এই মাঝমাঠের সেনাপতির ক্যারিয়ার শুরু হয় জামার্ন লিগের দ্বিতীয় সারির দল চেমনিটজারে। সেন্টার মিডফিল্ডে অসাধারণ পারফর্মেন্স আর দুই পায়ের চমত্কার কাজ সবাইকেই মুগ্ধ করে। তাই ১৯ বছর বয়সে যখনে প্রথম প্রফেশনাল কনট্র্যাক্ট সাইন করতে যান তার আগেই গায়ে 'ছোট কাইসের' এর তকমা লেগে গিয়েছিল। যানেন এই 'কাইসের' কে ছিল? লেজেন্ড ফ্রেন্জ ব্যাকেনবিউরের। দলের চরম খারাপ পারফর্মেন্সের পরও নিজের ধারাবাহিক ভালো খেলার ফল দ্রুতই পান, বুন্দেসলিগার নবাগত দল কাইসেরস্লাটের্নে এ নাম লিখিয়ে। তার পরের টুকু শুধু রূপকথা বললেও ভুল হবে। ইতিহাসের প্রথম নবাগত দল হিসেবে বুন্দেসলিগা জয় করে কাইসেরস্লাটের্ন, যার পেছনে এক বিশাল অবদান ছিল তার, ত্রিশ ম্যাচ খেলে করেন ৪ গোল এবং হয়ে ওঠেন দলের অপরিহার্য অংশ।
১৯৯৯-০০ মৌসুমের শুরুতেই জার্মানির সবচেয়ে প্রতিভাবান এই মিডফিল্ডারকে দলে নিয়ে আসে বায়ের লেভারকুজেন। এই ট্রান্সফারটা যে কতটা সফল ছিল তা পরের তিন মৌসুমেই পাওয়া যায়। কোচ ক্রিশ্থপ ডম বালাককে দেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে খেলার সুযোগ, যার ফলস্বরূপ ৩ মৌসুমে তার পা থেকে আসে ৩৬ গোল। ২০০১-০২ সালটা ছিল তার ও তার দলের জন্য দু:স্বপ্নের মতো। লিগে শেষ তিন ম্যাচে পাঁচ পয়েন্ট হারিয়ে লিগ জেতার সুযোগ হারানো, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও কাপের ফাইনালে হেরে ট্রেবল জেতার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করে তারা। আর তার সাথে ২০০২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল হারের স্মৃতি তো ছিলই।
বিশ্বকাপের চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্সের পর পরের মৌসুমে যখন প্রায় সবাই নিশ্চিত বালাক রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখাবেন, ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে যোগ দেন বায়ার্ন মিউনিখে। প্রথম মৌসুমেই জেতেন লিগ ও কাপ, যদিও দ্বিতীয় মৌসুমটি ছিল ট্রফি শূন্য। তৃতীয় মৌসুমে আবার ডাবল জয়। বালাক-ই ছিলেন নতুন কোচ ফেলিক্স মাগাথের মিডফিল্ডের একমাত্র রেগুলার সদস্য। ৪র্থ মৌসুমে তৃতীয় বারের মতো জেতেন ডাবল। চার মৌসুমে ১০৭ ম্যাচ খেলে করেন ৪৪ গোল।
ম্যান্চেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার ও এসি মিলানের প্রবল আগ্রহের পরও ২০০৬-০৭ মৌসুমে ফ্রি এজেন্ট হিসেবে নাম লেখান ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে। তবে চেলসিতে যোগ দেওয়াটা তার জন্য খুব ভালো কাজ হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। দলে এসেই সেন্টার মিডফিল্ডের বদলে উইংয়ে খেলতে হয় তাকে। চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচগুলোতে 'বিবর্ণ' পারফর্মেন্সের ফলে পরের মৌসুমগুলোতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ হারাতে হয় তাকে। পরের মৌসুমে ইন্জুরি ও সিডওয়েলের কাছে যায়গা হারান তিনি। ফিটনেসের অভাবে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ মিস করেন তিনি। পরের মৌসুমগুলোতে ভালো খেললেও 'সেই বালাক' কে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। চেলসির হয়ে চার মৌসুমে জেতেন একটি লীগ শিরোপা, একটি লীগ শিরোপা, তিনটি এফএ কাপ ও একটি কমিউনিটি শিল্ড।
২০১০-১১ মৌসুমে ফ্রি এজেন্ট হিসেবে ২ বছরের জন্য যোগ দেন তার সাবেক ক্লাব বায়ার লেভারকুজেনে। ২রা অক্টোবর, ২০১২ তে এই ক্লাবেই অবসর নেন এই জার্মান।
জার্মান জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবেই বালাকের পরিচিতি ছিল বেশি। জার্মান জাতীয় দলের হয়ে কিছুই জিততে পারেন নি তিনি। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনাল, ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল, ২০০৮ ইউরো ফাইনালের ব্যার্থতা এই লেজেন্ডের ক্যারিয়ারে কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি এনে দিতে পারেনি। তবে এসব ট্রুনামেন্টের প্রতিটিতেই 'বেস্ট ইলেভেন' এ চান্স পেয়েছিলেন বালাক। তিনবারের জার্মান বর্ষসেরা এই খেলোয়ার ২০১০ বিশ্বকাপের পর ফিলিম লামের 'বিশ্বাসঘাতকতার' জন্য জাতীয় দলের জন্য হয়ে শেষ দুটি বছরে ছিলেন অনেকটা অসহায়।
একজন আদর্শ সেন্টার মিডফিল্ডের প্রায় সব গুণই ছিল তার মধ্যে। চমত্কার পাসিং রেন্জ, দারুন সব গোল করার ক্ষমতা, বলের ওপর চরম স্কিল্স আর হ্যাঁ, দলের মিডফিল্ডে সেনাপতির মতো দাপিয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা তাকে করে তুলেছে সবার প্রিয়। সব কিছুই ছিল তার শুধু একটা জিনিস বাদে, আর তা হলো 'ভাগ্যের ছোঁয়া'। নাহয় হয়তো বা কয়েক দিন পর তাকে দেখা যেত বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের তালিকায়। তিনি হলেন সেই খেলোয়ারদের একজন যারা বিশ্বকে বোঝাতে পেরেছে, অমর হতে বিশ্বকাপ লাগে না।
আর এটাও বুঝিয়েছেন, দলের জন্য ১৩ নম্বর জার্সিটা আসলেই আনলাকি না।