সাম্প্রতিক সময়ে মুরগি বসন্ত নামক এক অতিশয় বিরক্তি উদ্রেক কারী এক রোগের সহিত অশান্তিময় সহবস্থান চলিতেছে। অদ্যাবধি সহাবস্থানের ইতি না ঘটিলেও আমি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া উপস্থিত বলিয়া বোধ করিতেছি। তবে স্বীয় বিজয়ের আনন্দ যতটা না প্রতিপক্ষকে দমনের তাহার চেয়ে অধিক মুক্তিলাভের। ক্ষুদ্র মুরগি বসন্ত আমাদিগকে শারীরিকভাবে যেইপ্রকারে হেনস্থা করিয়া থাকে তাহা সমন্ধে অনেকেই অবগত আছেন বলিয়া মনে করি। তবে ইতোপূর্বে গুটিকা বসন্ত নামক এক ভয়াবহ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব বর্তমান বঙ্গদেশ অঞ্চলে পরিলক্ষিত হইত যাহার সৃষ্টিকারী জীবাণু বিশেষ বর্তমানে গবেষণাগার ব্যাতিত অনত্র অদৃশ্য। পূর্বপুরুষ এবং বয়োজ্যেষ্ঠগণের নিকট হইতে শুনিয়া এবং তৎকালীন সাহিত্য হইতে লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী মনে হয় আমরা দুর্ভাগা নয় বরং চকচক করিতে থাকা কপাল সহযোগে জন্মগ্রহন করা মানবশিশুদের দলে যাহারা গুটিকা বসন্তের ন্যায় ব্যামোতে আক্রান্ত হওয়া দূরে থাকুক বরং চর্মচক্ষুগোলকে উহা অবলোকন করার মত দুর্ভাগ্য প্রাপ্ত হয় নাই। শুনিয়াছি গুটিকা বসন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিদিগকে মানব বসতি অঞ্চল হইতে দূরবর্তী কোন জনমানবশূন্য কোন জঙ্গল বা ধূধূ প্রান্তরে সকল পানাহার ব্যাতিরেকে বা স্বল্প পানাহার সহযোগে রাখিয়া আসা হইত। অধিকাংশের ভাগ্যে রোগেভোগে যমালয়ে গমন অবশ্যম্ভাবী ছিল। রোগ হইতে রক্ষা পাইলেও আহার বিহিন শীর্ণ তনু লইয়া তাহারা লোকালয়ে ফিরিয়া স্বাভাবিক যাপিত জীবনে ফিরিয়া যাবার সৌভাগ্য অর্জন করিতে সক্ষম হইত না। আলোচ্য সময়ে বঙ্গদেশে প্রচুর শকুন দেখা যাইত তাহার অন্যতম কারন এইসকল পতিত মানব সন্তান হইলেও হইতে পারে। আর যে কয়জন ব্যক্তি দেশি কই মাছের প্রান লইয়া সকল বাধা পার করিয়া ফিরিয়া আসিত তাহারা বাকি জীবন সর্বাঙ্গে গুটিকা বসন্তের চিহ্ন বহন করিত যাহাদের চর্ম নাকি শুধু কোদাল কর্ষিত মৃত্তিকার সাথে তুলনীয়। ঈদৃশ দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিলে আমি ভাগ্যবানই বটে যে গুটিকা বসন্ত নয় আমি মুরগি বসন্তে আক্রান্ত হইয়া কতিপয় দিন স্বেচ্ছা শয্যাশায়ী ছিলাম।
তবে রোগাক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী হওয়া ইতি নেতি উভয়বাচক দিক হইতে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। চিরন্তন বঙ্গ সংস্কৃতি হইতে বিচ্যুত না হইয়া সকল রক্ত সম্পর্কিত, পরিচয় সূত্রে, কিংবা স্থান বিশেষে সম্পূর্ণরূপে অসম্পর্কিত ব্যক্তিরাও রোগী দেখিতে যাওয়া পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গন্য করিয়া হাজির হন। দর্শনার্থী দের কৌতূহল নিবৃত্ত করিবার নিমিত্তে রোগী সাজিয়া কোকাইয়া কোকাইয়া সকল প্রশ্নের যথাযত উত্তর দেওয়াও সংস্কৃতির অংশ বলিয়া বিবেচিত হইয়া আসিয়াছে যুয যুগ ধরিয়া। ইহার ব্যাত্যয় আমার ন্যায় ক্ষুদ্র মানব সন্তানও করিতে পারে নাই।
সংস্কৃতির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হইল স্বহস্তে রোগীর বা রোগীর পারিবারিক সদস্যের নিকট খাদ্যদ্রব্যের থলিটি হস্তান্তর করা। রোগীর হাতে হস্তান্তর করাই অধিক মর্যাদা পূর্ণ। তবে দুরভাগ্যক্রমে সেই সৌভাগ্য সকলের পদতলে লুটায় না। রোগীর পরিবারও নিতান্ত সাধারন নহে। তাহারাও সচারাচর ততোধিক সংস্কৃতিমনা হয়ে থাকেন যাহার অংশ হিসাবে খাদ্যের একটি অংশ দিয়া দর্শনার্থীদের আপ্যায়ন করা হইয়া থাকে। ইহাও সংস্কৃতির অংশ বলিয়া বিবেচিত। তবে এইরূপ খাদ্যদ্রব্যের থলি আদান প্রদান আমার নিকট রোগীর প্রতি একপ্রকার প্রহসন বলিয়া প্রতীয়মান হয়। শারীরিক দুর্বলতা হেতু যেহেতু রোগী সকল খাদ্য গ্রহণে অপারগ অতএব অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্য রোগীর পরিবার ও স্বজনদের উদরপূর্তিতে ব্যয়িত হয়। বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের ঈদৃশ ঘনঘটায় পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের মুখে ঈদ বা পার্বণ কালীন হাসির আভাস দৃশ্যমান হয়। এইরূপ কনিষ্ঠ সদস্য হইবার বিমলানন্দ আমিও বহুবার ভোগ করিয়াছি। তবে এইবার পাশার গুটি উলটাইয়া গিয়াছে।
রোগ সংস্কৃতির আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হইল বিনামূল্যের উপদেশমালা। কেহ কেহ উপদেশ এর পরিবর্তে পরামর্শ শব্দ চয়ন করিবার কথা বলিতে পারেন। তবে উপদেশই শ্রেয়তর। এই উপদেশ দিবার জন্য কোন বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। আপনি যদি কোনকালে কোন রোগে আক্রান্ত হইয়া থাকেন কিংবা আপনার প্রিয়জন কেউ আক্রান্ত হইয়া থাকে কিংবা লোকমুখেও যদি কোন রোগীর কথা শুনিয়া থাকেন যিনি কিনা আপনার খালুর বন্ধুর শ্যালক তবে ধরিয়া নেন সেই রোগের উপশমে কিংবা যেকোনো রূপ সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থাপত্র দিবার অধিকার আপনার নিরঙ্কুশ। ইহা শুধু সরদি কাশি বা মুরগি বসন্ত নয় কর্কট রোগের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
তবে রোগ সংস্কৃতির উপকারী দিক যথেষ্ট এবং তাহাও যথাযথ গুরুত্ব পাইবার দাবিদার। কোন অসুস্থ আত্মীয় কে দেখিতে যাইবার ফলে সামাজিক সম্প্রীতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। হাসপাতালে অবস্থান কারি রোগীর স্বজনদের জন্য ইহা এক মিলনমেলা বলিলেও অত্যুক্তি হইবেনা।
যাহাই হউক এইবার কিঞ্চিৎ নিজের কথা বলি। সর্বাঙ্গের কোথাও মুরগি বসন্ত আমাকে ঠোকর দিতে কসুর করে নাই। নিতান্তই রঙ্গরসে লিপ্ত হইয়া একবার দক্ষিন হস্তে সর্বমোট শতাধিক বসন্ত উদ্ভূত গুটিকা গননা করিয়া ক্ষান্ত দিয়াছিলাম। অতঃপর অবশিষ্ট গাত্রে মোট গুটিকার সংখ্যা পরিসংখ্যানিক নিয়মে নির্ণয় করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম। পিতৃ ও মাতৃ হৃদয় পুত্রের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সদয় বিধায় বেশ কিছু নতুন পোশাক পরিচ্ছদের প্রাপ্তি যোগও ঘটিয়াছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সুধু ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্রে সন্তুষ্ট নাও হইতে পারে বিধায় ইতোমধ্যে মহানগরে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি যাহাতে মুখমণ্ডলে অদ্যাবধি উপস্থিত মুরগি বসন্তের অবশিষ্টাংশ দেখাইয়া তাহাদের আস্থা অর্জন করিতে পারি এবং শ্রেণীকক্ষ ও পরিক্ষায় অনুপস্থিতির কারন তাহাদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য করিয়া উপস্থাপন করিতে পারি। তবে এখন আরও বোধ করিতেছি একখানা আলোকচিত্র ক্ষেপণ করিয়া সংরক্ষণ করাও বিশেষ দরকার ছিল। উহাতে ব্যাপারটা অধিকতর বদ্ধমুল হইত।
কিয়ৎক্ষন বিরতিতে মনের মধ্যে প্রশ্ন উদয় হয় যে অনাগত স্ত্রী আমার সাময়িক বিকৃত মুখমণ্ডল দেখিয়া ইহার প্রভাবে কোনরূপ রুঢ় ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটাবে কিনা? যাহাই হউক আবার ভরসা সেই পূর্বপুরুষেরা যাহারা গুটিকা বসন্ত মোকাবিলা করিয়াছিলেন। সেইখানে আমি ব্যর্থ বঙ্গসন্তান সামান্য মুরগি বসন্ত লইয়া চিন্তিত। ধিক!!! শত ধিক মোরে!!!!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


