আমাদের এখানে এই যে এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল, তার মধ্যে দেখার উপযোগী হাতে গোনা কয়েকটা। টিএলসি ছাড়া ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্ল্যানেট আর দুই একটা স্পোর্টস চ্যানেল, এই তো। যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি। ডিসকভারি-তে একটা অনুষ্ঠান আছে। নাম ভুলে গেছি, বিষয়বস্তু হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী কর্তৃক মানুষের মারাত্মকভাবে আহত হবার পুরো ঘটনা ওই ব্যক্তির সাক্ষাৎকার অার অ্যানিমেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা। অামি বেশ কয়েকটি পর্ব দেখেছি, এখনো সময় সুযোগ পেলে দেখি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে, কেউ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে, কারও বা মুখমন্ডল ভীষনভাবে বিকৃত হয়ে গেছে।
সাক্ষাৎকারের শেষের দিকে প্রত্যেকেই একটা কমন বিবৃতি দেয় - এখানে প্রাণীগুলোর কোন দোষ নেই বা সেগুলোর ওপর অাক্রান্তদের কোন প্রকার ক্ষোভ নেই কারণ বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বড় আকৃতির মাংসাশি বা কার্নিভোরাস প্রাণী যেমন সিংহ, বাঘ, জ্যাগুয়ার, গ্রিজলি ভালুক, পুমা, বনমানুষ বা পানিতে কুমির, জলহস্তী - এরা ভীষনরকম টেরিটোরিয়াল। মানে হচ্ছে, এরা প্রাইভেসি পছন্দ করে। তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করলে তারা প্রথমে আপনাকে হুঁশিয়ার করবে। তাতেও যদি আপনি তাদের বিরক্ত করেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হবেন।
বনের প্রাণী প্রায়ই জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। খাবারের অভাব, বন কেটে সাফ করা বিভিন্ন কারণে এটা হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে মানুষ এসব ক্ষেত্রে প্রাণীগুলোকে জীবিত আটক করে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে থাকে। অার আমাদের এখানে বনাঞ্চল ঘেঁষা এলাকাগুলোতে যখনই কোন বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়ে, অধিবাসীদের কাছে তার একটাই সমাধান - ওটাকে মেরে ফেলতে হবে।
এভাবে গত তিন দশকে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ বন্যপ্রাণী মারা হয়েছে, ধীরে ধীরে কমেছে তাদের সংখ্যা। এর পাশাপাশি গাছ কেটে ফেলা বা মনের খোরাক মেটানোর জন্য শিকার, এসব তো আছেই।
অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ণ টেরিটরি বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে লোনা পানির কুমিরের সবচেয়ে বড় অভয়ারণ্য। সরীসৃপকুলের মধ্যে আকারে সর্ববৃহৎ এই প্রজাতি ৬ মিটার (১৯.৭ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয়। নর্দার্ণ টেরিটরি-তে প্রতিবছর কুমিরের পেটে যাওয়া পর্যটকদের সংখ্যা নেহায়েত কম না। অথচ এ ব্যাপারে সরকারী কোন হস্তক্ষেপ নাই্। বরং এই দূর্গম বনাঞ্চল, বিশাল জলাশয় আর এখানকার প্রাচীনতম অধিবাসী লোনা পানির কুমিরের রক্ষণাবেক্ষনে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার তো প্রশ্নই আসে না।
বন্যপ্রাণীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আচরণ বরাবরই অসন্মানজনক, ক্ষেত্রবিশেষে বিকারগ্রস্থ। শুক্রবারে ঢাকা চিড়িয়াখানায় গেলে সেটা বোঝা যায়। দর্শণার্থীদের দোষ দিবো কি, চিড়িয়াখানা যারা পরিচালনা করে, তারাই তো আসল কালপ্রিট। প্রাণীর খাবারের জন্য বরাদ্দ টাকায় নিজেরা কোটিপতি হয়ে বসে আছে। প্রানী সব চুলোয় যাক। গাজীপুরের সাফারি পার্ক পর্যটকদের জন্য চমৎকার একটা উদ্যোগ ছিলো। কিন্তু পত্রিকান্তরে আর মানুষের মুখে সেখানকার অবস্থা শুনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
যেসমস্ত কারণে পৃথিবীর বুকে আমাদের বসবাস যুগ যুগ ধরে সহজতর আর সহণীয় হয়েছে, বন আর বনে বাস করা প্রাণী তার মধ্যে অন্যতম। আমি আশাবাদী মানুষ। অন্য আর সবকিছুর মতো এই ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কোন একদিন বদলাবে বলে আশা রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ ভোর ৬:৩৫