ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে - ছোট্ট নাকটা ডগার দিকে উল্টানো , চোয়ালের হাড় দুটো উচু হয়ে উঠেছে , গায়ে কৃত্রিম পশমে – তৈরী লালচে কলারের খাটো ওভারকোট। ঠান্ডা স্তেপের শুকনো হাওয়ায় গোল বড়ি নাকটি তার লাল হয়ে উঠেছে । ফেটে যাওয়া নীল ঠোঁটদুটি হরদম কাঁপছে, তবে কালো ম্লান চোখদুটির পলকহীন ও কিছুটা কঠোর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে।
মনে হলো, যুদ্ধের আগুনে ঝলসানো বয়স্কদের বিরস পৃথিবীর দিকে – এই তের বছর বয়সী অসাধারণ অতিথিকে ঘিরে দাঁড়ানো ব্যাটালিয়ানটির কৌতুহল নৌসেনাদের প্রতি ছেলেটির কোন খেয়াল ই নেই। পায়ে যা পড়েছে ছেলেটি তা মোটেই আবহাওয়ার উপযোগী নয়: ধূসর ক্যাম্বিসের জুতো , তাদের ডগা গেছে ক্ষয়ে. যে নৌসেনাটি ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল সে স্থানীয় সদর - দপ্তরের একখানা চিঠি দিল ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেন যতক্ষন চিঠিখানা পড়লেন , ছেলেটি ততক্ষন ঘন ঘন পা বদলাতে থাকল।
‘- ওকে আটক করা হয়েছিল ভোরে – ওর কথা থেকে বোঝা গেল যে দু’সপ্তাহ ধরে ও ‘নভ পূত ’ রাষ্ট্রীয় খামার এলাকায় জার্মান সৈন্যদের চলাফেরা লক্ষ্য করছে – আপনার কাছে পাঠাচ্ছি – ব্যাটেলিয়নের পক্ষে মূল্যবান তথ্যাদি পেতে পারেন--'
চিঠিখানা ভাঁজ করে ক্যাপ্টন ওভারকোটের পকেটে রেখে দিলেন। তখনও শান্ত ও , অপেক্ষার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটি।
--কি নাম তোর ?
মাথা তুলে ছেলেটি সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার, গোড়ালিতে গোড়ালি মেলাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যাথায় মুখখানি কেঁপে উঠে বেঁকে গেল। ভয়ে ভয়ে সে তাকাল তার পায়ের দিকে, মাথাটি নুয়ে পড়লো।
-- কলিয়া _ কলিয়া ভিখরভ , কমরেড ক্যাপ্টেন , - বলে সে।
ক্যাপ্টেন তার পায়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটির ছেঁড়াখোঁড়া জুতো দেখে তারই কাঁপুনি ধরে গেল যেন।
--- তোর জুতোজোড়া কিন্তু শীতের নয় , কমরেড ভিখরভ। পা জমে যায় নি ?
--- একটু , --- লাজুক ও করুন সুরে কথাটা বলেই ছেলেটি আরও বেশি নুয়ে পড়লো।
সমস্ত শক্তি একত্র করে সে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করছিল। ক্যাপ্টেন ভাবলেন , এই জুতো পরে কি করে সে রাত সে হেঁটে এসেছে হিম –শীতল স্তেপের ওপর দিয়ে। নিজের অজ্ঞাতসারেই তিনি তার গরম উঁচু কানাওয়ালা বুটের ভেতর পায়ের আঙুলগুলি নাড়ালেন। ছেলেটির ঠান্ডায় নীল-হয়ে-যাওয়া গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি এবার নরম গলায় বললেন।
--- মন খারাপ করিস না। আমাদের এখানে জুতোর ফ্যাশনই আলাদা --- ' লেফটেন্যান্ট কবুজ।
নৌসেনাদের ভেতর থেকে ছোটোখাটো চেহারার এক হাসিখুশি লেফটেন্যান্ট বেরিয়ে এসে স্যালুট ঠুকে দাড়াল ক্যাপ্টেনের সামনে।
সবচেয়ে ছোট মাপের একজোড়া বুট শিগগির নিয়ে আসতে বলুন।
জোর কদমে কবুজ চলে গেল হুকুম তামিল করতে। ক্যাপ্টেন ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললেন :
-- চল আমার সঙ্গে। একটু গা গরুম করে নিয়ে আলাপ করা যাবে।
ক্যাপ্টেনের বাঙ্কারে চুল্লীতে ফটফট শব্দে জ্বলছে আগুন। একজন আর্দালি শিক দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে লাল টকটকে কাঠগুলো। দেয়ালে এখানে – ওখানে খেলছে লাল - লাল- গোলাপী আলোর আভা। ওভারকোটটি খুলে ড্রয়ারের কাছে খুলিয়ে রাখলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগল। সম্ভবত, মাটির তলায় এই সাদা ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল আরামের কামরাটি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে।
--- কোট খুলে ফেল, - বলেন ক্যাপ্টেন, -- আমার এখানে খুব গরম। গা’টা গরম করে নে।
ছেলেটি ওভারকোট খুলে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সযত্নে তা ঝুলিয়ে রাখলে ক্যাপ্টেনের কোটের ওপর। পোশাকের ওপর এতোটা যত্ন পছন্দ হল ক্যাপ্টেনের । ওভারকোট ছাড়তেই ছেলেটিকে ভারী রোগা-পটকা দেখাল। ক্যাপ্টেন বুঝলেন ও অনেকদিন ভালমতো খেতে পায় নি।
-- বোস। আগে কিছুটা খেয়ে নে , তারপর বাতচিত হবে। যা দেখছি , তোর পেটে কিছুই পরে নি , এভাবে চললে মরে যাবি . জানিস , বহুকাল আগে এক সেনাপতি ছিল। সে বলত , 'সেপাইকে খেতে দিলেই তার মনের নাগাল মেলে।' বুড়ো কিন্তু হক কথাই বলল। সেপাইয়ের পেট ভরা থাকলে সে জনা পাঁচেক ভূখা দুশমনকে পটকে দিতে পারে – 'কড়া চা চলবে ?'
পোড়া মাটির মত কাপ ভরে ক্যাপ্টেন কালো সুগন্ধি চা ঢেলে দিলেন ছেলেটিকে। ধীরে ধীরে একটুকরো রুটি কেটে তাতে আঙুলের সমান পুরু করে মাখন মাখলেন ও তার ওপর দিলেন মাংসের একটা টুকরো। এত বড় স্যান্ডউইচ দেখে প্রায় ভয় পেয়ে গেল ছেলেটি।
--ডরাস না , -- প্লেটখানা পর দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন ক্যাপ্টেন , -- চায়ে চিনি ঢাল।
তিনি টেবিলে ঠেলে দিলেন নীলাভ , চকচকে চিনির টুকরোয় ঠেসে –ভরা কার্তুজের ছয় ইঞ্চি একটি খোলা। ছেলেটি ভীত ও সতর্ক দৃষ্টিতে ক্যাপ্টনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটুকরো চিনি বেছে নিয়ে কাপের কাছে রাখল।
--- হা-হা-হা ! – হেসে ফেলেন ক্যাপ্টেন। --- এমন করলে চলবে না।
আমাদের এখানে , ভায়া , এমন করে চা খায় না কেউ . বন্দুকে ঠেশে বারুদ পড়তে হয়। আর তুই যা করছিস তাতে চায়েরই বারোটা বাজিয়ে দিবি।
এবার ক্যাপ্টেন ভারি একঢেলা চিনি ঢেলে দিলেন কাপে। ছেলেটির রোগ মুখখানা হটাৎ বিমর্ষ হয়ে উঠল , টেবিলের পড়লো বড়ো বড়ো কয়েক ফোঁটা চোখের জল। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাপ্টেন একটু এগিয়ে গিয়ে বসে ছেলেটির হাড্ডিসার কাঁধটি জড়িয়ে ধরেন।
--- ব্যস , ব্যস , হয়েছে ! – মিষ্টি গলায় সান্তনা দেন ক্যাপ্টেন . --- কান্নাকাটি রাখ ! যা হবার তা হয়েছে , এখানে কেউ তোর কিছু করতে পারবে না। জানিস , আমারও ঠিক তোর মতো এক ছেলে রয়েছে বাড়িতে। তার নাম ইউরা – এই যা ফারাক।
আর সবকিছু বিলকুল তোরই মতো – সেও ছুলিমুখ , আরও নাকটি বোতামের মতো ।
সামান্য লজ্জিত হয়ে ছেলেটি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলে।
--- আমার তো কিছুই হয় নি , কমরেড ক্যাপ্টেন … আমি নিজের জন্যে ভাবি না … হিম্মত আছে আমার। তবে কিনা মা’র কথা মনে পড়ল।
--আ -চ -ছা ? --- টেনে টেনে বলেন ক্যাপ্টেন , ---- মা বেচে আসেন ?
---হ্যাঁ , বেঁচে আছেন , --- ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠল। – তবে বাড়িতে খাবার নেই। রাত্তিরে মা জার্মানদের রান্নাঘরের কাছ থেকে আলুর খোসা কুড়িয়ে আনেন । একবার ওরা তাঁকে দেখে ফেলে। বন্দুকের কুঁ'দো বসিয়ে হাতে। এখনো মা হাত বাঁকাতে পারেন না।
ঠোঁটদুটি সে টিপে রাখল , চোখ থেকে সরে গেল শিশুর নমনীয়তা।
আর দৃষ্টিটা হয়ে রইল তীক্ষ্ণ ও কঠোর।ক্যাপ্টেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
---------------------------------------------প্রথম অংশ শেষ----------------------------------------------------
সাহসী রাশিয়ান শৈশব : বীর ছেলে কলিয়া এর প্রথম অংশ এখানেই শেষ।পাঠকের মন্তব্য আর চাহিদার ভিত্তিতে পরের অংশ পোস্ট করা হবে।
অনুবাদঃ বিজয় পাল
ছবি এঁকেছেনঃ ইউ. ফমেঙ্কো
ছবিঃ https://sovietbooksinbengali.blogspot.com/ (রাশিয়ান শৈশবের সম্ভার!)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:২৩