somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার নয়ন বেঁচে থাকুক অন্যের চোখে (চতুরভূজ)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক জোড়া নীল আইরিশ চোখ, একটু পরপর পলক ফেলছে আর চোখের মনিগুলো এদিক সেদিক নড়ছে। ৭/৮ বছরের সেই নীল চোখের অধিকারী বালকের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল এত সুন্দর চোখ কি অশোক পুত্র কুনালেরও ছিল! চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে যখন আমি এসব ভাবছিলাম আর মনে মনে পৃথিবীতে সুন্দর চোখের অধিকারী এবং অধিকারিনীদের চেহারার আদল আমার নিজ চোখে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছিলাম তখন বালক তার হাতের টেনিস বল এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তর করছে আর মা' কে প্রশ্ন করছে "মা, আমার বলের কালার কি রেড?" মা বলছেন, "না, ওটা লেমন ইয়েলো।"
: লেমন ইয়েলো কালার সুন্দর নাকি রেড কালার?
: আমার কাছে লেমন ইয়েলো কালার টা বেস্ট মনে হয়।
: কিন্তু সেদিন যে তুমি বলছিলে, আকাশের রং নীল আর এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রং!
:হ্যাঁ, কিন্তু ওটা কেবল আকাশের জন্যই সুন্দর তোমার টেনিস বলের জন্য নয় ডার্লিং।
: থ্যাংকস মাম, আমাকে সুন্দর কালারের বল কিনে দেবার জন্য।

মা-পুত্রের কথোপকথন শুনে কৌতুহল চেপে রাখতে পারিনি। প্রায় ছয় ফিট উচ্চতার দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী মাতাকে প্রকাশ করলাম, " হি গট বিউটিফুল আইজ"
: Yes but he is blind with his two eyes"

কথা গুলো শুনে আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম, আমার মুখ দিয়ে "সরি" শব্দটিও বেরোল না, আপনা আপনি আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল আর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল আমার পুরো পৃথিবী। কয়েক সেকেন্ডের এই অন্ধকার সহ্য হলনা চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবুজ গাছপালা, বাড়িঘর, ট্রেন ষ্টেশন, উপরের আকাশ সবকিছুর রং গুলোর তীব্রতা যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো, সবকিছু এত রঙীন মনে হচ্ছে কেন? ষ্টেশনের বেঞ্চটাতে তো প্রতিদিনই বসি কিন্তু আজ এত সোনালী মনে হচ্ছে কেন? লাইন ম্যানদের গায়ের জ্যাকেট এত তীব্র কমলা রং এর না হলে কি হত? আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে খেলাম বিশাল এক ধাক্কা, উহ! এত অসহ্য চমত্কার রং এর কারুকাজ! চোখ নামিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। পুরো পৃথিবী জুড়ে রং এর ছড়াছড়ি, এই একটু সময় আগেও আমার চোখে এত রং ধরা পড়েনি!

কিছু কিছু অনুভূতি আছে যা চিরকাল গোপনই থেকে যায়, পৃথিবীর কোন ভাষাতেই তাকে অন্যের সামনে নিয়ে আসা যায়না। আমি এই মূহুর্তে অসহায় বোধ করছি সেই অন্ধ বালকের দিকে তাকিয়ে। মনে পড়ে গেল ক' বছর আগে আমি এক অন্ধ ভিখেরীকে ৫ টাকা দেব বলে বের করে পরে ২ টাকা দেই বাকি ৩ টাকা রেখে দেই আবার আরেক ভিখেরীকে দেবার জন্য। তখন ভাবতাম ভিক্ষুকদের পয়সা দিলে সওয়াব হবে, এই লোভে পয়সা দিতাম। আমার দু'টাকায় সে আনন্দ পাবে একথা ভাবতামনা! একবারের জন্য মনেও আসতো না আমার সামনের জীর্ণ বস্ত্র পরিহিত এই লোকটির কাছে দিন-রাত সবই সমান, তার কাছে সবই কালো, সুন্দর এই পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য তার হলনা, রঙে রঙে রঙীন আমার চমত্কার পৃথিবীকে না দেখেই তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে অন্য ভূবনে। সে জানলো না আকাশের রং কি, মাঠের সবুজে কতটা তীব্রতা, সে জানলো না সাগরের রং এর রহস্যময়তা! অদ্ভুত সুন্দর দুনিয়া তার কাছে অচেনাই রয়ে গেল!

নিজের চোখ দুটো আজ আমার কাছে এত মূল্যবান মনে হচ্ছে যা আর কোন কিছুকেই মনে হচ্ছেনা। বাসায় ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার কেবল চোখের দিকেই তাকাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমায় এত সুন্দর একজোড়া চোখ দিয়েছেন! আমার চোখের মত প্রিয় কোন কিছুই নয় আমার কাছে! ভাবলাম, আমি যদি অন্ধ হতাম তবে আমার অনুভূতি কেমন হত! পরক্ষনেই নিজেকেই নিজে বললাম, এসব কি অলক্ষুণে কথা ভাবছি? মহান আল্লাহ তায়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য! আর যারা জন্মান্ধ তাদের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি একটা প্রশ্নও রাখলাম। যদি কখনও আমরা মুখোমুখি হই তবে তাঁকে জিজ্ঞ্যেস করে জেনে নেব।

ঐ ধনী বালক তবু অর্থের সহায়তায় কিছুটা হলেও মানবিক পরিচর্যা পাবে, কিছুটা হলেও পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে কিন্তু আমার দেশের অন্ধ শিশুদের কথা কি কেউ ভাবে, যারা চরম অবহেলিত জীবন কাটায়? জন্মের পর থেকেই যারা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতাকে নিত্য সঙ্গী করে বড় হয় আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিগৃহীত অবস্থাতেই অন্যের বোঝা হয়ে বড় হয়। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও যাপন করে অমানবিক জীবন! যে শিশু জন্মের পরে দেখতে পায়না তার জন্মদাত্রী মায়ের চেহারা কেমন, যে শিশুর বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার থাকে পৃথিবীকে একটিবারের জন্য দুচোখ ভরে দেখার , যে শিশু জানে সবাই সব কিছু দেখছে কেবল আমিই কিছু দেখছিনা সেই শিশুর জন্য কি আমরা কিছু করতে পারিনা?

আমি হয়ত বেঁচে থাকতে কিছু করতে পারব না, তবে মৃত্যুর পরেতো কিছু করতে পারব! প্রতি বছর পৃথিবীর অসংখ্য মানবিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের কর্ণিয়া দান করে যান। তাঁদের দান করা সেই কর্ণিয়ার সোংযোজন দ্বারা চোখের আলো ফিরে পায় অসংখ্য অন্ধ মানুষ। আপনার আমার চোখ বেঁচে থাকতে পারে যুগ যুগ অন্যের চোখের আলো হয়ে। আমরাই পারি ওদেরকে সুযোগ করে দিতে সুন্দর এই পৃথিবী দেখার। আসুন আমরা মানবিকতার এই শ্রেষ্ঠ অবদান কে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখি এবং উৎসাহিত করি মরোনোত্তর চক্ষু দানকে।


(আমি জানি, ব্যাপারটি অতটা সোজা নয় যতটা মুখে বলা হচ্ছে। সাথে ধর্মীয় অনেক বিধি নিষেধের কথাও আসতে পারে কিন্তু তারপরও , তারপরও আসুন একটু সাহস করি এই পদক্ষেপটি নিতে কেবল মাত্র ঐসব শিশুদের কথা স্মরণ করে।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:৪১
৭২টি মন্তব্য ৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×