((১))
পল্পের মূল চরিত্র এক বিষন্ন বিকেলে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে- আচ্ছা কোন জিনিস আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই? একটুও না ভেবে যে উত্তরটা মাথায় আসে সেটা অনেকের কাছে খুবই নিরীহ একটা ঘটনা। সেটা নিয়ে একটু পরে বলছি।
সে মারণাস্ত্র ভয় পায়, যদিও ভয়টা পরিমাণে একটু কম। হয়তো কখনো তেমন করে মারণাস্ত্রের সামনে পড়েনি বলে।
রোগ-জীবানু ভয় পায়। তাই কখনো ভুলেও শহরের কলের পানি পান করেনা, বান্ধবীদের সাথে নিরাপদ সম্পর্ক বজায় রাখে।
প্লেনের উড্ডয়ন আর অবতরণের সময় ভয় পায়, যদিও বাকি সময়টা স্বাভাবিক থাকে। সে মনে করে বেশিরভাগ ফ্লাইট ক্রাশ করে উড্ডয়ন আর টেক অফের সময়েই।
আচ্ছা, তার মানে মনুষ সে সব জিনিস ভয় পায় যেগুলোতে তার মৃত্যু হতে পারে। ফ্লাইট ক্র্যাশ করলে মৃত্যু হবেই, এক্ষেত্রে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মারণাস্ত্র-মরণব্যাধি এসবের ক্ষেত্রেও মৃত্যু হতে পারে, আবার বেঁচেও যেতে পারে। এর দু'টাতেই মৃত্যুর আগে হয়তো কিছু সময় পাওয়া যায় যে সময়টাতে মানুষ নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
তার সবচেয়ে বেশি ভয় বজ্রপাতে! এর পেছনে যুক্তিটা এমন- হয়তো সে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে নয়তো বারান্দায় বসে আছে, ফ্ল্যাশ টা চোখে দেখার সাথে সাথেই হাজার ভোল্টের কারেন্টে সে পুড়ে কয়লা! যে বিকট আওয়াজে তার প্রাণ যাবে সেটাও সে শুনতে পাবেনা। একটু ভয় পাওয়া, দৌঁড়ে পালানো বা বেঁচে থাকার চেষ্টা করার আগেই মরণ!
((২))
বেঁচে থাকলে প্রেয়সীদের একটা কমন প্রশ্ন সবাইকেই শুনতে হয়, "আচ্ছা, তোমার ফ্যাভরিট কালার কোনটা?"
আমি হলে প্রশ্নটা এমন ভাবে করতাম, "মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তুমি তোমার চোখে কোন কালারটা দেখতে চাও?"
এমন পাগলাটে প্রশ্ন শুনে অনেকেই হয়তো আমাকে উল্টো বলবে মৃত্যুর আবার কোন রং হয় নাকি!
-জন্মান্ধ ছাড়া আর সবার মৃত্যুর একটা নির্দিষ্ট রং থাকে। আচ্ছা তোমরা কি কখনো মৃত্যু কে খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসেছ? আমি এসেছি। সেদিন বন্ধুদের সাথে একটা পাহাড়ি হ্রদের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রচন্ড গরমে ক্লান্ত হয়ে আমরা অনেকেই যারা সাঁতার জানি তারা নেমে পড়েছিলাম হ্রদে।একসময় অন্যমনস্ক হয়ে সোজা নেমে যাচ্ছিলাম পানির নিচের দিকে।নামতে নামতে একটা স্তরে গিয়ে মনে হল আমার বুকের ভেতর জমানো অক্সিজেন প্রায় ফুরিয়ে আসছে। চারপাশে এক ভুতুড়ে গাড় সবুজ। পানির চাপে আমার কান ফেটে যাচ্ছিল। সংজ্ঞাহীন আমি একসময় অনুভব করি আমার চাপাশের গাড় সবুজটা কালচে হয়ে আসছে। এরপর....
এরপর উদভ্রান্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ি। আমার ফুসফুসে তখন একটু বাতাসও আর অবশিষ্ঠ নাই। জিহ্বাটা দাঁতে কামড়ে রাখি যাতে কোনভাবে সেটা গিলে না ফেলি।
আমার চারপাশের সবুজটাও আমার বেঁচে থাকার সংগ্রামের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে থাকে। কালচে সবুজ, গাড় সবুজ, সবুজ, সবুজাভ এরপর এক ঝটকায় পানির উপরে মাথা তুলে বুক ভরে বেঁচে যাওয়া উপভোগ করি। আর মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে মৃত্যুর কয়েক মুহুর্ত আগের অদ্ভুত এক সবুজ, হয়তো সে সবুজটাই হতে পারত আমার মৃত্যুর রং!
((৩))
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি সম্ভবত, স্কুলের পেছনে ছিল বিশাল উঁচু উঁচু কয়েকটি বুড়ো আম গাছ। গাছগুলো যৌবনে ফলবতী হত কিনা জানিনা তবে শেষে অনেক বছর যে কোন ফল ধরেনি সেটা বোঝা যায় গাছগুলোর দিকে কেউ আমের জন্য লোলোপ দৃষ্টিতে তাকাতনা বলে। একদিন ক্রিকেট বল পাড়তে দোতলার ছাদে উঠে দেখি খুব বড় বড় কয়েকটি আমের থোকা। ঝটপট একটা বাঁশ-বাঁকানো রড আর তার দিয়ে হুক বানিয়ে ফেলি। গাছের ডালে হুকটা লাগিয়ে ডালটাকে ঝাঁকাচ্ছি আর একটু একটু করে নিচে তাকাচ্ছি কেউ মাটিতে পড়া আমগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে কিনা। এরপর ছাদ থেকে আমার সামনের পা'টা শুণ্যে পেতে দিই।
এক সময় হঠাৎ নীরবতা। যেন পৃথিবীটা মিউট করে দিয়েছে কেউ। মিলি সেকেন্ড হয়তো, সেটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হয়। মনে করি আমার শরীরের কোন ভর নেই তবুও নিচের দিকে যেতেই থাকি। তখনি হাতে জাপ্টে ধরি বাঁশটা, আর গাছের ডালে লাগানো মজবুত হুক আমাকে ওপারে পতন থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
একসময় গভীর নীরবতা কেটে গিয়ে আবার বাতাসের শব্দ, গাছে পাখি ডাকার শব্দ আমার কানে আসে। অন্তিম নীরবতার আগে ক্ষণিক নীরবতার অভিজ্ঞতাও কয়জনের ভাগ্যে জুটে!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১১ রাত ২:১৫