কামারুজ্জামানের জম্ম ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই, সেহিসেবে যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল প্রায় ১৯ বছর। একাত্তরে মাত্র উনিশ বছর বয়সেই সে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ (বর্তমানে ছাত্রশিবির) -এর ময়মনসিংহ জেলার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় জামালপুরে গরে উঠা আল বদর বাহিনীর সংগঠক হিসেবেও তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ই আগস্ট ১৯৭১)
জামালপুরে আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল মোট সাতটি, যার মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে গড়ে উঠা ক্যাম্পটি ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামান, জামালপুর আলবদর সাবডিবিশনের প্রধান আব্দুল বারি, আলবদর সদস্য নাসির ও কামরান।প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আহত মুক্তিযুদ্ধাদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে এসে দিনের পর দিন অন্ধকার কুঠুরিতে আটক রেখে পৈশাচিক ভাবে নির্যাতন করা হত। অন্তত ৮০-৯০ জন মুক্তিযুদ্ধা ও নিরীহ বাঙ্গালীকে কামারুজ্জামানের তত্বাবধানে এই ক্যাম্পেই হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া একাত্তরের ২৫ জুলাই সকালে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর নামে গ্রামে কামারুজ্জামানের পরামর্শে আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে। ওই হত্যাযজ্ঞে সোহগপুর গ্রামের ১৬৪ জন পুরুষকে হত্যা করে পুরুষশূণ্য করা হয়। তারপর থেকে গ্রামটি ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। দেশ স্বাধীন হবার পর আবদুল বারির ব্যাক্তিগত ডায়েরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, বন্দি ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেন, উনারা রাজাকার হলে যুদ্ধের পরপরই কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হল না। তাদের উদ্দেশ্যে, দেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাত ১৯৭২ সালের দুই মে শেরপুর জেলার বাসিন্দা ফজলুল হক তাঁর ছেলে বদিউজ্জামানকে হত্যার জন্য কামারুজ্জামানকে দায়ী করে বদিউজ্জামানের বড় ভাই হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ১৮ জন আসামির অন্যতম ছিলেন কামারুজ্জামান। মামলাটির নম্বর ২(৫) ৭২ ও জিআর নম্বর ২৫০ (২) ৭২। অতএব, এখন আর বলার সুযোগ নেই যে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর কোন মামলা দায়ের করা হয় নি। এরপর বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকান্ডের পর এক এক করে সকল রাজাকার মুক্তি পেয়ে যেতে শুরু করে এবং সেই ফাকে কামারুজ্জামানও মুক্তি পেয়ে যায়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গনতন্ত্রের ফায়দা তুলে এই কামারুজ্জামান সরাসরি জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
এরপর ধীরে ধীরে ৩৪ বছর পার হয়ে যায়। অন্যান্য রাজাকারের মত কামারুজ্জামানও দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের মোড়কে গুরুত্বপূর্ন একজন নেতা হয়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক অপমান করে যেতে থাকে। কামারুজ্জামানের দুই পুত্র মুক্তিযুদ্ধাদের অপমান করার পাশাপাশি দেখাতে থাকে তাদের দাম্ভিকতা। এসব দেখে নিরবে সহ্য করা ছাড়া বাঙ্গালীদের আর কিছুই করার ছিল না। সবাই যখন ভেবেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একেবারেই সম্ভব না, ঠিক তখমই ২০০৯ সালে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জাতীয়প সংসদ নির্বাচনে আওয়ামিলীগ পাশ করে। এরপর ২০১০ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ জুলাই, ২০১০ তারিখে কামারুজ্জামানকে পল্লবী থানা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৯ই মে ২০১৩, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেয়।তার বিরুদ্ধে আনীত ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এবং এর মধ্যে ২টি তে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে ২০১৩ সালের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। ২০১৪ সালের ৫ জুন থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর সোহগপুরে গণহত্যার দাযে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে।
এবং অবশেষে ২০১৫ সালের ১১ই এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়। মাত্র দুই জন রাজাকারের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পেরেছি আমরা, আরো অনেকে এখনো বাকি আছে। আশা করি খুব শীঘ্রই তাদেরও শাস্তির ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে পারব আমরা। তবে এমুহুর্তে যে কামারুজ্জামানের রায় কার্যিকর করা গিয়েছে, তাতেই পুরো বাংলাদেশ অনেক সুখি। চিতকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, জয় বাংলা , জয় বঙ্গবন্ধু।