একটি নদী - দুটি গ্রাম - একই নাম - গোয়ালগ্রাম । বড় কোন চরের অস্তিত্ত্ব না থাকলেও এর একটির নাম চর-গোয়ালগ্রাম, যাকে কুঠি গোয়ালগ্রাম নামেও ডাকা হয় এবং আরেকটির নাম পার-গোয়ালগ্রাম; মানে নদী পার হয়ে যেতে হয় তাই গ্রামের নামের আগে পার শব্দটি যোগ করা । আর মাঝখানের যে নদীটি একটি গ্রামকে দুটি গ্রামে বিভক্ত করে দিয়েছে, সেই নদীটির নাম মাথাভাঙ্গা নদী (পদ্মার দক্ষিণের প্রথম শাখা নদী) ।
বলাবাহুল্য, এ দুটি গ্রামই এক সময় একই নামে শুধু গোয়ালগ্রাম নামে পরিচিত ছিল । সেটা এখন থেকে প্রায় এক'শ বিশ বছর আগে অর্থাৎ আঠার'শ সালের গোড়ার দিকের কথা । যখন বর্তমান এই খেয়াঘাট থেকে নদী ছিল আরো পশ্চিমে প্রায় পাঁচ/ছয়'শ গজ দূরে । যা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ঘুরে আবার পূর্ব দিকে চলে গিয়েছিল । এর মাঝখানে প্রায় দুই/তিন কিলোমিটার সমতল ভূমি ছিল; যে জায়গার উপর দিয়ে বর্তমানে নদীটি চলে গিয়েছে । পরবর্তীতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত নদীটির উৎস্য মুখটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং সংক্ষিপ্ত ঐ নদীটির নাম হয় মরগাঙ্গী । যেখানে শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকলেও বর্ষায় জীবন্ত হয়ে সে তার কিছুটা যৌবন ফিরে পায় ।
যাইহোক, এবার আসি চেঁচানিয়া ঘাটের কথায় । কেন এই ঘাটের নাম 'চেঁচানিয়া' হলো ? কথিত আছে নদীটির দক্ষিণ দিকের উৎস্য মুখটি বন্ধ হয়ে যখন প্রচন্ড পানির তোড়ের সৃষ্টি হয়ে পূর্বের সমতল ভূমির দিকে এগুতে থাকে, তখন বিকট আওয়াজে নদী ভাঙ্গন হয়; যা অনেকটা চেঁচানো শব্দের মতো ছিল এবং কয়েক মাইল দূর থেকে সেই শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত । বিগত কয়েক প্রজন্মের মানুষের মুখ থেকে জানা গেছে, দক্ষিণের উৎস্য মুখটি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পূর্ব দিকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদীটি এগিয়ে যাওয়ার সময় চেঁচানোর মতো যে শব্দ, তা প্রায় তিনরাত তিনদিন ধরে হয়েছিল । আবার কেউ কেউ বলে সাত রাত সাত দিন ধরে হয়েছিল ।
তবে তিনদিন বা সাতদিন যাই হোক না কেন, নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করতে গিয়ে স্রোত আর পানির তোড়ে ভাঙ্গনের যে শব্দ হয়েছিল এবং তৎকালীন সময়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছে সেটা চেঁচানো শব্দের মতই মনে হয়েছিল । এবং এরপর থেকে এই ঘাটের নাম হয়ে যায় 'চেঁচানিয়ার ঘাট' । যে ঘাটের নামের ইতিহাস শুধুই কি জনশ্রুতি নাকি এর বাস্তব কোন ভিত্তি আছে - তা হয়ত আরো গবেষণার বিষয় । এ ছাড়া আরো কথিত আছে, এই ঘাটের বিশেষ কয়েকটি অংশে গভীর রহস্যের কথা । যেখানে জলের তলদেশে মানুষ নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু গুজবও প্রচলিত আছে । তবে যে সময় কালে নদীর উৎস্যমুখ বন্ধ হয়ে ভাঙ্গনের ফলে এখানে চেঁচানো শব্দের কথা বলা হয়, তখন এ নদীর জলের প্রবাহ ছিল আরো ভয়ংকর এবং দু'পাড়ের ব্যবধান ছিল আরো প্রসস্থ । যা এখন অনেকটাই ক্ষীণকায় হয়ে গেছে । বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে খুবই কম । তাই সেসব দিনের কথা এখন শুধুই ইতিহাস ।
পরিশেষে বলতে হয়, দূভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে এই চেঁচানিয়া খেয়াঘাটের উপর এখন পর্যন্ত কোন ব্রিজ নির্মিত হয়নি । এর উত্তর পাড়ের কাঁচা রাস্তাও চলাচলের অনুপযোগী । বর্ষা কালেও এক বৃদ্ধ মাঝি রশি টেনে নৌকায় করে পার করছে দু-পাড়ের মানুষকে ।
চেঁচানিয়া গাটের দক্ষিণ পাড় চর-গোয়ালগ্রাম বা কুঠিগোয়ালগ্রামে অবস্থিত; যা গাংনী উপজেলার মেহেরপুর জেলার মধ্যে পড়ে । আর উত্তর পাড় পার-গোয়ালগ্রামের মধ্যে পড়ে; যা দৌলতপুর উপজেলার কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত । এবং মাথাভাঙ্গা নদীটি মুলতঃ পদ্মার দক্ষিণ দিকের প্রথম শাখা নদী ।
দৌলতপুর, কুষ্টিয়া
তারিখঃ ২২.০৮.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪১