তাদের কথা মনে পরছিল গতকালই। এবার একদিনও তাদের দেখা পেলাম না।ব্যাপার কি ওরা কি আমার সাথে আড়ি দিয়েছে নাকি। দু বছর আগে তো শীতের সারা সময়টা তারা গা এলিয়ে বসে ছিল আমার উঠান জুড়ে।
কারণ ছিল অবশ্য তাদের আসার। আমি দাওয়াত না দিলেও তারা নিজে যেচে দাওয়াত নিয়ে নিয়েছিল। শীতের আগে শেষবারের মতন ঘাস কাটা হয়নি। ঘাস কাটার যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায়। কাজের তো শেষ নেই একটা না একটা চলতেই থাকে। তারপর যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে তা ঠিক করতেও বেশ সময় লাগে। অনেক সময় পার্টস বদলাতে হয়। পার্টস সঠিক সময় পাওয়া যায় না। কারণ এখানে দোকান গুলো অদ্ভুত ভাবে ঋতু ভিত্তিক জিনিসপত্র রাখে। গ্রীষ্ম, শেষ হওয়ার আগেই শরতের জিনিস উঠে আর শরৎ শেষ হওয়ার আগেই শীতের জিনিস চলে আসে দোকানে। এই যে শীত যাই যাই করছে এখন আর শীতের কোন কিছু দোকানে পাওয়া যাবে না। সব উধাও হয়ে যায় দোকান থেকে।বসন্তের আগমীনি বার্তা টের পাওয়া যায় দোকানের সাজ দেখে। ধর্ম ভিত্তিক নানা আয়োজনের সাথে ঋতু ভিত্তিক জিনিস পত্র আসে দোকান জুড়ে।
তাই ঋতুর শেষ মূহুর্তে নষ্ট হয়ে যাওয়া মেশিন ঠিক করা গেলো না আর পার্টেসের অভাবে। এদিকে আধা হাত ঘাসগুলো আপন মনে লম্বা হয়ে ধানগাছের মতন দুলতে লাগল বাতাসে। আর তাদের ডগায় ধানের শিষের মতন ঘাসের গুচ্ছো বীজ। ঘাসের সাথে সাথে আরো নানা রকম উদ্ভিদ ফুল, বীজ দাঁড়িয়ে রইল আঙ্গিনা জুড়ে। এদের মধ্যে কুইন অ্যানের লেস উল্লেখ যোগ্য। সাদা সাদা ফুল হয় দেখতে খুবই সুন্দর লাগে , যেন লেসের এক একটা বুননে বিশাল একটা কাপড় সুন্দর করে সাজানো মাঠ জুড়ে। । যখন অনেক ফুটে এক সাথে আর তাদের গায়ে বসে থাকে লালা লাল গুটি পোকা। এই ফুলের সাথে খুব ভাব যেন এদের। যখনই ফুলের ছবি তুলতে গিয়েছি হাজার হাজার পোকা ফুলের উপর ভালোবাসায় মত্ত দেখতে পাই। কি আনন্দের সংসার। এই ফুলের বীজগুলো বেশ বড়সর হয়। এসব পরিস্কার করে রাখতে পারলে বসন্তকালে সুন্দর একটা উঠোন পাওয়া যায়। নয় তো ঘাসের উঁচু নিচু ডিবি হয়ে যায় আঙিনা জুড়ে। কিন্তু মেশিনের অভাবে পরিচ্ছন্ন করে শহুরে জীবনের কাটছাট ঘাসের সবুজ মাঠ তৈরি করতে পারলাম না সেবার শীতকালের আগে।
শীতের প্রোকপে সব মরে গেলো। শুয়ে পরল মাটি জুড়ে। আবার অনেকে দাঁড়িয়েও রইল শুকনো খটখটে ভাব নিয়ে।
এই বীজ গুলো খাওয়ার জন্যই তারা শীতের শেষে আগমন করল আমার আঙিনায়। পরিযায়ী হয়ে তারা অন্যদেশে যায় না। নিজের দেশেই বরফের মাঝেও বাস করে। অনেকটা আদিবাসী মানুষের মতন।
শীতের শেষের দিকটায় তারা নিজের আস্তানা ছেড়ে খাবারের খুঁজে বেড়িয়ে পরে। হয়তো সঞ্চিত ভাণ্ডার তখন শেষ হয়ে যায়।
একবার শীতে বেশ কিছুদিন বাড়ি ছিলাম না। ফিরে এসে দেখলাম তারা আমার মুরগীর ঘরে বাসা বেঁধেছে। সেবার মুরগীগুলো ছিল না কিন্তু তাদের খাবার বেশ ছিল সঞ্চিত। তাতেই বেশ জীবন যাপন করছিল তারা।
কুইন অ্যান লেস একটি আক্রমণাত্মক আগাছা,এর বিস্তার খুব বেশি এজন্য ক্ষতিকারক আগাছা হিসাবে তালিকাভুক্ত আছে কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে অনেক কিছু বাড়ে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচায় অন্যকে। এরাও অনেক প্রাণীর জীবন ধারনের সহায়ক। আমরা মানুষরা সুযোগ পেলেই এদের তুলে ফেলি যদিও তবে কিছু স্থানীয় প্রাণী খাবারের জন্য ব্যবহার করে এই গাছের বীজ, মধু। শুঁয়োপোকা বেড়ে উঠার আতুর ঘর এই উদ্ভিদ, এই কুইন অ্যানের লেস। অনেক প্রজাপতি এবং মৌমাছি এবং উপকারী কীটপতঙ্গ এই ফুলের মধু খেয়ে বাঁচে।
আমি অনেক মাঠ ভর্তি এই ফুল দেখি গ্রীষ্মকালে, ভাড়ি ভালোলাগে দেখতে। মাঠ ভরা একটা বোনা লেসর কাপড় যেন হাওয়াায় দোলে। গাছের পাতা গুলো অনেকটা গাজরের পাতার মতন। আর ঘ্রাণটাও খুব সুন্দর গাজর লেবুর মিশ্রণের ।
মাঝে মাঝে রক্তলাল ফোঁটা দেখা যায় সাদা এই ফুলে। কিংবদন্তি বলে গ্রেট ব্রিটেনের রানী অ্যানের আঙুলে থেকে রক্ত পরেছিল। তারই চিহ্ন ধারন করে আছে। কুইন অ্যান লেস নামটা নাকি রাণী নিজেই, নিজের নামে দিয়ে ছিলেন এই ফুলের। যদিও একে বুনো গাজর বলা হয় স্থানীয় নামে। আরো দু একটা নাম আছে।
কুইন অ্যান লেস নামটা যেমন বিখ্যাত তেমনি আরো একটা বিখ্যাত নাম আমরা জানি । বিখ্যাত প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে যে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয় সেই হেমলক বিষ, কুইন অ্যান লেসের মতন দেখতে একটি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়। এই দুইটি উদ্ভিদের মধ্যে অনেক বেশি সাদৃশ্য। যদিও সুক্ষভাবে দেখলে গড়মিল অনেকটাই পাওয়া যাবে।
পয়জন হেমলকের কাণ্ডে গাঢ় বেগুনি রঙের দাগ থাকে, আর কুইন অ্যান লেসের একটি শক্ত সবুজ কাণ্ড । কাণ্ডের মতো, কুইন অ্যান লেসের পাতা লোমযুক্ত, আর বিষ হেমলক উদ্ভিদের পাতা ডাল মসৃণ । একই রকম দেখতে ফুলের ভিতরও বেশ পার্থক্য থাকে ফুলের আকৃতিতে ।
আগে গাছ পাতা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পরতাম। তুলে নিতাম, ঘ্রাণ নিতাম। হাতে ধরে থাকতাম ফুল গুলো। এখন জেনে শুনে একটু ভয় পাই চট করে সব কিছু ধরে ফেলতে। একই রকম দেখতে হলেও একটা তে মধু থাকলেও অন্যটায় বিষ ভরপুর। অনেক গাছ থেকে এলার্জিও হতে পারে সবার নয় কারো কারো।
আমরা কত ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা, পড়া লেখা করে চিনতে পারি, জানতে পারি। অথচ প্রকৃতির প্রাণীগুলো কি বিশেষ বুদ্ধিতে জানে এই বিষয় গুলো ভেবে অবাক হই।
যাদের জন্য এত কথা বলা তাদের নামটা এখনও বলা হলো না। এরা হলো বুনো তিতির। এখানে আমরা টারকি বলি এ নামেই বেশি পরিচিত। এক একটার সাইজ কি বিশাল। উট পাখির বাচ্চাও বলা যায়। আমাদের দেশের তিতিরের চেয়ে চারগুণ বড় আর এরা হাঁটতে পারে ভীষণ জুড়ে। এখন আর এদের দেখলে ঘরের বাইরে ওদের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে যাই না। আগে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাছে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। কিভাবে যেন বুঝে ফেলে কেউ এসেছে ক্যামেরা হাতে। যতই সতর্ক থাকি নিঃশব্দ থাকি তারা ঠিক জেনে যায়।
একজন গলা তুলে বলে সাবধান আর সবাই মিলে পা চালিয়ে উধাও হয়ে যায় নিমিশে। তাদের সাথে দৌড়েও আমি পারি না। তাই ঘরে বা গাড়িতে থেকে এদের দেখলে দূর থেকেই ছবি তোলার চেষ্টা করি এখন।
কাল দেখলাম অলস ভঙ্গিতে কয়েকজন বসে আছেন। বরফের উপর পায়ের ছাপ দেখে বুঝলাম তারা বেশ হাঁটা হাঁটি করেছে এক জায়গায়। অনেক্ষণ আমাকে দেখার সুযোগ দিল। তারপর অন্য দিকে হাঁটা দিল।
এই সময় তাদের দেখা যাবে বেশ কিছুদিন। কদিন পরে আবার ছানাপোনা সহ রাস্তা পার হতে থাকবে তখন গাড়ি থামিয়ে তাদের যওয়ার সুযোগ দিতে হবে আগে। খালি রাস্তা পেলেও তাই জোড়ে চলার উপায় নাই। কখন না বলেই কেউ সামনে এসে যায় ঠিক নাই, তাদের ক্ষতির সাথে নিজেরও ক্ষতি হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ৮:১৮