সন্ধ্যায় হয়ে গেলো। আমাদের খেলার সময় শেষ। বড়জোর মাগরিবের আজান হওয়ার আগ পর্যন্ত। দাদা বলেছেন এই সময়ের মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে বাড়িতে ঢুকতে হবে হবে। বাড়ির বাইরেই আমাদের খেলার মাঠ। আমরা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরছি। এই ফেরার সময়টাই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আচমকা চোখ ভিজে উঠে। কলের পাড়ে জটলা। সবাই হৈচৈ করে মুখ হাত ধুচ্ছে। আমার মন খারাপ। আমি আমার ইমরান খান লেখা ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। পুবের আকাশ অন্ধকার হচ্ছে ক্রমশ। দিনের আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার। আরো একটা দিনের অবসান।
সেই ছোটবেলার মন খারাপের কারণটা আমি বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি। একটা দিন চলে যাওয়াটা কেন জানি আমাকে মন খারাপ করতো। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি স্মৃতি জমা করি। ফেলে আসে সবকিছুই যেন একেকটা স্মৃতি। আজটা কিছুক্ষন পরেই গতকাল হয়ে যাচ্ছে এতে মন খারাপের কি আছে ?
একদিন রাতে কেঁদে উঠলাম। ক্লাস টু/থ্রিতে তে পড়ি তখন। কেন কাঁদছি কাউকে বলতে পারছি না। কেউ থামাতে পারছে না। না আব্বা, না আম্মা , না বড়ফুফু !
আমাদের বাড়ির মাঝে উঠোন। চারপাশে আমাদের বাস। আমাদের ঘরের পাশেই কুল বরইয়ের গাছ। তার পাশে দাদার ঘর। আমার কান্নায় দাদা উতলা হলেন খুব। তিনি হাঁটা হাঁটি করতে পারেন না তেমন। জানলা কাছে বসে থাকেন। উঠোনে আমার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমার কান্না থামছেন না।
দাদা , বললেন আমার কাছে নিয়ে আসো !
আমাকে দাদার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। দাদা আমার মাথায় দুআ পড়ে ফু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন , কি হয়ে হয়েছে ?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম , আমি যদি মারা যায় তবে বাড়ির সবাই কি করবে? পুকুরপাড়ের কি হবে ? মাছ ধরে কে ? আমার গল্পের বই ?
কাঁদতে কাঁদতে এটুকুই বলতে পারলাম। তার আগেই ধমক দিলেন দাদা। জীবনে শুধু একবারই ধমক দিয়েছিলেন বোধহয়।
সেই রাতে ভাবনা এখনো হয়। বয়স বেড়েছে শুধু, ভাবনা বদলায় নি। রাতে চোখ ভেজে এখনো। জীবনে সব কিছুই একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। শৈশব হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে। ইমরান খান ব্যাট , পুটি মাছ ধরা ছিপ , পুকুরের ধারে জামগাছ , ঈদের চাঁদ , সোভিয়েত বইয়ে আমার লেখা অক্ষর গুলো।
গতরাতে ছেলেটা কেদেঁ ঘুম থেকে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বমি। এরপর আর ঘুমায় না। পিঠে হাত বুলিয়ে শুরশুরি দিলে আমি আরাম পেতাম , একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। আমার ছেলেটা তেমন আরাম পায়না হয়তো। হাত সরিয়ে দেয়। কিন্তু রাতে পিঠে হাত দেয়াতে চুপ করে আদর নিলো। থেমে গেলে ইশারায় আমার দিতে বলল। আমিও সযত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি , ও আরাম নিচ্ছে।
ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে চোখটা ভিজে উঠলো।
" আমাদের খড়ের চালের ঘরে শুয়ে আছি। বেশ রাত। রেডিওতে বাংলা নাটক চলছে। আমি ঘুমাইনি। চুপ করে আছি। নাটকের ভয়ঙ্কর সাইকো জ্যাক দ্য রিপারের ভয়ে আমিও ভীত। আব্বা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসলেও কেন জানি ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। "
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৬