সামওয়্যার ইন ব্লগের কথা এতকাল শুধু শুনেই এসেছি। দেরীতে হলেও এর সাথে যুক্ত হতে পারায় ভাল লাগছে। ব্যক্তিজীবনে আমি বিবাহিত ও একটি কন্যাসন্তানের বাবা। বর্তমানে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করছি। গান-বাজনা ভাল লাগে। সব ধরনের গান শুনি, কিন্তু সবচেয়ে ভাল লাগে হেভী মেটাল। মিউজিকের এই শাখাটি সম্পর্কে অনেকেরই কিঞ্চিৎ নেতিবাচক ধারনা আছে - অর্থহীন চিৎকার, চেঁচামেচি, শব্দদূষন, আরও অনেক কিছু। যাই হোক, এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা পরে কোন এক সময় পোস্ট করব।
আমি আশির দশকে জন্ম নেওয়া চরম সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন। আমাদের শৈশব আর বেড়ে ওঠার সময়টা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ অন্যান্য সব ক্ষেত্রে তখন যে দৃশ্যপট ছিল, তা পুরোপুরি দোষমুক্ত না হলেও এখনকার চেয়ে কয়েকগুন ভাল ছিল। আমরা সেরা টিভি নাটকগুলো দেখেছি, সেরা গানগুলো শুনেছি, সেরা কনসার্টগুলো দেখেছি, ফরমালিনমুক্ত খাবার খেয়েছি, চিকিৎসক আর পুলিশের কাছ থেকে সর্বোচ্চ, উন্নতমানের সেবা পেয়েছি আর যানযটবিহীন ঢাকায় অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা একত্রে এবং হাসিমুখে ইফতার করেছেন, ঈদের দিন নিজেদের মধ্যে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। দূর্নীতি এখনকার মত দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তৃত ছিল না। ফার্স্ট ডিভিশন/সেকেন্ড ডিভিশন আর স্টার/লেটার মার্কভিত্তিক শিক্ষা ব্যাবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা ছিল সন্তুষ্ট আর অভিভাবকরা ছিলেন চিন্তামুক্ত। মুরুব্বীদের দেখে সিগারেট লুকানো আর বিকালে খেলা শেষে মাগরীবের সময়ে বাসায় ফিরে পড়তে বসা, নির্দিষ্ট সময়ে পড়া শেষ করে সংশপ্তক, ম্যাকগাইভার বা 'কোথাও কেউ নেই' দেখতে বসে যাওয়া, এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস বা ওয়ারফেজের নতুন এ্যালবাম বের হওয়ার সাথে সাথে কিনে ফেলা এবং মিউজিকপ্রেমী বন্ধুদের সাথে বসে মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম শুনে যাওয়া, ঘুড়ি/মার্বেল/লাটিম/বোমবাস্টিং/সাতচারা/স্কুল ফাঁকি দিয়ে ভিডিও গেমসের দোকানে নিয়মিত হাজিরা অথবা আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের তুমুল উত্তেজনা আর ম্যাচ শেষে সমর্থকদের নিয়মিত দাঙ্গা - এসবই ছিল আমাদের সাধারন জীবনের অসাধারন অংশ। মানুষের ভেতরে মানবতাবোধ ছিল প্রবল। যে কোন বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা বা অন্যের বিপদে স্বার্থহীনের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে আমি অনেককেই দেখেছি। আর এখন ঢাকার রাস্তায় একটা বাস কোন পথচারীকে চাপা দিয়ে চলে গেলে বাসের যাত্রীরা চালককে টান দেওয়ার তাগিদই দেয়। পথচারী মরে পড়ে থাক। অন্তত বর্ধিত জনসংখ্যা থেকে একজন তো কমল, ভাবখানা এমন। অনেকে তো বলেই বসেন।
'মানুষ' শিরোনামে জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ব্ল্যাকের একটি গান ছিল তাদের প্রথম এ্যালবামে। গানটির কোরাস ছিল এরকম, "অনেক অনেক মৃত্যুর পর শান্তি ফিরবে একদিন, ক্রমাগত ঘৃণায় পুড়ে মানুষ হবে নিষ্প্রান।" ২০০২ সালে প্রকাশিত গানটির কথা যিনি লিখেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কয়েক মাসের ব্যাবধানে প্রায় ৩০০ মানুষকে এই রাজধানীর বুকেই যখন পুড়িয়ে মারা হয়, তখনও আমরা নিশ্চুপ থাকি। আমরা কি আসলেই সেই জাতি যারা একাত্তরে সুপ্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত একটা সেনাবাহিনী-কে বাধ্য করেছিলাম লেজ তুলে পালাতে? নাকি সাবেক প্রথানমন্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা বিষয়ক দাবী'র মতই একাত্তরের আমাদের ইতিহাস আসলে ভিত্তিহীন?! আর যদি সত্যি হয়েই থাকে, তাহলে সেইসব মহামানবসম মানুষদের পরবর্তী প্রজন্ম, এই আমাদের এমন দুরবস্থা কেন? সমাজের ভয়ে সদ্যজাত শিশুটিকে ৬ তলার ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলা নারীটি কি একবারও ভেবেছে একাত্তরের হাজারো বীরাঙ্গনাদের কথা যাঁরা নির্দ্বিধায় জন্ম দিয়েছেন ধর্ষনের ফসলগুলোকে? তাঁরা তো অাজ থেকে ৪৫ বছর আগেই সমাজের চোখরাঙ্গানো উপেক্ষা করতে পেরেছেন।
যাই হোক, প্রথম লেখায় এতটা সমালোচনামুখর হওয়া বোধহয় উচিত না। তারপরও মেয়ে সন্তানের বাবা হিসেবে গত বছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সেই পাশবিক ঘটনার কথা কিভাবে ভুলে যাই? ঘটনার পর বেশিরভাগ পুরুষ বললেন মেয়েরা খোলামেলা পোষাক না পড়লেই হয়। আর মেয়েরা বললেন পড়লেই ওরকম আচরন করতে হবে কেন? আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে দুই পক্ষের বেড়ে ওঠার মধ্যে সমস্যা আছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে এটা আসলে পরিবারের দায়িত্ব - আমার মেয়েকে যেমন আমি ওরকম জনসমুদ্রে ঠাসা জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যাব, তেমনি আমার ছেলেকে আমি মেয়েদের সন্মান করতেই শেখাবো।
তবে গত কয়েক বছরে দেশের মানুষকে বারবার খুশি হবার মত উপলক্ষ যারা এনে দিয়েছে, সেই ক্রিকেটারদের সালাম জানাই। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর ব্যাংকার হবার দিন শেষ। ক্রিকেট এখন আকর্ষনীয় একটি পেশা। বাবা-মা'রা ছেলে-মেয়েদের মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের ক্রিকেটার বানাবেন বলে। কি অসাধারন ব্যাপার! রাজনৈতিক মামা-চাচাকে ধরে দলে টিকে থাকার দিনও শেষ। প্রতিযোগিতা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। উঠে আসছে নতুন নতুন প্রতিভা। বিপিএল, যুব বিশ্বকাপ - দেশে আয়োজিত এই পদক্ষেপগুলো নিকট ভবিষ্যতে আমাদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পথকে নিঃসন্দেহে আরও সুগম করে তুলছে।
ক্রিকেটের কথা বললে অবধারিতভাবেই চলে আসে মাশরাফির প্রসঙ্গ। মনে আছে, ২০১১ সালের বিশ্বকাপে তিনি দলে ছিলেন না। বাতিলের খাতায় চলে গেছেন - এমন ধারনা ছিল সবার। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যা করে দেখালেন, সেটা তো স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, আয়রন ম্যান, স্পাইডারম্যান, হাল্ক আর উল্ভ্যারীন - জাঁদরেল সব সুপারহিরো। কিন্তু মাশরাফি ওই পা দুখানা নিয়ে যেভাবে ফিরলেন এবং ফেরার পর আমরা দলের যে চেহারা আর ফলাফল দেখলাম, তাতে নড়াইলের ছেলে কৌশিককে উপরোল্লিখিত সুপারহিরোদের শীর্ষে অবস্থান না দিয়ে উপায় আছে? পাকিস্তানের কথা বাদ দিলাম, উপমহাদেশের উইকেটে ভারতকে কে কবে এভাবে নাকানি-চুবানী খাইয়েছে, তা আমার জানা নেই।
আমার নিউইয়র্ক প্রবাসী এক স্কুলবন্ধু ২০০৭ সালে ২ মাসের জন্য বেড়াতে এল। এসেই আবদার ধরল, তখনকার আলোচিত ডিপজল অভিনীত কোন একটা সিনেমা সে হলে গিয়ে দেখবেই দেখবে। অগত্যা আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে টেকনিক্যাল মোড়ের এশিয়া-তে তাকে নিয়ে গেলাম। সিনেমার নাম 'তেরো পান্ডা এক গুন্ডা'। ডিপজলরা ১৪ ভাই। ডিপজল দলনেতা তাই সে গুন্ডা আর বাকিরা অপেক্ষাকৃত পাতি তাই তারা পান্ডা। ওদের কাজ হচ্ছে প্রতিপক্ষের বুকের ওপর চড়ে রামদা দিয়ে তাদের গলা কাটা। সেটা রীতিমত ভয়াবহ এক দৃশ্য। তো, সিনেমার এক পর্যায়ে ডিপজলের কুনজর যথারীতি নায়িকার উপর পড়ে, সুতরাং পান্ডা ভাইদের দিয়ে মেয়েটাকে সে তুলে নিয়ে আসে তার হারেমখানায়। এরপরই ডিপজল আর নায়িকার একটা গান। গানের কথা..."ওরে আয়, কাছে আয়। আইজকা রাইতে বিশু দেওয়ান (ডিপজলের চরিত্রের নাম) তরে 'খাইতে' চায়।" গানের কথা শুনে আর ডিপজল সাহেবের চরম কুরুচিপূর্ন অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসির চেয়ে বমিই বেশি পেয়েছিল আমাদের। তবে সুখের কথা, সেই সময়টা আমরা সম্ভবত পার করে এসেছি। এখনকার নির্মাতারা 'জিরো ডিগ্রী' আর 'রান আউট' এর মত চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এই নির্মাতাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। তাই আশা করা যায়, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে তরুণদের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে সিনেমার মত দেশচালনার ক্ষেত্রেও পুরনো প্রথা ভেঙ্গে নতুন দিনের সূচনা হবে। সেই প্রতীক্ষায়ই থাকলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০১