somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের প্রয়োজনে জীবন যেখানে পরাজিত।(চতুরভূজ)

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবারই থাকে শেঁকড় আর সেই শেঁকড় কেবলই মানুষকে নিজের দিকে টানে আমরণ। আমার শেঁকড়েরা গ্রামে থাকার কারণে গ্রামের পথের ধুলো আমিও বেশ মেখেছি। সেই সোঁদা মাটির গন্ধ আজও আমার নাকে লেগে আছে। সেই হলুদিয়া বাজার, গ্রামের মাতব্বরদের শালিস; সন্ধ্যাবেলার হাঁট। সেখানে মুড়কি-নিমকি ভাজা আরও কত কি! জমজমাট হাঁটবেলা শেষে ছোট খালার সাথে ফিরে আসতাম বাড়ি। মামাদের তাসের আসরেও কতবার মামার গা ঘেঁষে বসে থেকেছি। তখনও ইলেক্ট্রিসিটি ছিলোনা। কারও ঘরে জ্বলছে কুপি তো অন্যের ঘরে হারিকেন। সেই টিমটিমে আলোয় স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই সুর করে পড়ার শব্দ- এসকল কিছু আজও কানে বাজে যেন। আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই উঠোনে- যেখানে গাঁয়ের বধূরা গোসলের পর পিঁড়ি পেতে বসে চুল শুকোয়, যেখানে বৃদ্ধাদের পান খাবার আসর বসত, যেখানে দুরন্ত কিশোরেরা বাবলার ডাল চেঁছে ডাংগুলির গুটি বানায়, যেখানে নববধূ তার স্বামীর চিঠি সবার অলক্ষে নিয়ে গিয়ে ঘরের কোনে চুপটি করে পড়ত আর চোখের জল ফেলত, যেখানে ঘর্মাক্ত চাষী একটু জিরিয়ে নিত গাছের ছায়ায়; রাখালের বাঁশির সুর শুনতে শুনতে।

সকাল বেলা চুলে সর্ষের তেল মেখে ভদ্র সেজে স্কুলে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সারী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম কেন আমি ওদের সাথে স্কুলে যেতে পারিনা, কেন আমি ঐ শহুরে দালানের ভেতর বসে পুতুল পুতুল ছেলেমেয়েদের সাথে পড়তে যাই, পিঠে থাকে বিশাল বইয়ের বোঝা! আম্মু কেন তুমি আমাকে ওদের সাথে পড়তে পাঠাওনা! মনের সেই আক্ষেপ মেটাতে আমায় নিয়ে যেত হত বাজারে, বাতাসা আর গান্ধী ঘোঁষের মিষ্টি খাইয়ে তবেই শান্ত করা হত আমায়। আহ! কিযে স্বাদের ছিলো সেই মিষ্টি! আমার সেই গান্ধী ঘোঁষ আর নেই, নেই তাঁর বিখ্যাত সেই মিষ্টিও। কেবল পড়ে আছে আঠালো রসে মুখ মাখামাখির স্মৃতি। আজ হাজার মিষ্টি খেয়েও পাইনা ঐরকম তৃপ্তি! জানিনা, আমার জিভের পরিবর্তন ঘটেছে নাকি ঘটেছে সময়ের পরাজয়।

হাঁট থেকে ফেরার পথে ছোটমামাকে দেখে বেদেনীদের মুচকি মিষ্টি হাসি- ওটা ছিলো মামার কাছে আরও বেশি মিষ্টি। দল বেঁধে ওরা চলত কোমরে বিছা আর পায়ে নুপুর নিয়ে রিনিঝিনি শব্দে। উঁচু করে বাঁধা খোঁপায় থাকতো বেলী ফুলের মালা। মনে মনে ভেবেছিলাম, বড় হয়ে বেদেনী হব। মামাকে বললাম- মামা , ওরা তোমায় দেখে হাসছে কেন? আমার তরুন মামা লাল হয়ে গিয়ে বলেছিলো,
"আমি কেমনে কমু?মনে হয় ওগো হাসি রোগ হইছে।"
- তাইলে ওরা কালিজীবন ডাক্তারের কাছে যায়না ক্যান? কালিজীবন মামাতো খুব মিষ্টি মিষ্টি গোল গোল ঔষুধ দেয়। ঐ ঔষুধ তো তিতা না, ওরা ঔগুলি খায়না ক্যান?
মামা আমার কট কট থামাতে বলে, "চুপ কর, এত কথা শুনলে ওরা ওগো বাক্সের সাপ ছাইড়া দিবোনে, ওরা কিন্তু অনেক পাঁজী।"
চুপচাপ হেঁটে চলতে চলতে ঘুঘুর ডাক শুনতাম আর মনে হত, আমাদের চিটাগাং এর বাসায় কেনো ঘুঘু ডাকেনা এমন করে , কেন পথের মাঝে এক শালিক দেখা যায়না, তাহলে আমি মামার মত বলতে পারতাম - "এহহেরে এক শালিক দেখলাম , আইজকা দিন খারাপ যাইবো।" কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় অজানা এক ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতাম, মামা পড়তেন দোয়া,"আসসালমুআলাইকুম ইয়া আহলাল কবুর"। আমাকেও বলতেন, দোয়া পড় দেখবি ডর করবোনা। আজ আর আমার ডর করেনা, আজ আর মনে হয়না শ্মশান থেকে নীতাই মিষ্ত্রীর ভূতটা বুঝি উঠে এসে বলবে "আম্মা,আপনে দেখতে ঢাকার পাউরুটির মত।" নিতাই মিস্ত্রী মরেছে অচীন রোগে। মৃত্যর আগে তাকে আমার ভয় করত না কিন্তু মরার পরে কেবলি মনে হত সে বুঝি এই আমাকে ধরে কোলো নিয়ে বলবে তার সেই পুরাতন কথা, ভয় করত খুব। আজ আর সেই ভয় নেই, এখন আমি অনেক বড় হয়েছি অনেক বুঝি।

এতকিছু বুঝতে গিয়েই নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা শিশুটাকে গলাটিপে নিজের হাতেই হত্যা করেছি, সবাই যেমন করে! প্রতিটা মানুষের ভেতরই লুকিয়ে থাকে কোমল একটা শিশু। জীবনের প্রয়োজন সেই শিশুটাকে ধীরে ধীরে হত্যা করতে থাকে আর নিজেকে ভুলতে থাকে। তবুও মাঝে মাঝে সেই শিশুটিই জেগে উঠতে চায় সব কিছু ছিঁড়ে ছুড়ে দিয়ে, ভেসে বেড়াতে চায় তার আপন ভুবনে। কিন্তু হায়রে জীবন! হায়রে জীবনের প্রয়োজন! বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ কতদূর চলে আসে , কত বড় হতে চায়! আর কত বড় হব! আমি যে বেদেনী হতে চেয়েছিলাম। আমি বেদেনীই হতে চাই, সভ্যতা আমি চাইনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:০০
১৩৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×