দুরদর্শীরা যে কোন ব্যাপার আগেভাগেই টের পেয়ে যান এবং সেই ঈঙ্গিত প্রকাশ করেন তার কাজে, শিল্পকর্মে। যে কারনে সমকালীন সমালোচনা অনেকাংশে তার বিরুদ্ধেই যায়- যা পরবর্তীতে তার অনন্য কাজ হিসেবে স্বীকৃতও হয়। যা হোক, নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কয়েক বছর আগে তেমনি একটি দুরদর্শী ম্যাসেজ দিয়েছিলেন 'ব্যাচেলর' চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র হিসেবে এটি যথাযোগ্যতা অর্জন করুক বা বিতর্কিত থাক- এ ব্যাপারে আজ মাথা ঘামাবো না, এই রচনার উদ্দেশ্য ভিন্ন...
২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বা মোবাইল কোম্পানী কত ছিল? হাতেগোনা। এই সময়ে চারপাশে তাকালে কি দেখা যায়? আমিতো দেখি যে, পথচারীদের অনেকই তাদের মোবাইলটা এমনভাবে আগলে নিয়ে যায় যে বোধকরি একে বহন করে নিয়ে যাওয়াই তার মূল কর্ম! ফারুকী নতুন শতাব্দীর শরুর দিকে ভিজ্যুয়ালে এই প্রসঙ্গটির ভবিষ্যতবানী করেছিলেন তার সিনেমার মাধ্যমে। সত্য কথা, সে সময় এই বলে ব্যাচেলর নিয়ে সমালোচনা উঠেছিল যে, মোবাইলে এত প্রেম/পরকীয়া করে কারা? এই প্রশ্নটা এখন আপনাকে করা হলে সঠিক জবাবটা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন...
আমার বেশ অবাক লাগে মাঝরাতে। পড়াশুনার ফাকে বা একটু কম খরচে দুরের বন্ধুটির সাথে কুশলাদি বিনিময়ের সুযোগ আর পাইনা। কেননা আমার সাথে নিরস আলাপ করার চেয়ে সেই বন্ধুটি ব্যস্ত কোন মেয়ে বন্ধুর ফোনে 'ফাও গ্যাজানো'তে। যে মেয়েটির সঙ্গে হয়তো তার দেখাটিও নেই, যার নাম্বার সে নিয়েছে আরেকজনের কাছে চেয়ে, সেই মেয়েটিও বেশ জানে টাইম পাস ছাড়া আর কিছু নয়; তবু সারা রাত, দিনের পর দিন চলে এ খেলা, যতক্ষন না তারা নতুন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকা, বিভাগীয় অন্যান্য শহর, জেলা শহর, মফস্বল এমনকি গ্রামেও প্রসারিত হয়ে গেছে এ প্রবনতা। পরিবর্তনটা ক'দিনের?
আমি স্বীকার করতে কার্পন্য করছি না যে, মোবাইল যন্ত্রটা অনেক উপকারী, এর বদৌলতে গ্রামে বসে আমার মা জানতে পারছেন আমার সর্দির কি খবর, ফার্মগেটে জ্যামে আমি কতক্ষন আটকা ছিলাম কিংবা বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে আমি কোথায় নিঁখোজ হয়ে গেলাম নতুবা তিনি চাইলেই পান চিবুতে চিবুতে অফিস যাওয়ার পথে আমাকে শোনাতে পারছেন বাবার ছেলেমানুষীর গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি...।
কিন্তু তবু দু:খ লাগে- যখন দেখি আমার বোনটি রাত জেগে কথা বলছে অজানা একটি ছেলের সঙ্গে, দিনে দিনে সে নিশাতুর হয়ে উঠছে, টেবিলে পাঠ্যবই তো দুরে থাক একটা উপন্যাস নিয়েও তার বসা হয়না। দেখি রাস্তায় হেঁটে চলা বালকের চোখে রাত জাগার ক্লান্তি, সেলফোনে কান চেপে থাকার অভ্যাসটা তার দীর্ঘতর হচ্ছেই, বানোয়াটা গালগল্প শেষে বিরস ভোর আসে, অনৈতিক ও অসামাজিক উচ্চারনে তার ঠোট-জিহ্বা আর বাধেনা, কবির নাম ভুল করে সে ওপর প্রান্তে পাঠাচ্ছে রোমান্টিক কবিতা, একই ব্যবহার ও উপলব্ধি সে একই রাতে শেয়ার করছে অন্য কোন নম্বরে, অন্য কোন মেয়ের সাথে...। কেন? উদ্দেশ্য কি? প্রেম? ভালোবাসা!
যারা সিরিয়াস প্রেম করছেন, করুন। কিন্তু আমার এই পর্যবেক্ষন একবার আপনার চোখ দিয়ে দেখুন, পরিষ্কার হয়ে যাবে সব।
লক্ষ্য করুন: ছাত্র সমাজে এ ব্যাপারটি দারুন জনপ্রিয় করে তুলেছে মোবাইল কোম্পানীগুলো। অপেক্ষাকৃত কম পয়সায় কথা বলার সর্বোচ্চ সুযোগটি আপনাকে দিতে তারা কোমর বেধে মাঠে নেমেছ। উদ্দেশ্য, ব্যবসা- সেবা নয়। এবং তারা সফল হয়েছে। তাই আরো গ্রেট অফার প্রতিদিনই আপনাকে চমকে দেয়...
এরা ধরেই নিয়েছে যে, এই দেশের ছেলেপুলেদের পড়াশুনার দরকার নেই, এরা শুধু রাত জেগে মোবাইলে কথা বলবে, এদের মাথা খাওয়া বেশ সোজা, এদের সৃজণশীল হওয়ার দরকার নেই, রাত জাগতে জাগতে আর মোবাইলে চাপা মেরে মেরে এরা সব্বাই বুদ্ধিজীবি ও মহা মনীষী হয়ে উঠবে। তাই আমরা প্রতিরাতে তাদের দেয়া সুযোগগুলোর সদ্ব্যাবহার করবো, প্রতিরাতে জড়িয়ে পড়বো নতুন প্রমে, নতুনজন যদিবা প্রতারিত করে হামেশাই আরেকটি নম্বর চেয়ে নেবো বন্ধুর কাছ থেকে। তবু কথা বলা থামানো যাবেনা, কথা আমাকে বলতেই হবে, কারণ আমি বাক স্বাধীনতা চেয়েছি, মোবাইল কোম্পানীগুলো সেই সুবিধা আমাকে দিচ্ছে, তারা এ স্বাধীনতা দিয়েছে কারন তারা বেশ ভালোভাবেই জানে- আমি নির্বাক হয়ে গেলেই তাদের পতন অনিবার্য...