অনেক বড় শহর, সবকিছু যান্ত্রিক, সবাই ছুটে চলছে। একমাত্র আকাশ ছোয়া বাড়িগুলো বাদে।
ওগুলা স্থির। কারো সাথে কারো মনের সুখ দুঃখ বলার সময় নেই। ইস যদি বাড়িগুলো কথা বলতে পারত তাহলে মনের কথাগুলো একটু থির হয়ে ওদেরকে বলা যেত।
রাত ১২টা মতো হবে, রাস্তায় তেমন পায়ে চলা মানুষ নেই। সব গাড়িগুলো হর্ণ দিয়ে এক
একটা পাশ কাটিয়ে চলেছে। সবাই যেন এক একটাকে হারিয়ে দেওয়ার নেশাই নেমেছে। নরসুন্দর মদন দাসের ছেলে অভিজিত্ একটু আগে সেলুন
থেকে মেসে ফিরেছে। এখন ভাতের থালা নিয়ে টিভির সামনে বসেছে। টিভিতে খবর হচ্ছে।
"আরেব্বাস কাল হরতাল!" বিশ্বজিত্ কে আশ্চর্য মনে হলো।
"হুম জানিস না? আজ তো ফার্মগেটে একটা বাসে আগুন দিছে। আর শুনলাম বাড্ডাতে নাকি কয়েকটা গাড়ি ভাঙ্চুর করেছে।" জিতুর স্বাভাবিক উত্তর ।
এদের মাঝে আবার অতি উত্সাহি হয়ে আসিফ বলে উঠল "শুনলাম কয়েক জায়গায় নাকি ককটেলও
ফাটাইছে?"
"কালকের হরতালটা জোরদার হবে! আমাকে তো ডেকেছে , যেতেই হবে। শালা , কাল
বড়লোকগুলোর খবর আছে একটা গাড়িও আস্ত রাখব না রাস্তায়।" চিবিয়ে চিবিয়ে জিতু কথাগুলো বলল, ভাবটা এমন যে পারলে এখনই খাবে সে ঐ বড়লোকগুলোকে।
"কিন্তু কালতো আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।" বিশ্বজিত্ কে চিন্তিত দেখালো।
"কাল আবার তোর কি কাজ?" সন্দেহের চোখে আসিফ বিশ্বজিত্ কে দেখলো।
"না মানে, বোনের জন্য একটা জামা বানাতে দিয়েছিলাম ওটা আনতে যেতে হবে। পরশু বাড়ি যাবো, মায়ের হাতে পিঠে খাবো। শীতকাল চলে এসেছে আর মা ও
অনেক জোর করে বলল।" বলতে বলতে বিশ্বজিত্ এর চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
"তোর কি পরশু না গেলেই না!"
জিতুর আর্জি।
"নারে, মা সেদিন কাঁদছিল আমাকে দেখার জন্য যেতেই
হবে।" বিশ্বজিত্ দৃঢ় সে মাকে দেখতে পরশু যাবেই।
##
"একটু বেরোচ্ছি আসিফ দরজা লাগা। জিতু ফিরলে আমাকে ফোন দিস। ব্যাটা যে এই হরতালে কই
মারামারি করছে কে জানে! আমি গেলাম।"
বেরিয়ে যেতে যেতে আসিফকে বিশ্বজিত্ক থা গুলো বললো। সে তার বোনের জন্য একটা জামা বানাতে দিয়ে ছিল। আজ সেটা আনতে যাচ্ছে , কালও বাড়ি যাবে । মায়ের হাতে পিঠা খাবে। ভাজা কুলি পিঠা। ভাবতেই জিভেতে জল এসে যায়।
"সাবধানে যাস। আর কোথাও গন্ডোগোল দেখলে সটকে পড়বি। খবরদার পিকেটারদের একদম
মাড়াবি না।" আসিফ বিশ্বজিত্ কে সাবধান করে দিলো।
ফার্মগেট যাবে বিশ্বজিত্।ও থাকে মনিপুরী পাড়া। হেটে যাচ্ছে সে। ফার্মগেট পার্কের ভিতর
দিয়ে যাচ্ছে। যখনই পার্ক থেকে বের হল তখনই তার সামনে বাষ্ট হলো একটা ককটেল। আর সেখানে যত লোক ছিল সবাই যে ভাবে পারলো ছুটে পালালো।
তাদের সাথে বিশ্বজিত্ ও দোড়
দিয়ে একটা ক্লিনিকে দৌড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচালো।
বড্ড হাপিয়ে পড়েছে বিশ্বজিত্। এরই মধ্যে রাম দা, চাপাতি, ছুরি, হকিস্টিক হাতে কিছু ছেলে উপস্থিত। কোন কথা না বলেই একজন রাম দা দিয়ে দিলো কোপ।
"উঃ ভাই মারেন কেনো? আমি বিশ্বজিত্। একজন সাধারণ মানুষ।"
নাহ বিশ্বজিত্ এর কথা শোনার সময় ওদের নেই। ওরা ওদের কাজে ব্যাস্ত। বিশ্বজিত্ চেচিয়েই
যাচ্ছে । তার চিত্কারে সেখানে হাজির হয়েছে অনেক মানুষ । কেউ ছবি তুলছে , কেউ ভিডিও করছে । আর কেউ বা আহঃ উঃ করে সমবেদনা প্রকাশ করছে ।
কিন্তু কারো সাহস হল না সামনে এগিয়ে আসতে ।
আরো কিছু লোক হাজির হলো চাপাতি রামদা নিয়ে । তারাও যোগ দিলো আগের লোকগুলোর সাথে ।
বিশ্বজিত্ চিত্কার করেই যাচ্ছে...
"আমাকে মেরো না , প্লিজ ভাই প্লিজ তোমাদের পায়ে পড়ি । আমি কোন দল করি না , আমাকে দয়া কর ভাই । আমি একটা হিন্দু ছেলে । আমাকে মেরো না ।
আমাকে মেরো না আমি রাজনীতি করি না , আমাকে মেরো না ।"
তবুও তারা মেরে যাচ্ছে । তাদের কানে যেন ঢুকছে না কোন কথা । তারা মারতে মারতে বিশ্বজিত্
কে রাস্তা এনে ফেলে রেখে চলে গেলো । মিডিয়ার লোক জন তখনও ছবি তুলে যাচ্ছে , আর ভিডিও করে যাচ্ছে । লোকজন দেখে যাচ্ছে , কারো মুখে কোনো কথা নেই ।
##
আসিফ টিভির সামনে বসে আছে । মুখটা তার হা হয়ে আছে । একি দেখাচ্ছে টিভিতে ! এরা বিশ্বজিত্ কে মারছে কেনো ? এটা বিশ্বজিত্
তো ! না সন্দেহ একটা থেকেই যায় তারপরও । আসিফ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না । ও
সাথে সাথে বিশ্বজিত্ কে কল করলো ।
"একি ফোনের সুইচ অফ । একবার জিতুকে ফোন দেই সকাল থেকে ওরও কোন খোজ নাই" আসিফের মাথায় কিছু কাজ করছে না ।
জিতুকে ফোন দিবে এমন সময়
দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো জিতু । ওকে মন মরা লগছে ।
"কিরে ? এতো বেলা কই ছিলি ?
এদিকে টিভিতে দেখলাম বিশ্বজিত্ এর মত দেখতে একটা ছেলেকে কিছু লোক কোপাচ্ছে ।" আসিফ
কথাগুলো বলে জিতুকে দেখতে লাগল ।
জিতু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না , সে কেঁদে ফেলল "ওরা এক একটা পিশাচ ওরা মেরে ফেলেছে বিশ্বজিত্ কে , মেরে ফেলেছে ।"
জিতূ কেঁদেই চলেছে , আসিফ কাঁদতে পারছে না । ওর চারিদিকটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে , কে যেন ওকে চেপে ধরে বসে আছে । ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না । ওতোগুলো লোক , ওতোগুলো লোকের সামনে ছেলেটাকে মারল । আর কেউ কিছু বলল না । মিডিয়ার লোক ছবির পর ছবি ভিডিও করে গেল । কারো কোন মানবতা নেই ?
ছিঃ
##
এম্বুলেন্সটা সাঁই করে ছুটে চলছে নিশিতপুর গ্রামের দিকে। ঐ গ্রামে একটা মা আর একটা বোন
ঢেকিতে নতুন চাল কুটছে। আজ বাড়ির ছেলে ঘরে ফিরবে। নরসুন্দর মদন দাসও আজ আর
দোকান খোলেনি। বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে , এই ছেলে এলো বলে, এই এলো বলে। মনে ভিতর কেমন একটা খচ খচ করছে। কেমন যেন!
পিছনের সিটে জিতু আর আসিফ বসে আছে, ড্রাইভার এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। আর বিশ্বজিত্ সাদা কাপড় দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে যেন কেউ ওকে না দেখতে পায়। তারপর বাড়ি গিয়ে সবাইকে চমকে দেবে। মারামারির জন্য
বোনের জামাটা নেওয়া হয়নি।
বিশ্বজিত্ অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছে এই শীতে মায়ের হাতে ভাজা কুলি পিঠা খাবে তাই।
মার তার নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে। সে এই সাদা কাপড় পেচিয়ে বাড়িতে ঢুকে সবাইকে চমকে দেবে।
অ্যাম্বুলেন্স নরসুন্দর মদন দাসের বাড়ির সামনে দাড়াতেই গ্রামের সবাই উত্সুক হয়ে মদন দাসের উঠানে জড় হলো। কে এলো , এদের বাড়ি!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৩ রাত ২:৩৪