somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রতিদিন একটা করে গল্প হতে পারতো.......

১৫ ই জুলাই, ২০২৩ ভোর ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঈদের নামাজ গুলো দাদা পড়াতেন।
আমাদের বৈঠকখানায় অনেক মানুষ আসতো। দাদা অসুস্থ হবার কারণে আমরা ঈদগাহতে নামাজ পড়া শুরু করি।

ঈদগাহতে আমার প্রথম ঈদের নামাজ।আমি কাতারে আব্বার পাশে দাঁড়িয়ে। কাতার সোজা করা হবে। মাইকে বললো , "বাচ্চাদের পিছে দেন। বাচ্চাদের পিছে দেন।"
আমি তো ছোট। বাচ্চাই বলা চলে। আমি কাঁদো কাঁদো চোখে আব্বার দিকে তাকালাম।
আব্বা বললেন, কোথাও যেতে হবে না।
অনেক বাচ্চারা পিছের কাতারে চলে গেল কিন্তু আমি আব্বার পাশেই ছিলাম।

ছোট বাচ্চারা জুম্মার নামাজ পড়তে যায়। মসজিদে হৈচৈ করে। নামাজের সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে।
কোনদিন পাড়ার মুরুব্বীদের বুঝিয়ে বলতে শুনিনি। হুংকার দিয়েছে শুধু। ঠিক এমন যেন, বাপ মা মসজিদে নামাজ পড়তে পাঠিয়ে পাপ করেছে।

সেই হুংকার শুনতে শুনতে বাচ্চারা একদিন মসজিদে পা দেয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। এমন অনেক আছে আমার পরিচিত। নামাজ ধর্ম নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তাদের মনে।



বেশ কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখছিলাম। নামাজরত একটা বাচ্চাকে পা দিয়ে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিতে। যিনি সরিয়ে দিলেন তাঁকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী বলেই মনে হলো।
তাৎক্ষণিক আমার মনে হলো, ছোটবেলায় কি তাঁর সাথে এমন আচরণ ই করা হয়েছিল?
কিভাবে সম্ভব এটা। ঐ লোকটার নিশ্চয়ই বাচ্চা আছে। আজান হলে নিশ্চয়ই মায়ের পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ে। ঐ বাচ্চাকে তিনি আদর করেন? চুমু খান?

একবার রাসুল (সাঃ) তাঁর নাতি হাসান (রা.)-কে চুমু খেলেন। সে সময় তার কাছে আকরা বিন হারেস উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি দশ সন্তানের জনক। কিন্তু আমি কখনও তাদের আদর করে চুমু খাইনি। তখন মহানবী (সাঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না’।


না, এটা কোন ধর্মীয় পোষ্ট না। ধর্ম কেন কোন কিছুই আর লিখতে ইচ্ছা হয় না। হাজার হাজার শব্দ ছন্দ খুঁজে ফেরে। বাক্যগুলো সংগঠিত হয়ে একেকর পর এক লাইন জোড়া দিতে পারতো। না, কোনটাই আর তেমন ইচ্ছা হয় না।
সব কিছু যেন স্থবির হয়ে আছে। বুকের একপাশে চাপ ধরে থাকে।


আমি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসি। খুউউব। আমার বাচ্চাটা যখন যখন অন্য ছেলেদের সাথে খেলতে থাকে, জোড়ে দৌড়াতে গেলেই বলে উঠি.. "নিহাল জোরে দৌড়াবা না। তোমার জোরে দৌড়ানো নিষেধ।"
ও চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার বুকটা ফেটে আসে তখন। ওর শেষ টেস্টের রিপোর্ট ভালো আসেনি। ভাল্ব আরেকটু ন্যারো হয়েছে। আরেকটা ভাল্বে একটু সমস্যা ধরা পড়েছে। ওর এখন যা পরিস্থিতি তাতে এই মুহূর্তের সে কেন শারীরিক জটিলতা অনুভব করে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভাল্ব আরো ন্যারো হতে থাকবে। বেলুন সার্জারি নামক প্রক্রিয়ায় সরু ভাল্বটা প্রসারিত করা যেত কিন্ত সেই ভাল্বে লিকেজের কারণে সেটা আর সম্ভব নয়। যদিও সেটা স্থায়ী সমাধান নয়। আবার ছয় মাস পরে টেস্ট। ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করবেন। শেষ মেষ সার্জারী ছাড়া উপায় নেই। কতদিন পর সার্জারী লাগে ঠিক নাই। ডাক্তার বলছে পাঁচ বছর। ও তো ছোট। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স।
ওকে নিয়ে প্রতিদিন একটা করে গল্প হতে পারতো। প্রতিদিন একটা করে গল্প তৈরী হয় ঠিকই। আমি লিখি না। লিখতে ইচ্ছা হয় না। ছবিও আর দেই না। ফেসবুক ছেড়েছি। কোথাও তেমন আর মন বসে না।




ছোটবেলায় যখন বৃষ্টি হতো তখন আমাদের খড়ের ঘরের চালা বেয়ে লাল পানি পড়তো। খড় ভেজা পানি। আমরা বলতাম 'লাল চা'।

জানালা খুললেই দাদার ঘর দেখা যেতো। দাদা জানালায় বসে থাকতেন, দাদা কে দেখা যেতো। দাদা কি খেতেন তাও দেখা যেতো। দাদার কাছে যারা আসতো তারা দাদার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। দাদা সব কিছু ডেকে দিতেন।
একদিন উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি দাদা কি যেন মুখে পুরে দিলেন। আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হলো দাদা আমাকে না দিয়ে কিছু খাবেন। চোখ ভিজে উঠলো ভীষণ অভিমানে। লিচুতলায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছলাম। ঘরে গিয়ে দেখলাম টেবিলের উপরে সরপোশে ঢাকা 'খাজা'।
না, দাদা আমার কথা ভোলেন নি। মনে হলো খাজাটা গোপন কুঠুরীতে রেখে দেই। সংরক্ষিত থাকুক।


আব্বা বাড়িতে চলে গেছেন। অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ইম্প্রুভ করার তেমন কোন আশা নেই। নিজের বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবেন।গত রোজার ঈদের পর বাড়ি গিয়েছিলেন। কয়েকদিন ছেলেটা দাদাকে কাছে পেল। ওর দাদা কাঁপা হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। দেখলাম ছেলেটার চোখ ছলছল করছে। ফিরে আসতে আসতে আমাকে বললো, "দাদার হাত 'ছোট বেবি'!"
ঠিকই তো , ছোট বেবিদের হাতে শক্তি থাকে না। দাদারো আর শক্তি নাই।

আমার আব্বার বয়স হয়েছে। অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। করোনাকালীন সময়ে বাড়িতে বসে ছিলাম। দুইবছর চাকুরী ছিলো না। বাবা যে কি জিনিস সেটা বুঝেছিলাম। শৈশবের বাবা আর এখনকার বাবা আমার কাছে একই মনে হয়েছে। শুধু পার্থক্যটা বয়সে।

করোনাকালীন সময়ে দিনের পুরোটা সময় ছেলেটা আমাকে পেয়েছিল। সকাল বেলা হাঁটতে বের হতাম কোলে নিয়ে। হাঁটাও শিখলো আমার হাত ধরে। যখন ও দৌড়তে শিখলো তখনো ওর অসুখটা ধরা পড়েনি। পুরো বাড়ি, পুকুর পাড়, মাঠ দৌড়ে বেড়াতো। কোন সমস্যাই হয়নি। আর এখন তো আর দৌড়াতেই দিই না।

এখন আর আগের মত সময় দিতে পারি না। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরি। রাতে কোলে নিয়ে হাঁটতে বের হোই। ফাঁকা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে বলি-
নিহাল দৌড়াবি।
ও বলে হ্যাঁ।
আমি বলি- বেশি জোড়ে দৌড়াবি না যেন।
ও বেশি জোড়ে দৌড়ায় না।

কিন্তু এমনটা আমি কখনোই কল্পনা করিনি। এতোকাল ভেবে এসেছি ও দৌড়াবে আর আমি ওকে ধরতেই পারবো না। দৌড়াতে দৌড়াতে থামবে, থেমে আবার বলবে- বাবা ধরো তো। তখন আমি আবার পিছু পিছু দৌড়াবো।
নাহ, এমন কিছুই হয়নি।

রাতের পর রাত ঘুম হয়না। ড্রয়িং রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। মাঝে মাঝে আমাকে পাশে না পেয়ে ছেলেটা কেঁদে ওঠে। আমাকে আবার বেডরুমে আসতে হয়। আমাকে ডেকে বলে বাবা তুমি এখানে ঘুমাও। আমি আবার ওর পাশে শুয়ে পড়ি। ছেলেটা নিশ্চিতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুম আসেনা।

কিছুই আর ভালো লাগে না। বুকের বামপাশে চাপটা দিনকে দিন বাড়তে থাকে। আচমকা চোখ ঝাপসা লাগে। ভীষণ অসহায় একজন বাবা মনে হয় নিজেকে। কিছু ভালো না লাগলে আকাশের দিকে তাকাই। বারবার তাকাই। তিনি নিশ্চয়ই আমার বারবার আকাশের দিকে তাকানোটা লক্ষ্য করেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২৩ ভোর ৫:১৭
১৮টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×