বেছে নিয়ে কাপের কাছে রাখল।

--- হা-হা-হা ! – হেসে ফেলেন ক্যাপ্টেন। --- এমন করলে চলবে না।
আমাদের এখানে , ভায়া , এমন করে চা খায় না কেউ . বন্দুকে ঠেশে বারুদ পড়তে হয়। আর তুই যা করছিস তাতে চায়েরই বারোটা বাজিয়ে দিবি।
এবার ক্যাপ্টেন ভারি একঢেলা চিনি ঢেলে দিলেন কাপে। ছেলেটির রোগ মুখখানা হটাৎ বিমর্ষ হয়ে উঠল , টেবিলের পড়লো বড়ো বড়ো কয়েক ফোঁটা চোখের জল। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাপ্টেন একটু এগিয়ে গিয়ে বসে ছেলেটির হাড্ডিসার কাঁধটি জড়িয়ে ধরেন।

--- ব্যস , ব্যস , হয়েছে ! – মিষ্টি গলায় সান্তনা দেন ক্যাপ্টেন . --- কান্নাকাটি রাখ ! যা হবার তা হয়েছে , এখানে কেউ তোর কিছু করতে পারবে না। জানিস , আমারও ঠিক তোর মতো এক ছেলে রয়েছে বাড়িতে। তার নাম ইউরা – এই যা ফারাক।
আর সবকিছু বিলকুল তোরই মতো – সেও ছুলিমুখ , আরও নাকটি বোতামের মতো ।



সামান্য লজ্জিত হয়ে ছেলেটি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলে।
--- আমার তো কিছুই হয় নি , কমরেড ক্যাপ্টেন … আমি নিজের জন্যে ভাবি না … হিম্মত আছে আমার। তবে কিনা মা’র কথা মনে পড়ল।
--আ -চ -ছা ? --- টেনে টেনে বলেন ক্যাপ্টেন , ---- মা বেচে আসেন ?
---হ্যাঁ , বেঁচে আছেন , --- ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠল। – তবে বাড়িতে খাবার নেই। রাত্তিরে মা জার্মানদের রান্নাঘরের কাছ থেকে আলুর খোসা কুড়িয়ে আনেন । একবার ওরা তাঁকে দেখে ফেলে। বন্দুকের কুঁ'দো বসিয়ে হাতে। এখনো মা হাত বাঁকাতে পারেন না।
ঠোঁটদুটি সে টিপে রাখল , চোখ থেকে সরে গেল শিশুর নমনীয়তা।
আর দৃষ্টিটা হয়ে রইল তীক্ষ্ণ ও কঠোর।ক্যাপ্টেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।




---------------------------------------------প্রথম অংশ শেষ----------------------------------------------------
সাহসী রাশিয়ান শৈশব : বীর ছেলে কলিয়া এর প্রথম অংশ এখানেই শেষ।পাঠকের মন্তব্য আর চাহিদার ভিত্তিতে পরের অংশ পোস্ট করা হবে।

অনুবাদঃ বিজয় পাল
ছবি এঁকেছেনঃ ইউ. ফমেঙ্কো


ছবিঃ https://sovietbooksinbengali.blogspot.com/ (রাশিয়ান শৈশবের সম্ভার!)



সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:২৩
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×