somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নরসুন্দর মদন দাস

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা শিশু গাছ । তার নিচে একটা চেয়ার আর চেয়ারটার সাথে একটা বড় কাপড়ের ছাতা বাধা । ছাতাটা ফোটানো আছে । চেয়ারটা শিশু গাছের দিকে মুখ করে রাখা । আর তার সামনে শিশুগাছটাতে কতগুলো পেরেক ঢুকানো । একটা বড়ো সড়ো পেরেকে ঝুলছে একটা বড়
আয়না আর একটা তক্তা ঝুলানো আছে , তক্তার উপরে রাখা জিনিসগুলো দেখে সহজেই অনুমান
করে নেওয়া যায় এটা একটা সেলুন । আর অন্যান্য পেরক গুলাতে , একটা লেমোনেটিং করা সার্টিফিকেট , এবং কিছু পেপার কাটিং , সেগুলাও লেমোনেটিং করা ।

চেয়ারটিতে বসে ঝিমুচ্ছে একটা ষাট সত্তর বছরের বুড়ো । ফাকা জায়গা পেয়ে চারিদিক থেকে মশা গুলো তাকে আচ্ছা মত জাপটে ধরছে । তাই মদন দাসের ঘুমটা আর এ দুপুরে হল না । "একটু
হাটা হাটি করা দরকার । বসে থাকতে থাকতে হাত পা বড্ড ধরে গেছে ।" ভাবতে ভাবতে চেয়ার
থেকে উঠে দাড়ালেন ।
এমন সময় সেখানে একটা এভোন পাইলট সাইকেল চেপে বিশ বাইশ বছরের ছেলে উপস্থিত ।

: মদন কা চুল কাটো । দাড়িও সেভ করাবো । তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি ।

: ক্যানরে ছ্যামড়া ? এতো বেলা কনে ছিলি ? বেলা পড়ে গেলি মনে পড়ল ।

: মা কলো আজগেই বুনির বাড়ি যাওয়া লাগবে । নেও তাড়াতাড়ি

: বয় এনে চুপ করে ।

আর কেউ কোন কথা বাড়ালো না । মদন দাস নিজের মনে ছেলেটির চুল কাটতে থাকল । আর ছেলেটি তার সামনে ঝুলে থাকা লেমোনেটিং করা কাগজ গুলি পড়ার চেষ্টা করতে থাকলো । যতবারই সে আসে ততবারই
পড়ার চেষ্টা করে । কিন্তু
কাগজগুলো এতো পুরানো যে লেখাগুলো ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না । তবে কাগজের ছবি গুলো সে বারবার দেখে ঐ ছবিতে দেখা যাচ্ছে মদন দাসরে জেনারেল এ
জি ওসমানীর সাথে । এছাড়া আরো অনেক বড় বড় নেতার সাথে মদন দাসের ছবি । একটা ছবিতে শেখ মুজিব আছে । ঐটাতে অবশ্য মদন দাসকে সহজে কেউ খুজে পাবে না । তবে ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে সবার পিছনে হাসি মুখে মদন দাস । ছেলেটা হঠাত্ ভাবতে শুরু করল সে কখনও মদন কা -কে এই ভাবে হাসতে দেখেছে কিনা ? নাহ্ মনেই পড়ল না । তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে মদন কা -
কে এই ভাবে হাসতে দেখেনি ।
সব শেষে ছেলেটি চোখ ফেললো সার্টিফিকেটটার দিকে । সার্টিফিকেট পড়ে সে যা বুঝল তাতে তার মদন কা -কে আরো ভক্তি করতে ইচ্ছা হল । তার
মদন কা একজন মুক্তিযোদ্ধা । এই
সার্টিফিকেটটা তো তাই বলে । এটা মদন দাস মুক্তিযুদ্ধ করেছে তার সার্টিফিকেট ।

: নে ওঠ । হয়ে গেছে । চুল কাটা , দাড়ি সেভ করা সব হয়ে গেছে ।
ছেলেটি একবার আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখল । তারপর পকেট থেকে দশ টাকা বের করে মদন দাশের হাতে দিল । মদন দাশ টাকাটা একটা জর্দার কৌটায়
রাখল । তার আজ এতো বেলার পূজি দশ টাকা ।

ছেলেটি যাওয়ার সময় বলল "আচ্ছা মদন কা তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা , সরকারেরতে টাকা পয়সা পাও । তালি আবার
এতো কষ্ট করার দরকার কি ?"

"এক সময় পাতামরে ছ্যামড়া ।" মদন দাসের সহজ উত্তর ।

ছেলেটি আরো কিছু শোনার জন্য মদন দাশের দিকে চেয়ে রইল । তখন মদন দাশ বলল "এক সময়
পাতাম পরে সরকার বদলায় আর নতুন করে লিষ্ট হয় । নতুন লিষ্টি আমার নাম উঠিনি । তাই এহন কোন টাকা পাই না ।"

"তুমি ওগের এই সার্টিফিকেট দেখাওনি ?" গাছে ঝোলানো সার্টিফিকেট টা দেখিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেসা করল ।

"ওরে রাখ তোর সার্টিফিকেট , ওকে কোন কাজ হয় না ।" তাচ্ছিল্ল ভরে মদন দাস বলল ।

"ঐযে ইষ্টিশনে আইজু ফকির
বসে ভিক্ষে করে দেখিছিস ? ও আর আমি এক সাথে যুদ্ধ করিছি । ওতো এট্টা সর্টিফিকেট ও পায়নি ।"

"কও কি মদন কা ?" ছেলেটি আরো কি শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল । তার আগ্রহ দেখে মনে হল মুক্তিযুদ্ধের আর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনতে তার
ভাল লাগে ।
কিন্তু নিরাশ করে দিয়ে মদন দাস
তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল । তারও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে ভাল লাগে । কিন্তু কি হবে সে গল্প বলে ? সবাই গল্প শুনে শুধু আহা উঃহু করে । কিন্তু কেউ রাষ্ট্রের খাতায় তার আর আইজু ফকিরের মতো লোকেদের নাম তুলে দেয় না । কেউ তাদের ভাগ্যটা বদলে দেয় না ।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার সেই চেয়ারটাতে বসে পড়ল মদন দাস । তারপর তার ভাবনার জাল ছড়াতে ছড়াতে চলে গেল সেই '৭১ এর দিনগুলোতে । নিশিতপুরের ব্রীজটা সে একাই মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আর একবার শেষের দিকে তমুল যুদ্ধ বাধে হানাদার বাহিনীদের সাথে । সেই যুদ্ধে আইজু ফকিরের পায়ে গুলি লাগে । তারপর
চিকিত্সা করে তার পা কেটে ফেলাতে হয় । এখন সে স্টেশনে ভিক্ষে করে । যুদ্ধের সময় মারা যাও তার সহযোদ্ধাদের আর রাজাকারদের হাতে খুন হওয়া বাবার কথা ভাবতে ভাবতে মদন দাসের চোখের পাতাটা ভারী হয়ে আসে । নাহ সে বেশ ভাল আছে ,
তার মত এমন বহুত লোক আছে । কিন্তু সেই '৭১ এর রাজাকার গুলোকে কিছু করতে পারল না বলে আজও তার মন কাঁদে । টিভিতে যখন তাদের দেখায় তখন সে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় । আর তাদের এলাকার চেয়ারম্যান সামসু রাজাকার যখন তার
সামনে দিয়ে যায় তখন তার মুখে মদন দাসের থু ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ।
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মদন দাসের ভাবনায় আসে তার ছেলের কথা । ছেলেটা ঢাকায় আছে ।
একটা সেলুনে চাকরি করে সে ঢাকায় ।
ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । তারপর নরসুন্দর মদন দাস তার তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল । আজ তার আয় দশ টাকা ।
বাড়িতে বউ আর তার একটা আঠারো বছরের মেয়ে আছে ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×