বাবা একটা কথা খুব বলতেন চৈত্রে রাইন্ধা বৈশাখে খাই। এটা বেশির ভাগ সময় যখন রোজা পরত এই সময়ে চৈত্র বৈশাখ মিলে, তখনই সম্ভব ছিল চৈত্রে রান্না করে বৈশাখের ভোরে সেহেরী খাওয়ার বেলায়। এবার তেমন রোজার দিন পরেছে।
আগের সময়ে, রান্না করে সাথে সাথেই খাওয়া হতো। পরের দিন খাওয়ার জন্য খাবার কিছু রাখা হতো না, থাকতও না। খুব পরিমিত ছিল তখন খাওয়া দাওয়া রান্নার আয়োজন, অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরেও। ভাজি, মাছ বা মাংস, ডাল। এর বেশি কিছু না। এখন তেমন না। অনেক রকম ভর্তা ভাজি, দেশি মাছ ভাজা, ভুনা, তরকারি । মাংস, বিরিয়ানি, শুটকি সব এক সাথে রান্না হয়। বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকেন তেমন বাঙালির বাড়িতে আমি এই প্রথা অনেক দেখেছি। সব কিছু এক সাথে খাওয়া ঠিক কিনা পেটে সয় কিনা এত চিন্তা না করে সব এক সাথে রান্না খাওয়া হয়।
ভাত বেশি রান্না হয় বাঙালির ঘরে, বাঙালি অনেক বেশি ভাত খায়, খেতে পছন্দ করে। ভাত খেয়েই পেট ভরে বেশির ভাগ মানুষের। ঠেসে এক প্লেট ভাত খেয়ে আরো দুবারও নেয়া হয় ভাত। তরকারি তেমন একটা না থাকলেও ভাত মরিচ পোড়া বা ডাল নয় তো নুন হলেই ভাত খাওয়া চলে অনেক বাঙালির। আর খাওয়ার পরে বেশি ভাত থাকলে পানি দিয়ে রাখা হয় পরের দিন সকালে নাস্তায় খাওয়ার জন্য। এটাই বাঙালির পান্তা খাওয়া, জীবন ধারনের জন্য ছিল এক সময়। সেই সময়ে ভাত ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। শখ করে নতুন ধান উঠার পরে পিঠা পুলি তৈরি হতো কখনো সখনো। তাও চাল কুটে গুড়ো তৈরি করে। এছাড়া ছিল মুড়ি, চিড়া বাঙালির খাবার। তবে মুড়ি চিড়া, খই খেয়ে বাঙালির ভাত খাওয়া পেট খুব একটা ভরে না। যদিও ভাতের বিকল্প খাবার বলা যায় কিন্তু তা হালকা ওজনদার খাদ্য। পেটে গেলে ভাড়ী হলেও চোখে, হালকাই লাগত এ খেয়ে কি পেট ভরে। ভেতো বাঙ্গালির অভ্যাস বেশি ভাত খাওয়া। পিঠা চিড়া যা তৈরি হতো তাও চাল এবং ধানের তৈরি আমাদের দেশে। ধান চালেরই ছড়াছড়ি বাঙালির খাদ্যে।
অর্থনৈতিক অবস্থানে পরিবার সকালের নাস্তায়, পান্তা ভাত, রুটি, মুড়ি, চিড়া, খই খাবার খেত।
পরটা, রুটি, লুচি খাওয়াও পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান এবং পেশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশগত অবস্থানের সাথে পরিবর্তন হয়ে ছিল।
সেই রান্না ভাত পানি দিয়ে রেখে, খাওয়াকে কারা যেন বানিয়ে দিল বাঙালির ঐতিহ্য বৈশাখের প্রথম দিনে, পহেলা বৈশাখের বিশেষ খাবার। যে কোন ভাবে বৈশাখের সকালে পান্তা ভাত খেয়ে বাঙালি হতে হবে। বুদ্ধিটা হুজুগে বাঙালিকে টার্গেট করে ব্যবসা করার জন্য বেশ ভালো ছিল।
আগের দিনে, প্রতিদিন এমন কি প্রতিবেলার খাবার সাথে সাথে রান্না করা হতো। বাঙালি গৃহিনীরা রান্না ঘরেই তাদের জীবনের অনেক সময় পার করেছেন। পরিবারের সকলের তিনবেলা খাবার যোগান দেওয়ার জন্য। একটু সমৃদ্ধ পরিবারে দিনে খাবার আবার পাঁচবেলা হতো।
তিনবেলা রান্না করা হতো কারণ মনে হয় গরমের দেশে খাবার রাখলে নষ্ট হয়ে যেত সেজন্য । সে যুগে তো আর ফ্রিজ ছিল না। আমার জীবনে আমি ফ্রিজ দেখেছি বেশ বড় হয়ে আমাদের বাড়িতে।
তবে আমার মা দুবেলার খাবার একবেলায় রান্না করতেন একটু বেলা করে। দুপুরের খাবার শেষ হয়ে যেত আর রাতের খাবার শুধু গরম দিয়ে বেড়ে দেয়া হতো রাতের খাবারের সময়। মা দুবেলা সময় নষ্ট করতেন না রান্না ঘরে। সারা জীবনই আমরা সকালে রুটি নাস্তা খেয়েছি।
শীতকালে বড়বড় মাছ ধরা পরত বীলে । রুই কাতল, চিতল, পাঙ্গাশ। এক একটা মাছ আমার সমান। বাবা মাছ আর আমার মাপ দিতেন দেখি কে লম্বাা তুমি না মাছ। সেই বিশাল বিশাল মাছগুলো মা কিছু রান্না করতেন আর কিছু পাঠিয়ে দিতেন পাড়া প্রতিবেশী আত্মিয়দের বাসায়। ঘরে রাখলে নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্ভাবনা প্রচুর। বড় বড় গামলা ভর্তি মাছ নিয়ে আমি পাড়ার অনেক বাসায় যেতাম। পিছনে কাকও উড়ত সাথে সেটা ভয়ের ছিল। তবে ব্যাপারটা উৎসব উৎসব লাগত।
এখন তেমন বড় মাছ দেখিনা। আগের স্বাদও মাছের মধ্যে পাই না। চাষের মাছে নানা রকম খাবার দেয়া হয় সেজন্য চাষের মাছ খেতেও ইচ্ছা করে না। তবে এখন আগের তুলনায় প্রচুর মাছ চাষ হয় দেশে।
একই অবস্থা হতো কোরবানীর ঈদের দিনও। প্রচুর মাংস বিতরন করা হতো বড় বড় ডেকচি, হাড়িতে যে পরিমান কিছু মাংস রান্না এবং জাল করে রাখা হতো নিজেদের জন্য। প্রতিদিন সেই মাংসর সঠিক গুণমান ঠিক রাখার জন্য মাকে অনেক বেশি কাজ করতে হতো, কয়েকবার গরম দিতে হতো ঠিকভাবে। বেশ কিছুদিন পর জাল দিতে দিতে মাংস ভেঙ্গে নরম হয়ে যেত পরে ভেজে ভেজে যে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ হতো মাংসের এবং খেতে দারুণ মজা তখন পরিমাণ কমে যেত। খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মাংস শেষ। অথচ ঠিক কোরবানীর পরের এক দুদিন মাংস দেখলেই বিরক্ত লাগত, মাছ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করত তখন।
আমাদের এমন ঐতিহ্য গুলো সময়ের সাথে প্রযুক্তির সুবিধায় এখন বদলে গেছে একেবারে। চৈত্রে রেঁধে বৈশাখে খাওয়ার চিন্তা নাই ডিসম্বরে রেঁধে জানুয়ারিতে খাচ্ছি কতদিন হিসাব থাকে না।
অনেকে ডিপ ফ্রিজে রান্না করে রাখেন এখন সময় এবং কাজ বাঁচানোর জন্য এবং অনেকদিন ধরে খান। তবে আমার কখনো এটা পছন্দ না। তবে প্রতিদিন রান্না ঘরে সময় নষ্টও করতে পারি না। সপ্তাহে দুদিন রান্না করলেই হয়। মাঝে মধ্যে কিছু খেতে ইচ্ছ হলে সাথে সাথে বানিয়ে নিতেও তেমন একটা সময় লাগে না।
অনেকে বলেন বিদেশে তো সব কিছু তৈরি পাওয়া যায় প্যাকেট কিনে আনলেই হয়। তবে অনেক বছরের বিদেশের জীবনে, প্যাকেট করা কাটা কিছু কখনো ব্যবহার করি নাই। কাঁচা শাক সবজি ফলমূল, মাছ মাংস সবই নিজে কেটে ধূয়ে নিচ্ছি। প্যাকেটে শাক সবজী দিনের পর দিন ভালো থাকছে কি ভাবে, নিশ্চয় কিছু মিশানো হয় ভালো থাকার জন্য এটা ভেবেই আমার গা গুলায়।
বিদেশীদের আমি দেখেছি তাদের আবিষ্কৃত ফ্রিজে তারা রান্না করা খাবার জমিয়ে রাখে না। প্রতিদিন আধঘন্টা সময় হলেই তাদের ঝটপট রান্না হয়ে যায় এবং টাটকা রান্না করা খাবার প্রতিদিনই তারা খায়, যারা বাড়িতে রান্না করে। আর যারা রান্না করতে পছন্দ করে না তারা ডিনার কিনে আনে দোকান থেকে। এখন তো দারুণ প্রচলন হয়েছে উবার ইটিং এর। আধঘন্টা আগে ওর্ডার করলে ঘরের সামনে খাবার চলে আসে খাওয়ার সময় মতন।
বিদেশি খাবার গুলো খুব অল্প পরিমানে রান্না করে একবেলায় খেয়ে শেষ করলেই মজা পাওয়া যায়। বাঙালি ডাল মাংস বা মাছের ঝোল দুচারদিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশি খাবারগুলোর কোন স্বাদ থাকে না ফ্রিজে রাখলে। এগুলো খেতে হয় চুলা বা ওভেন থেকে নামিয়ে আগুন গরম থাকতে সাথে সাথে তবেই মজা পাওয়া যায়।
আসলে যে কোন খাবারই টাটকা রান্না করে খাওয়ার মজা আলাদা। বেশি ভাতটুকু পান্তা না বানিয়ে হলুদ নুন কাঁচা মরিচে ভাজলে অনেক মজা লাগে। আর ফ্রাইড রাইস যেটা চাইনিজরা করে তার মধ্যে তো একটু করে সবজি মাছ, মাংস সব মিশিয়ে দিলে আরেকটু বেশি দামী হয়ে যায় স্বাদে গন্ধে গুণেমানে।
বাঙালি যেমন ভাত অনেক বেশি খেতে পছন্দ করে আর কোন দেশিরা এমন বেশি ভাত খায় না। বিদেশে এসে দেখলাম ভাতের পরিমাণ এত্তটুকুন, মাংস, সবজী প্লেট ভর্তি। প্রথম প্রথম আমারও মনে হতো এই ভাত খেয়ে খিদা মিটল না। এখন বেশ কিছুদিন ভাত না খেলেও কিছু যায় আসে না, অভ্যাস। আমাদের খাওয়ার সিস্টেমটাই এমন ভাত বেশি খাওয়াই লাগে। আমরা পাঁচরকমের ভর্তা দুই রকমের সবজী তারপর তিন রকমের মাছ এরপর মাংস এবং ডাল সব একবারে খাই। সব কিছু দিয়ে খেতে গেলে ভাত অনেকটাই খাওয়া লাগে। যা আমাদের পেটটা মোটা করে সবার আগে। আর গরিব জনগণ ভাতের সাথে আর কিছু পায় না শুধু ভাতের উপর নির্ভর করে। ভাত খেয়েই পেট ভরায়।
বিদেশিদের তরকারি এমন ভাবে তৈরি হয় সেটা ভাত ছাড়াও খাওয়া যায়।
ভাত শুধু বাঙালিরা খায় না পৃথিবীর সব দেশের মানুষই কমবেশি ভাত খায়। ম্যাক্সিকানরা টেকোর ভিতর আর সব কিছু দেয়ার সাথে ভাতও যেন পুর হিসাবে দিয়ে দেয়।
জাপানীরা যে শুষি বানায় তাতে যে পরিমান ভাত থাকে বাঙালিরা ভাবতেই পারবে না এই পরিমান ভাত খেয়ে দিন কাটবে। আমি তো চারটার পর পাঁচটা শুষি খেয়ে উঠতে পারিনা কিন্তু দিন খুব ভালো কেটে যায়। কারন এমন সব উপাদানের সমন্বয় থাকে যা পরিপূর্ণ অনুপূরণ হয় শরীরের। চাইনিজরা মনে হয় আমাদের মতন একটু বেশি ভাত খাওয়া পছন্দ করে। ওদের দোকানে গেলে ভাতের পরিমান যত পাওয়া যায় আর কোন দোকানে ততটা পাওয়া যায় না।বাংলাদেশের পশ্চিম দিকের মানুষ নানা ধরনের রুটি খেতে পছন্দ করে সেই রুটি হয়ে যায় পাউরুটি বা আরো নানা ধরনের গম, ভূট্টা, যবের বানানো রুটি কেক, বেগল আরো কত কিছু ইউরোপ আমেরিকায়। আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবেশের সাথেই খাদ্য খাবারের সম্পর্ক, মানুষের জীবন ধারনের প্রয়োজন মিটে।
বিদেশিরা আমাদের খাবার কতটুকু গ্রহণ করেছে জানি না। আমরা কিন্তু সব দেশের খাবারই গ্রহণ করেছি, ঝাঁপিয়ে পরে খাই। এবং সব কিছুই মিলে মিশে গেছে আমাদের জীবনে এখন পান্তাভাতের সাথে। নানা দেশের নানা ধরনের খাবারের দোকানের প্রাচুর্য এখন শুধু ঢাকায় নয় বিভিন্ন শহর দখল করেছে।
রোজার সময়ে সেহেরী খেতেও মানুষ এখন রেস্টুরেন্টে যায়। আমার ছোটবেলায় আমাদের শহরে কখনো কোন রেস্টুেরেন্টে গিয়ে ভাত খেয়েছি বলে মনে পরে না। ঢাকায় আসার পর খেয়েছি শখে এবং প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে।
আজ চৈত্র সংক্রান্তি। অবশ্য সঠিক জানি না হিসাবটা কি। বাংলা বর্ষের হিসাব আবার পরিবর্তন করা হয়েছে ইংরেজি তারিখের সাথে মিল রাখার জন্য। বাংলার কোন মাস ছিল বত্রিশ দিনে, কোন মাস ত্রিশ বা উনত্রিশ দিনে। ইংরেজিরও তেমন মাসের হিসাব আছে সব মাসে সমান দিন থাকে না। ইংরেজিতে তা পরিবর্তন করা হয়নি কিন্তু বাংলা মাস আগের ক্যালেন্ডার হিসাব থেকে, পরিবর্তিত হয়েছে। যারা বাংলা মাসের হিসাবে চলেন তারা আবার দেশের হিসাবের বাইরে নিজেদের মতন হিসাব করে দিন পালন করেন।
পরিবেশ জলবায়ুর করণে দারুণ খরা গরমের চৈত্র সময়ে দেহে তিতা, ঠাণ্ডা সরবারহ করা হতো আগের সময়ে, সুস্থ থাকার জন্য পরিবেশ চিন্তা করে। অথচ এটা ধর্ম ভিত্তিক হয়ে গেছে এখন জলবায়ুর প্রভাব ভুলে।
ভালো হোক পহেলা বৈশাখ হালখাতার হিসাব এখন উঠে গেছে যদিও। ইলিশ খাওয়াও কোন জরুরী বিষয় না নববর্ষে। আমাদের বাড়িতে পান্তা নয়, ভালো খাবার রান্না হতো নববর্ষের দিনে। আর আগের দিন খুব পরিচ্ছন্ন করা হতো বাড়িঘর সব ধূয়ে মুছে। এখন আমরা প্রতিদিনই এত পরিচ্ছন্ন থাকি, আলাদা করে একদিন পরিচ্ছন্ন করার কোন প্রয়োজন পরে না।
বিদেশে দুবার আমি রাতে ভাতে পানি দিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু পান্তা হয়নি, পানি ভাত হয়েছে আবহাওয়া সহায়ক না পান্তা ভাতের জন্য। দেশের গরমে যে পচে যাওয়ার মতন একটা ঘ্রাণ হয় ভাতে যেটা পান্তার আসল ঘ্রাণ সেটা পাইনি। আর কখনো চেষ্টা করি নাই। করবও না কারণ পান্তা আমার প্রিয় খাবারও না। রমনার মাঠে এমন গরম ভাতে পানি ঢেলে পান্তা বানানো হয় । কয়েকবার আমন্ত্রণ পেলেও কখনও আমার সেই পান্তা খেতে ইচ্ছে হয়নি খাইনি। মানুষদের দেখেছি পান্তা খেয়ে নববর্ষের সুখ উপভোগ করতে।
ইলিশ খাওয়া হোক বা না হোক। সবার জীবনে নববর্ষ সুন্দরের বার্তা নিয়ে আসুক রাত পোহালে। অনেকে আবার জানেন না, বাংলা নববর্ষ সূর্য বর্ষ। সূর্য জাগার সাথে নববর্ষ শুরু হয় তাই রাত বারোটায় পটকা ফুটিয়ে নববর্ষ পালনের কোন যুক্তি নেই। ঘুম থেকে উঠে শুভ নববর্ষ বলে সুন্দর ভাবে দিন শুরু করলেই হবে।
কৃষ্ণচুড়া বৈশাখের ফুল। ছবিটা আমি এঁকেছিলাম বেশ আগে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১২:৩৯