একটা শিশু গাছ । তার নিচে একটা চেয়ার আর চেয়ারটার সাথে একটা বড় কাপড়ের ছাতা বাধা । ছাতাটা ফোটানো আছে । চেয়ারটা শিশু গাছের দিকে মুখ করে রাখা । আর তার সামনে শিশুগাছটাতে কতগুলো পেরেক ঢুকানো । একটা বড়ো সড়ো পেরেকে ঝুলছে একটা বড়
আয়না আর একটা তক্তা ঝুলানো আছে , তক্তার উপরে রাখা জিনিসগুলো দেখে সহজেই অনুমান
করে নেওয়া যায় এটা একটা সেলুন । আর অন্যান্য পেরক গুলাতে , একটা লেমোনেটিং করা সার্টিফিকেট , এবং কিছু পেপার কাটিং , সেগুলাও লেমোনেটিং করা ।
চেয়ারটিতে বসে ঝিমুচ্ছে একটা ষাট সত্তর বছরের বুড়ো । ফাকা জায়গা পেয়ে চারিদিক থেকে মশা গুলো তাকে আচ্ছা মত জাপটে ধরছে । তাই মদন দাসের ঘুমটা আর এ দুপুরে হল না । "একটু
হাটা হাটি করা দরকার । বসে থাকতে থাকতে হাত পা বড্ড ধরে গেছে ।" ভাবতে ভাবতে চেয়ার
থেকে উঠে দাড়ালেন ।
এমন সময় সেখানে একটা এভোন পাইলট সাইকেল চেপে বিশ বাইশ বছরের ছেলে উপস্থিত ।
: মদন কা চুল কাটো । দাড়িও সেভ করাবো । তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি ।
: ক্যানরে ছ্যামড়া ? এতো বেলা কনে ছিলি ? বেলা পড়ে গেলি মনে পড়ল ।
: মা কলো আজগেই বুনির বাড়ি যাওয়া লাগবে । নেও তাড়াতাড়ি
: বয় এনে চুপ করে ।
আর কেউ কোন কথা বাড়ালো না । মদন দাস নিজের মনে ছেলেটির চুল কাটতে থাকল । আর ছেলেটি তার সামনে ঝুলে থাকা লেমোনেটিং করা কাগজ গুলি পড়ার চেষ্টা করতে থাকলো । যতবারই সে আসে ততবারই
পড়ার চেষ্টা করে । কিন্তু
কাগজগুলো এতো পুরানো যে লেখাগুলো ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না । তবে কাগজের ছবি গুলো সে বারবার দেখে ঐ ছবিতে দেখা যাচ্ছে মদন দাসরে জেনারেল এ
জি ওসমানীর সাথে । এছাড়া আরো অনেক বড় বড় নেতার সাথে মদন দাসের ছবি । একটা ছবিতে শেখ মুজিব আছে । ঐটাতে অবশ্য মদন দাসকে সহজে কেউ খুজে পাবে না । তবে ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে সবার পিছনে হাসি মুখে মদন দাস । ছেলেটা হঠাত্ ভাবতে শুরু করল সে কখনও মদন কা -কে এই ভাবে হাসতে দেখেছে কিনা ? নাহ্ মনেই পড়ল না । তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে মদন কা -
কে এই ভাবে হাসতে দেখেনি ।
সব শেষে ছেলেটি চোখ ফেললো সার্টিফিকেটটার দিকে । সার্টিফিকেট পড়ে সে যা বুঝল তাতে তার মদন কা -কে আরো ভক্তি করতে ইচ্ছা হল । তার
মদন কা একজন মুক্তিযোদ্ধা । এই
সার্টিফিকেটটা তো তাই বলে । এটা মদন দাস মুক্তিযুদ্ধ করেছে তার সার্টিফিকেট ।
: নে ওঠ । হয়ে গেছে । চুল কাটা , দাড়ি সেভ করা সব হয়ে গেছে ।
ছেলেটি একবার আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখল । তারপর পকেট থেকে দশ টাকা বের করে মদন দাশের হাতে দিল । মদন দাশ টাকাটা একটা জর্দার কৌটায়
রাখল । তার আজ এতো বেলার পূজি দশ টাকা ।
ছেলেটি যাওয়ার সময় বলল "আচ্ছা মদন কা তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা , সরকারেরতে টাকা পয়সা পাও । তালি আবার
এতো কষ্ট করার দরকার কি ?"
"এক সময় পাতামরে ছ্যামড়া ।" মদন দাসের সহজ উত্তর ।
ছেলেটি আরো কিছু শোনার জন্য মদন দাশের দিকে চেয়ে রইল । তখন মদন দাশ বলল "এক সময়
পাতাম পরে সরকার বদলায় আর নতুন করে লিষ্ট হয় । নতুন লিষ্টি আমার নাম উঠিনি । তাই এহন কোন টাকা পাই না ।"
"তুমি ওগের এই সার্টিফিকেট দেখাওনি ?" গাছে ঝোলানো সার্টিফিকেট টা দেখিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেসা করল ।
"ওরে রাখ তোর সার্টিফিকেট , ওকে কোন কাজ হয় না ।" তাচ্ছিল্ল ভরে মদন দাস বলল ।
"ঐযে ইষ্টিশনে আইজু ফকির
বসে ভিক্ষে করে দেখিছিস ? ও আর আমি এক সাথে যুদ্ধ করিছি । ওতো এট্টা সর্টিফিকেট ও পায়নি ।"
"কও কি মদন কা ?" ছেলেটি আরো কি শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল । তার আগ্রহ দেখে মনে হল মুক্তিযুদ্ধের আর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনতে তার
ভাল লাগে ।
কিন্তু নিরাশ করে দিয়ে মদন দাস
তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল । তারও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে ভাল লাগে । কিন্তু কি হবে সে গল্প বলে ? সবাই গল্প শুনে শুধু আহা উঃহু করে । কিন্তু কেউ রাষ্ট্রের খাতায় তার আর আইজু ফকিরের মতো লোকেদের নাম তুলে দেয় না । কেউ তাদের ভাগ্যটা বদলে দেয় না ।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার সেই চেয়ারটাতে বসে পড়ল মদন দাস । তারপর তার ভাবনার জাল ছড়াতে ছড়াতে চলে গেল সেই '৭১ এর দিনগুলোতে । নিশিতপুরের ব্রীজটা সে একাই মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আর একবার শেষের দিকে তমুল যুদ্ধ বাধে হানাদার বাহিনীদের সাথে । সেই যুদ্ধে আইজু ফকিরের পায়ে গুলি লাগে । তারপর
চিকিত্সা করে তার পা কেটে ফেলাতে হয় । এখন সে স্টেশনে ভিক্ষে করে । যুদ্ধের সময় মারা যাও তার সহযোদ্ধাদের আর রাজাকারদের হাতে খুন হওয়া বাবার কথা ভাবতে ভাবতে মদন দাসের চোখের পাতাটা ভারী হয়ে আসে । নাহ সে বেশ ভাল আছে ,
তার মত এমন বহুত লোক আছে । কিন্তু সেই '৭১ এর রাজাকার গুলোকে কিছু করতে পারল না বলে আজও তার মন কাঁদে । টিভিতে যখন তাদের দেখায় তখন সে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় । আর তাদের এলাকার চেয়ারম্যান সামসু রাজাকার যখন তার
সামনে দিয়ে যায় তখন তার মুখে মদন দাসের থু ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ।
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মদন দাসের ভাবনায় আসে তার ছেলের কথা । ছেলেটা ঢাকায় আছে ।
একটা সেলুনে চাকরি করে সে ঢাকায় ।
ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । তারপর নরসুন্দর মদন দাস তার তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল । আজ তার আয় দশ টাকা ।
বাড়িতে বউ আর তার একটা আঠারো বছরের মেয়ে আছে ।