somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেলফি কথন

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিনটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি-
মানুষ কি আদৌ নিজেকে চিনতে পেরেছে?
যতটুকু চিনেছে তাতে কি সে সন্তুষ্ট?
নিজেকে চেনার কি কোন সীমা রয়েছে

পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটার নাম ‘আয়না’। সেখানে এক চাষী একদিন ক্ষেতের মধ্যে একটা আয়না খুজে পায়। যেহেতু সে এর আগে কখনও আয়না দেখেনি, তাই এর মধ্যে নিজের মুখ দেখে সে চিনতে পারে না। লোকমুখে শুনেছে তার চেহারা তার বাপজানের মত, তাই সে ধরে নেয় আয়নার লোকটা তার মৃত বাপজান। চাষী যত্নে করে আয়নাটাকে বাপজান ভেবে বাড়িতে এনে লুকিয়ে রাখে। সময় পেলে সে আয়নাটা বের করে এর সাথে গল্প করে, কান্নাকাটি করে। চাষীর বউ একদিন আয়নাটা খুজে পায়। সেও আয়নাতে নিজেকে চিনতে না পেরে ভেবে বসে তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে লুকিয়ে রেখেছে। এই নিয়ে ঝগড়া শুরু করে চাষীর বউ। পাশের বাড়ির মহিলা ঝগড়া শুনে এগিয়ে এসে আয়নাতে তাকায়। সেও নিজেকে চিনতে না পেরে অন্য মহিলা আয়নার ভেতর। পরে সবাই একসাথে যখন আয়নার উপর মুখ দিলো, তখন একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো।

নিজেকে চেনার লক্ষ্যেই যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন পন্থার দ্বারস্থ হয়েছে। একসময় আয়নাতে সীমাবদ্ধ ছিলো; চিত্রকরের শিল্পের মাঝেও মানুষ নিজেকে খুজেছে। আর এখন খুজে সেলফিতে।

বর্তমান সময়ে আপনি রাস্তা দিয়ে হেটে যাবেন আর এইধারে ওইধারে নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ কিছু মানুষকে স্মার্টফোন সামনে ধরে দু-একটা (কখনও একটানা ২০-২৫ টা) সেলফি তুলতে দেখবেন না, ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। পারফেক্ট একটা ফটোর আশায় মানুষ যখন সামনের ক্যামেরাওয়ালার উপর নির্ভর করতো সেলফি তোলার কালচার সেটার তুলনায় একেকবারেই নতুন। সেলফি এখন অন্যের কাছে নিজেই নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার একটা সুপার ওয়েপন। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে একেবারে পড়ন্ত বয়সের চাচারাও তুলামাত্রই সেলফি আপলোড করেন সোশ্যাল সাইটে। আর একটু পর পর চেক করেন লাইক কয়টা পড়েছে। সেলফি তোলার এই আবেগ কিন্তু বহু আগের।

সেলফি তোলা লোকেরা সেলফি দিয়ে নিজের অস্তিত্বের কথা স্বীকার দেন, অনেকটা কনফেশনের মত। কনফেশনের উৎপত্তি মিডল এইজের খ্রিস্টান চার্চে, যেখানে লোকেরা নিজেদের পাপের কথা, মন্দ ইচ্ছার কথা যাজকের কাছে স্বীকার করতো। কনফেশনের এই রিচ্যুয়াল যাজকের আচরণে কোন পরিবর্তন আনতো না। পরিবর্তন আনতো লোকের আচার আচরণে। তবে এই কনফেশনের বৈধতা দেয়ার ক্ষমতা থাকতো যাজকের কাছে। কনফেশনের এই প্রথা আস্তে আস্তে পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়, সর্বপরি সমাজের সবখানে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়লো যে তখন কনফেশন করে লোকে আর সেটার বৈধতার অপেক্ষায় থাকতো না।

সেলফির শুরুও হয়েছে নিজেকে সবার নিকট প্রকাশ করা এবং জগতের মাঝে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়ার গতানুগুতিক প্রথা থেকেই। সেলফি তুলা লোকেদের অনেকেই নারসিসিস্টিক বলে মার্কড করেন। একেবারেই আসলে তা না। কারন সেলফি ওয়ালারা শুধু যে নিজের চেহারা দেখাচ্ছেন না তা নয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করছেন। যদি শুধু নিজেকে দেখানোর ইচ্ছায় লোকে সেলফি তুলতো তাহলে হয়তো ফেইসবুক নিউজফিডে শুধু পাসপোর্ট সাইজের সেলফিই দেখতেন। অথচ, যা দেখছেন তা হলো কেউ দামী রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়ে, কেউবা সুযোগে নিজের জেনিটাল টাচ করা পার্টনারকে (অধমের কাছে বহুল প্রচলিত বয় ফ্রেন্ড- গার্ল ফ্রেন্ড এর অস্তিত্ববাদী সংজ্ঞা ) পিছনে রেখে রোমান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড বানিয়ে সেলফি তুলছেন। সেলফি কালচারের শুরুর দিকে অনেকে আবার বাথরুমের পরিবেশটা বেশি পছন্দ করায় সেখানেও ব্যাকগ্রাউন্ড বানিয়ে ছবি তুলতেন।

সেলফির মানুষেরা নিজেদেরকে চিনতে শুরু করেছে। একজন ব্যক্তির অবয়ব, তার অবস্থান, তার নিজের সম্বন্ধে ধারনা সবকিছুই সেলফি শুরু হবার পর কিছুটা হলেও এর দ্বারা আক্রান্ত। চিন্তা করে দেখেন যখন আয়না ছিলো না, তখন মানুষ নিজেকে নিয়ে কেমন করে ভাবতো ! আর যখন আয়না পেয়ে সে নিজেকে চিনতে পারলো তখন থেকে ভাবনায় নিশ্চয়ই বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। সেলফির ক্ষেত্রেও হয়তো এমনই। সেলফির আগে জগতের মাঝে নিজের অবস্থান নিয়ে সেলফি ওয়ালারা কি একইভাবে ভাবতেন এখন যেভাবে ভাবছেন? সেলফির কালচার যদি নিজেকে নিয়ে ভাবনার পরিবর্তন এনেই থাকে তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে চেনার অন্য কোন পন্থা আবিষ্কৃত হলে সেটার দ্বারাও ভাবনার পরিবর্তন হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×