somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুরুপের তাস এনআরসি

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তুরুপের তাস এনআরসি। ভারতবর্ষের নাগরিককে একবার বোঝাতে পারলেই হলো, দেশের এই আর্থিক মন্দার মূল কারণ অনুপ্রবেশকারীরা। তারাই দেশের অর্থব্যবস্থাকে দিনে দিনে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। চারিদিকে চাকরী নাই, কর্মসংস্থান নাই। কারণ অনুপ্রবেশকারী। মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নাই। কারণ অনুপ্রবেশকারী। মেয়েদের উপর এত নির্যাতন, অত্যাচার। কারণ অনুপ্রবেশকারী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আপামর জনসাধারণকে এই প্রচারে প্রভাবিত করা সহজ। কারণ জনসাধারণ মাত্রেই দেশের উপর একটি ভালোবাসা থাকে। সেই জনসাধারণ যদি বিশ্বাস করে, এই অনুপ্রবেশকারীদের কারণেই দেশের অবস্থা বেহাল; তাহলে জনসাধারণ প্রচারকারীদের পক্ষেই সমর্থন জ্ঞাপন করবে সন্দেহ নাই। ‘অনুপ্রবেশ-তত্ব’ প্রচারকারীদের এই সহজ সূত্রটা খুব ভালো ভাবেই জানা আছে। আর সেই কারণেই অনুপ্রবেশ তত্বকে সামনে রেখেই এনআরসি করার বিষয়ে এমন দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে চলছে সরকারে ক্ষমতাসীন দল।

অথচ সারা দেশে প্রকৃত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত, সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেই সঠিক কোন তথ্যও নাই। অনেকেই বলবেন, ঠিকই তো সরকার তো সেই কারণেই সঠিক তথ্য যাচাই করতেই এনআরসি করার কথা চিন্তা করেছে। পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে, ঠিক এমন ভাবেই দেশের ভিতর কালো টাকার মোট পরিমাণ কত জানতেই সরকার নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তারপর মোট কত কালো টাকা ধরা পড়েছে, সেই তথ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কই জানিয়ে দিয়েছে। তখনই দেখা গিয়েছে, নোট বাতিলের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় সরকারের মোট খরচ হয়েছে ধরা পড়া কালোটাকার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে। এইখানেই বর্তমান সরকারের অভিনবত্ব। যাঁরা ভাছেন, আসলে এটা সরকারের ব্যার্থতা, তারা নোট বাতিলের আসলে কারণ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন। নোট বাতিলের আগে পরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট ব্যক্তিত্ব। এখন দেশের সরকার জানতো, দেশের জনগণ ব্যাঙ্কে টাকা গচ্ছিত রাখলেও, একটা ভালো রকম নগদ অর্থ নিজের বাড়িতেই রেখে থাকে। সারাদেশের সেই হিসাবটাই পনেরো লক্ষ কোটি টাকা। যে টাকাটি অর্থ ব্যবস্থায় কোনভাবেই লগ্নী করা হয় না। জনসাধারণের ঘর থেকে এই বিপুল পরিমাণ নগদ সরাসরি বাধ্যতামূলক ভাবে, ব্যাংকে টেনে নিয়ে আসার জন্যেই পাঁচশ আর হাজার টাকার নোট বাতিল করা হয়েছিল। এর ফলে, এক লহমায় ব্যংকের ঝুলিতে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢুকে গেল। ফলে ব্যাংক তার নগদ জমার উপর ভিত্তি করে জনগণের গচ্ছিত টাকার উপর সুদের হার কমিয়ে দিতে পারলো সহজেই। এটা অর্থনীতির প্রাথমিক নিয়ম। আর দ্বিতীয়ত, এবার ব্যাংক থেকে নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে পারবে সরকারের গুডবুকে থাকা আরও বেশ কিছু কেস্টবিষ্টুরাও। এবং তাদেরকে সেই কাজেই উৎসাহ দিতেই ইতিমধ্যেই সরকার নতুন নিয়ম আনতে চলেছে, বাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থের একলক্ষ টাকা অব্দি সরকার গ্যারান্টার থাকবে। তার বেশি টাকার গ্যারান্টার থাকবে না সরকার। ফলে, আরও বেশি করে ব্যাংক লুঠ হলে সরকারের কোন দায় থাকবে না। বরং সরকারের গুডবুকে ওঠার লাইনটা কিছুটা দীর্ঘ হতে পারে মাত্র। হ্যাঁ এটাই ছিল নোটবাতিলের আসল উদ্দেশ্য। যে লক্ষ্যে সরকার সম্পূর্ণ সফল।

এনআরসিও অনেকটা তেমনই একটি প্রকল্প। যার মূল লক্ষ্য দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী তাড়ানো নয় আদৌ। এটি খুব সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, এনআরসি করে যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে, তারা অনুপ্রবেশকারীই হন, কিংবা বৈধ কাগজপত্র সংরক্ষিত করে না রাখতে পারা নাগরিকই হন, তাঁদের কাউকেই ভারতবর্ষ থেকে বার করে দেওয়া সম্ভব হবে না। হবে না কারণ, প্রতিবেশী কোন দেশই তাদেরকে নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে নেবে না। ইতিমধ্যেই আসামে ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানো ঊনিশ লক্ষ মানুষ সম্বন্ধেই বলা হয়েছে, কাউকেই ভারত থেকে বার করে দেওয়া হবে না। তাদের ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। তাহলে কি উদ্দেশে এই এনআরসি বা এনআরআইসি?

লক্ষ্য করে দেখতে হবে, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করে, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলেই এনআরসি করার কথা বলা হচ্ছে। এখন, কারা এই অনুপ্রবেশকারী? অনুপ্রবেশকারী তারাই যাঁরা ২০০৩ সালের নাগরিক সংশোধনী আইন অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই রাত্রি ১২টার পর ভারতে আসা যেসকল মানুষ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন করে নাগরিক সনদ নেননি। তাঁরা সকলেই অনুপ্রবেশকারী, অর্থাৎ ভারতীয় নগরিক নন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ভাগ বাটওয়ারার পর, ভারতীয় বর্তমান রাজনৈতিক সীমানার ভিতরে প্রবেশ করা ভুতপূর্ব ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের ভিতর, বেশির ভাগ মানুষই ছিল বাঙালি। আর তারপর পাঞ্জাবী। মনে রাখতে হবে, পাঞ্জাবীদের যেভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল, বাঙালিদের ক্ষেত্রে সেভাবে হয় নি। এবং পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা মানুষের বেশির ভাগই কিন্তু ঐ ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের আগেই এপারে চলে এসেছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে আসা বেশির ভাগ মানুষই স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলি জুড়েই দিনে দিনে আসতে থাকে। যার শেষ ভাগ আসে ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। এবং স্বভাবতঃই তাদের বেশির ভাগের কেউই সরাসরি ভারতীয় সরাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন করে নাগরিক সনদ নেননি। নেননি কারণ, তৎকালীন পরিস্থিতি নেওয়ার উপযুক্ত ছিল না। সেইসময়ে সরকারী রেশনকার্ডই ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ গ্রাহ্য হতো। আর সেই রেশনকার্ডই ছিল মানুষের কাছে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রধানতম বৈধ নথি। এবং সেই নথির বলেই তাঁরা বছর ভর ভোটাধিকার বলে বিগত সাড়ে সাত দশক ব্যাপি বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কেন্দ্রে ও রাজ্যে বৈধ সরকার গঠন করে এসেছেন। এখন তাদের সেই নথিই বৈধ বলে গ্রাহ্য করা হবে না। মূল খেলাটি এইখানেই। গ্রাহ্য করা হবে না, আজকের ভারতীয় ভোটার কার্ড আধার কার্ড প্যান কার্ড রেশন কার্ড। এইসকল নথিগুলির কোনটা দিয়েই ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যাবে না। আসামে ঠিক সেইটিই হয়েছে। আসামের ক্ষেত্রে শুধু, ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের বদলে ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ ছিল নির্ধারিত দিন।

ফলে এইসকল নিয়মের বেড়াজালে ফেলে কোটি কোটি বাঙালিকেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিয়ে, তাদের বৈধ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া সম্ভব হবে এই এনআরসি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই। যত সংখ্যক বাঙালিকে এই আইনের কব্জায় বেনাগরিক করে দেওয়া সম্ভব হবে, ভারতের অন্য কোন জাতির ক্ষেত্রেই তেমনটি করা সম্ভব হবে না। এনআরসি করে একজন অসমীয়কেও বেনাগরিক করা হয় নি। অসমবাসীদেরকে ওরিজিন্যাল ইণ্ডিয়ান ইনহ্যাবিট্যান্ট ধরে নিয়ে তাদের কাছ থেকে ১৯৭১ সালের আগের কোন নথি চাওয়া হয় নি। তাদের ভাষাই তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কারণ অসমীয় ভাষা প্রতিবেশী বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের মাতৃভাষা নয়। আর এইখানেই অনুপ্রবেশকারী তত্বের মূল খেলাটি। ভারতের অন্যান্য সকল ভাষার ভিতর একমাত্র বাংলা ভাষাই প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা। ফলে বাংলাভাষী মানুষ মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী হতেই পারেন। সেই কারণেই আসমে সফল ভাবে এনআরসি করার পর, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার জন্য এত আয়োজন। মনে রাখতে হবে, সেই সাথে সারা ভারতেই এনআরসি করার ঘোষণা এই কারণেই যে, বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের প্রবাসী বাঙালিদেরকেও এই এনআরসির আওতায় নিয়ে আসা। এইভাবে প্রতিটি বাঙলাভাষী মানুষের নাগরিকত্ব পরীক্ষা করা হবে।

কিন্তু কেন এই পরিকল্পনা? এই পরিকল্পনার মূলে রয়েছে বাঙালি বিদ্বেষ। এই পরিকল্পনার ভিতর রয়েছে একটি গুপ্ত অভিসন্ধি। অনেকেই বলবেন। শুধু বাংলা ভাষাই কেন? ঊর্দ্দু ভাষাও তো প্রতিবেশী অন্য একটি দেশের রাষ্ট্র ভাষা। একদম ঠিক। কিন্তু এখানে একটি বিষয় রয়েছে। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ৪৭এর দেশভাগের ফলে, পাকিস্তানের ঊর্দ্দুভাষী মুসলিম সম্প্রদায় বা বাংলাদেশের বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নিশ্চয় নিজের ভিটেমাটি স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি পরিত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে আসেন নি। তাই নাই? এখন পাকিস্তান থেকে চলে আসা ঊর্দ্দুভাষী হিন্দুর সংখ্যা নিশ্চয়ই বাঙালি উদ্বাস্তু হিন্দুর সংখ্যার তুলনায় নগন্য ছিল। এটা ইতিহাস। যদি তা না হতো তবে ভারতেই ঊর্দ্দুভাষী হিন্দুদের জন্য পৃথক একটি রাজ্যের দাবি উঠতো। তা ওঠেনি। আবার ভাষাগত নৈকট্যের কারণেই ভারতে ঊর্দ্দুভাষী আর হিন্দীভাষী পরস্পরের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। পরস্পরের কথা বুঝতে পারার কারণে। যেকারণে ঊর্দ্দুভাষী হিন্দুদের পক্ষে বিগত সাত আট দশকে হিন্দীকে নিজেদের মাতৃভাষা করে নেওয়াও বিচিত্র নয়। যেহেতু হিন্দীভাষার সাথে হিন্দুত্বের যোগ অনেক সুদৃঢ়। তাহলে পড়ে রইল ঊর্দ্দুভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী। স্বভাবতঃই তারা কিছু সংখ্যায় পাকিস্তানে চলে গেলেও, বেশিরভাগই শতশত বছর ধরে আজকের ভারতেরই বাসিন্দা। সেটি আমরা সকলেই জানি। আর পাকিস্তান থেকে দেশভাগের কারণে দুই একজন ব্যাতিক্রম ছাড়া ঊর্দ্দুভাষী মুসলিম ভারতে অনুপ্রবেশ করেছেন, এটা নেহাতই কষ্টকল্পনা।

এনআরসির প্রবক্তরা ইতিহাসের এইসব খুঁটিনাটি অত্যন্ত খুঁটিয়েই পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন। তারা নিশ্চিত হয়েছেন এনআরসি প্রক্রিয়ায় এইপথে একমাত্র কোটি কোটি বাঙালিদেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এত বেশি পরিমাণে, অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনের নাগরিকত্ব চলে যাবে না। আর এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই তারা সারা ভারতে এনআরসি হবে বলে হুঙ্কার দিয়েছেন। কিন্তু কেন তাদের এই বাঙালি বিদ্বেষ? সেটি বুঝতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের ধারা ও জনবিন্যাসের অর্থনেতিক অবস্থাও বুঝতে হবে ঠিকমতো। স্বাধীনতার পরে পূর্ব বাঙালা থেকে যেমন কোটি কোটি বাঙালি হিন্দু এই পারে চলে এসেছেন, ঠিক সেইরকমই স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে, সারা ভারতের নানা জাতির নানান ভাষার মানুষই এই বঙ্গে এসে স্থায়ীভাবে রাজ্যবাসী হয়ে রয়েছেন। এবং পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিক থকে এই অনুপ্রবেশ দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। চলেছে ব্যাপক ভাবেই। আর এই বিষয়ে বিশেষত বিহার ও উত্তরপ্রদেশের হিন্দীভাষী জনগনের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আজকের পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের ধারাতে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ অবাঙালি। তারপরেই রয়েছে ঊর্দ্দুভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী। এরাও বহু যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেছে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। সরকারী স্তরে এই জনবিন্যাসের তথ্য সঠিক ভাবে সংগ্রহ করলে দেখা যাবে, বর্তমানে এই রাজ্যে অবাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশের মতো হবে। মনে রাখতে হবে, এরা সকলেই কিন্তু এরাজ্যের ওরিজিন্যাল ইণ্ডিয়ান ইনহ্যাবিট্যান্ট হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। কারণ, তাদের কারুরই ভাষা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়। ফলে তারাই এই রাজ্যের ওরিজিন্যাল ইণ্ডিয়ান ইনহ্যাবিট্যান্ট। বাকি যে প্রায় সত্তর শতাংশের মতো বাংলাভাষী বাঙালি এই রাজ্যের বাসিন্দা তাদের ভিতরেই কয়জন বাংলাদেশ আগত অনুপ্রবেশকারী, সেটি ধরতেই ভারতজড়ে এই এনআরসি চালু করার হুঙ্কার। ইতিহাসের পরিহাসে, এই প্রায় সত্তর শতাংশের ভিতর একটি বড়ো অংশই বাংলা ভাগের ফলশ্রুতিতে ভিটেমাটি ফেলে চলে আসা বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী। যারা তখনও বাংলাতেই ছিলেন। বাংলাভাগের ফলে আজ বাংলার পূর্ব অঞ্চল ছেড়ে পশ্চিম অঞ্চলে এসে বাস করছেন। সেই একই বাংলা ভুখণ্ডে। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাসে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবেই দিন যাপন করছেন। এই এঁদেরকেই আজ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে ধরা হচ্ছে। এখন সরকার তো আর মুখের কথায় অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দিতে পারে না। তাকে প্রমাণ জোগার করতে হয়। সেই প্রমাণ জোগার করার জন্যেই বলা হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের কথা। কারণ তার পূর্বের বৈধ সরকারী নথিপত্র আজ এমনিতেই অনেকের কাছে থাকার কথা নয়। যাঁরা সেদিন এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আজ আর জীবিত নন। যাঁরা বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগই বার্ধক্যজনিত অবস্থায় ধুঁকছেন। এই অবস্থায় আজকের প্রজন্মের কাছে ১৯৪৮ সালের পূর্বের বৈধ নথি দেখানো প্রায় অসম্ভব। আরও অসম্ভব তৎকালীন সময়ে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন করে পাওয়া নাগরিক সনদ দেখানো। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, সেই সময়ে একটি ভারতীয় রেশনকার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হতো। এইসবই এনআরসি’র প্রবক্তরা খুব ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই অত্যন্ত সুপরিকল্পনা করে এই ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের কথা বলা হয়েছে। এবং রেশনকার্ড, আধারকার্ড, ভোটারকার্ড, প্যানকার্ড ইত্যাদির কোনটিকেই নাগরিকত্বের প্রমাণ বলে ধার হচ্ছে না। অর্থাৎ এইভাবেই সুপরিকল্পনা করে এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে কোটি কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু হিন্দুই এই নিক্তিতে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবে।

না শুধুই তারাই নয়, চৌদ্দপুরুষ পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুরা সকলেই যে ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাইয়ের আগের বৈধ সরকারী নথিপত্র দেখাতে পারবেন, বিষয়টি তেমন নয় কিন্তু। কজনের পক্ষে সম্ভব, আজ থেকে সত্তর আশি বছর আগেকার সরকারী নথিপত্র সংরক্ষণ করে রাখা? ফলে তাদের ভিতর থেকেও কয়েক কোটি বাঙালি হিন্দু এনারসি’র তালিকা থেকে বাদ যাবেন। ঠিক একই ভাবে বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি মুসলিমও অত পুরাতন নথিপত্র দেখাতে ব্যার্থ হবেন। ফলে তারাও ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাবেন। বাকি থাকলো পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অবাঙালি হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী। অবাঙালি হিন্দুরা ওরিজিন্যাল ইণ্ডিয়ান ইনহ্যাবিট্যান্ট হওয়ায়, তাদের মুখের ভাষাই তাদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে ধরা হবে। ফলে তাদের নামই সকলের আগে এনআরসি’র তালিকায় উঠবে। আর পশ্চিমবঙ্গের ঊর্দুভাষী মুসলিমরাও তাদের ভাষার কারণেই এই তালিকায় নাম তুলে ফেলবেন। কারণ ঊর্দ্দু পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশর রাষ্ট্র ভাষা নয়। তাই বাংলাদেশ থেকে তাদের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা শূন্য। আর তারা পাকিস্তান থেকে দেশভাগের কারণে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসেছেন, এমন কষ্টকল্পনা নিশ্চয় কেউই করবেন না। এনআরসি’র প্রবক্তারা এইসবই খুব ভালো করে জেনে বুঝে সেইমত ঘুঁটি সাজিয়েছেন। কিন্তু কি তাদের আসল উদ্দেশ্য?

মূল উদ্দেশের বিষয়ে আলোকপাত করার আগে দেখে নেওয়া যাক, আসামে এনআরসি’র বর্তমান প্রবক্তাদের ভুমিকা কিরকম ছিল। আসামে তারা ক্ষমতায় আসার আগে, আসামে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে আসামে এনারসি করে বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরক্ষিত করবেন। সেখানে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দু মাত্রেই তাদের বরাভায়ে বিশ্বাস করে হাত খুলে তাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। সেখানে বাঙালিরা বিশ্বাস করেছিল, এনআরসি করে আসাম থেকে বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদেরকেই খেদানো হবে শুধু। এবং আসামে তাদের বসবাস করার অধিকার ভারতীয় নাগরিক হিসাবেই সুরক্ষিত থাকবে। ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা খেয়াল করেন নি, তাঁদের কাছে থাকা কোন কোন বৈধ নথিপত্র এনআরসিতে গ্রাহ্য হবে আর কোনগুলি গ্রাহ্য হবে না। তাঁরা বুঝতেও পারেননি, পঞ্চাশ বছর আগের নথিপত্র না দেখাতে পারলে হিন্দু মুসলিম বিবেচনা করা হবে না। শুধুমাত্র মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার কারণেই বাঙালির ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। এ ছিল তাদের দুঃস্বপ্নেরও অতীত। কিন্তু বাস্তবে ঠিক সেটিই হয়েছে। প্রথমে চল্লিশ লক্ষ বাঙালির নাম এনআরসি’র তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরে মাথা পিছু প্রায় হাজার কুড়ি টাকা খরচ করে বিস্তর ছোটাছুটি করে তাদের ভিতর কুড়ি একুশ লক্ষ বাঙালি তাদের নাম এনআরসি’র চুরান্ত তালিকায় সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই ছিল অসমে এনআরসি’র প্রবক্তাদের ভুমিকা।

এবার দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা ঠিক কিরকম। এখানে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের আগে এনআরসি’র প্রবক্তাদের সাকরেদরা হুঙ্কার দিলেন, তাঁরা এনআরসি করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই কোটি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দেবেন। যার হাতেনাতে ফল মিলল, পরবর্তী লোকসভা ভোটে। তাদের দল পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যা দুটি থেকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে এক লাফে আঠারোতে বাড়িয়ে নিতে পারলো। পারলো কারণ, তারা পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের ধারাটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। আর পেরেছিলো বলেই দুই কোটি বাঙালিকে অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছিল। অনেক আটঘাট বেঁধেই। এখন দেখা যাক, তাদের এই সঠিক হিসাবনিকাশের ভিত্তিটা ঠিক কি? কোন মন্ত্রবলে তারা বুঝতে পেরেছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই কোটি বাঙালিকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার ঠিকমত দিতে পারলেই এইরাজ্যে তাদের রাজনৈতিক জমি এমন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। আমরা আগেই দেখিয়েছি, পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের ধারাটি কিরকম। ফলে স্বভাবতঃই এই রাজ্য থেকে দুই কোটি বাঙালিকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিলে সকলের প্রথমেই রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ অবাঙালি জনসাধারণ, যারা দশকের পর দশক জুড়ে রাজ্যে অনুপ্রবেশ করে জায়গা জমি রুজি রোজগার অর্জন করে নিয়েছে; তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সমর্থন করবে। তাদের কার কি ধর্ম, কার কোন ভাষা, এইসবগুলির কোনটাই বিচার্য্য বিষয় হবে না। হয়ও নি। কারণ একটিই। তারা সকলেই অবাঙালি। এবং কারুরই ভাষা বাংলা নয়। এই ভুখণ্ডে তারাই আসল অনুপ্রবেশকারী। আর অনুপ্রবেশকারী মানসিকতায়, তারা তো এমন একটি দিনের স্বপ্নই দেখতে চাইবে, যেদিন তারাই এই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। একচোটে দুইকোটি বাঙালিকে যদি রাজ্যছাড়া করা যায়, তবে তো রামরাজত্ব কায়েম করা সম্ভব হবে। ফলে অবাঙালি হিন্দুমাত্রেই এনআরসি হওয়ার স্বপ্নে এনআরসি’র প্রবক্তাদের বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছে। সাথে যে অবাঙালি মুসলিমরাও সমর্থন জানায় নি, এমন কথা বলো যায় না। কারণ, তাদেরও স্বপ্নে রয়েছে এইরাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠার।

কিন্তু, শুধুই কি অবাঙালিদের ভোটে এমন অভাবিত জয় সম্ভব ছিল? যেখানে এই রাজ্য থেকে হিন্দুত্ববাদী কোন দল এর আগে কোনদিন এত বিপুল জনসমর্থন পায়নি? না, সম্ভব ছিল না। থাকলে শুধু অবাঙালিদের ভোটের উপরেই নির্ভর করে তারা বহুবারই নির্বাচনে এতগুলি আসন পেতে পারতো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা পূর্বে কখনোই হয় নি। তাহলে এবার হলো কি করে? হলো তাদের ঐ এনআরসি করে দুই কোটি অনুপ্রবেশকারী বাঙালি তাড়ানোর হুঙ্কারেই। অবাঙালিদের মতোই, চৌদ্দোপুরুষ পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করা বাঙালি হিন্দুরা এইবার নড়েচড়ে বসলো। তাদের অনেকের ভিতরই স্বাধীনতার পর আগত পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর সম্বন্ধে একটা বিদ্বেষ রয়ে গিয়েছে। তার কারণ, পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গাজমি দখল করে নিয়েছে। রাজ্যে নানা পেশায় ও চাকুরিতে জায়গা দখল করে নিয়েছে। এবং নানান প্রতিযোগিতায় অত্যন্ত সফল ভাবে এগিয়ে গিয়েছে। ফলে তাদের ভিতর থেকে দুকোটি মানুষকে যদি সত্যই রাজ্যছাড়া করা যায়, তবে দীর্ঘ আট দশকের দহনজ্বালা কিছুটা জুড়াতে পারে। আবার তাদের জমি জায়গাও পুনর্দখল করা গেলে, সেতো হবে পোয়েটিক জাস্টিস। ফলে তাড়াও এনআরসি’র স্বপক্ষেই রায় দিতে এনআরসি’র প্রবক্তাদের নির্বাচনে জিততে দুই হাতে ভোট দিয়েছে। পাঠক যদি মনে করেন, এতেই এমন ম্যাজিক্যাল এফেক্ট হয়েছে, তাহলে ভুল হবে। কারণ এনআরসি করে অনুপ্রবেশকারী তাড়ানোর হুঙ্কারে সাত দশক আগে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের আজকের প্রজন্মের আনেকেই এনআরসি’র পক্ষে রায় দিয়েছেন। কারণ একটিই। তাঁরা মনে করছেন, এনআরসি’তে হিন্দুদের চিন্তা করার কিছুই নাই। তাঁরা বিশ্বাস করনে, বিগত সাত দশকে প্রচুর বাংলাদেশী মুসলিম এই বাংলায় অনুপ্রবেশ করে করেকম্মে খাচ্ছে। তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ত্যাগ করে চলে আসার কারণ হিসাবে তাদের কাছে বাংলাদেশী মুসলিম জনগোষ্ঠীই দায়ী। তারাই সেদিন ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের জায়গাজমি কেড়ে নিয়ে ভারতে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বিশ্বাস থেকেই এঁরা মুসলিম বিদ্বেষ পোষন করেন অন্তরে। ফলে তাঁরাও সেই দলকেই ভোট দিতে চেয়েছেন, যারা এনআরসি করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

হ্যাঁ পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসের ধারায়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠরীর এইসকল জনচেতনার পরতগুলি সম্বন্ধে এনআরসি’র প্রবক্তরা বিষেশজ্ঞ বললেও কম বলা হয়। তাই তারা অত্যন্ত হিসাব করেই দুইকোটি বাঙালিকে অনুপ্রবেশকারীর তকমা দিয়ে ভারতছাড়া করার হুঙ্কার দিচ্ছেন নিয়ম করে। তাদের জনসমর্থনের ভিত্তিটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থাকলে, তারা কখনোই এমন হুঙ্কার দিতেন না। এবং সাম্প্রতিক লোকসভায় এমন চমৎকার ফলও পেতেন না হাতেনাতে। এখানেই তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৃষ্টান্ত। আর সেই কারণেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এই এনআরসি করার বিষয়টিকেই তুরুপের তাস করে নির্বাচনে জিতে রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখল করতে তারা শান দিচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। বাঙালি হিন্দুকে তারা অত্যন্ত সফল ভাবে বোঝাতে পেরেছেন যে, হিন্দুদের কোন ভয় নাই। তারা সকল হিন্দুশরণার্থীদেরকেই ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর সেই কারণেই তারা সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট এক্ট প্রবর্তন করলেন। এই এক্টের সফল প্রচারই হবে তাদের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রধানতম হাতিয়ার। বাঙালি হিন্দুদের ভিতর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের বর্তমান প্রজন্ম একবারও প্রশ্ন করছে না, তবে কি তারা ভোটারকার্ড দেখিয়ে এতদিন যে ভোট দিয়ে আসছে, সেকি ভারতীয় নাগরিক হিসাবে নয়? একটি দেশের নাগরিক না হলে ভোট দেওয়া যায়? আর নাগরিক হলে, তাকে কেন নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে হবে রাষ্ট্রের কাছে, যে রাষ্ট্রই তাকে ভোটাধিকার প্রদান করেছে? এই সামান্য সাধারণ জ্ঞানের কোন নিদর্শন দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ফলে বাঙালি হিন্দুর দিবানিদ্রার কোন ব্যাঘাত হয়নি এখনো। বরং সে তার গোষ্ঠীবদ্ধ মানসিকতায় সেই গোষ্ঠীর মতোই সুখস্বপ্নে মশগুল হয়ে অপেক্ষা করছে কখন চালু হবে এনআরসি। অবাঙ্গালি মুসলিম জনগোষ্ঠী বিষয়টি নিয়ে ততটা চিন্তিত নয়। কারণ তাঁরা জানেন, তাঁদের ভাষাগত কারণেই তাঁদেরকে বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়ার কোন উপায় নাই। তাঁরাও অবাঙালি হিন্দুদের মতোই ওরিজিন্যাল ইণ্ডিয়ান ইনহ্যাবিট্যান্ট হিসাবেই নিজেদের জায়গা জমি নাগরিকত্ব রক্ষা করতে পারবেন। আশু মুশকিলটা বুঝতে পেরেছে একমাত্র বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী। তাঁরা চিন্তিত চৌদ্দপুরুষ পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হয়েও সঠিক নথিপত্র না দেখাতে পারলে তাঁদেরকেও ভাষা ও ধর্মের পরিচয়ে অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে তাঁদের জমি জায়গা থেকে উৎখাত করে হয় দেশছাড়া করে দেওয়া হবে, নয়তো আটকিয়ে রাখা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। এইকারণেই তাঁরাই মূলত প্রতিবাদে পথে নেমে পড়েছে।

সর্বশেষে আসুন দেখা যাক এই এনআরসি’র আসল অভিমুখ কোনদিকে? আসামের ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টা সম্বন্ধে সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল। অহমীয় অস্মিতাকে স্বীকৃতি দিতেই সেখানে বাঙালি হিন্দু মুসলিমদের বেনাগরিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি কেন? এইরাজ্যে তো আর বাঙালি খেদাও আন্দোলন হয়নি আসামের মতো। যে সুপ্রীমকোর্টের তত্বাবধানে এনআরসি করে দুই কোটি বাঙালি তাড়াতে হবে। তাহলে? আসলে আসামে এনআরসি’র সাফল্যেই মাথা ঘুরে গিয়েছে চরম হিন্দুত্ববাদীদের। যাদের মূল স্লোগানই হলো হিন্দু-হিন্দী-হিন্দুস্তান।

আমরা পূর্বেই দেখে নিয়েছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান জনবিন্যাসের আসল ছবিটা ঠিক কি রকম। পশ্চিমবংলা হলেও এখানে প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ অবাঙালির বাস। যাদের বেশিরভাগের মাতৃভাষাই হলো হিন্দী এবং ঊর্দ্দু। মনে রাখতে হবে, এই দুটি ভাষাই ভারতবর্ষের তথাকথিত গোবলয়ের ভাষা। এখন এইরাজ্যে বাঙালি অবাঙালির অনুপাত ৩:১। এখন দুই তিন কোটি বাঙালির নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারলেই এই অনুপাত এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না কোনভাবেই। এরপর অবাঙালি জনগোষ্ঠীর বংশবৃদ্ধির হার বাঙালির থেকে দ্রুততর। ফলে আগামী কয়েক দশক রাজ্যে বাঙালি অবাঙালির অনুপাতের ভারসাম্য অবাঙালিদের দিকে ঝুঁকে গেলেও অবাক হওয়ার নাই। এতো গেল জনবিন্যাসের সাম্ভব্য অভিমুখ। তার সাথে আরও বেশ কয়েকটি বিষয় য়োগ করতে হবে। বর্তমানে রাজ্যে বাংলা মাধ্যমের স্কুলের সংখ্যা দ্রুত কমছে। উল্টে ইংরাজী এমনকি হিন্দী মাধ্যমের স্কুলের সংখ্যাও দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোন জাতির জীবনে এটি একটি যুগান্তকারী বিষয় হতে বাধ্য। যার সরাসরি প্রভাব পরবে জাতির সংস্কৃতিতেই। বিষয়টি কেবলমাত্র এইখানেই শেষ নয়। নয় সীমাবদ্ধ। বর্তমানে রাজ্যে পুলিশ বিভাগে অবাঙালির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির পথে। বিশেষ করে অধিকাংশ উচ্চপদেই অবাঙালিদের দেখা যাচ্ছে। এবং সেই ধারাটি দিনে দিনে একই অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। ভারতীয় সেনা বিভাগে চিরকালই বাঙালি অপ্রতুল। তাই সেটি আলোচনার বিষয়ও নয়। নয় নির্ণায়ক কোন ভুমিকার পক্ষে যথেষ্ঠ। কিন্তু সরকারী বেসরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ জায়গায় অবাঙালিদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে দেখা যাচ্ছে। ব্যাবসা বাণিজ্যে চিরকালই অবাঙালিদেরই একচেটিয়া প্রাধান্য। এমনকি রাজনীতিতেও তারা এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ণায়ক ভুমিকার পথে অগ্রসর হওয়ার অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। এই সবই কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি। ফলে এর সাথে যদি এনআরসি’র প্রবক্তাদের হুঙ্কার মতো দুইকোটি বাঙালির নাগরিকত্বে কেড়ে নেওয়া যায়, তার সুদূরপ্রসারী ফল কিন্তু মারাত্মক হতে বাধ্য। মারাত্মক কারণ, বাংলারই ভুখণ্ডে তখন বাঙালিই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।

হ্যাঁ এনাআরসি’র প্রবক্তরা ঠিক সেই হিসাবকেই পাখির চোখ করে এগোতে চাইছেন। এবং সারা ভারতবর্ষব্যাপি এনআরসি করার ঘোষণাও সেই কারণে। যাতে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের ভিতর থেকেও একটি বড়ো অংশকে এনআরসি’র জালে ছেঁকে তোলা যায়। যে কোনভাবেই হোক না কেন ভবিষ্যতের পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে পারলেই, তখন রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র অবস্থানের আর কোন গুরুত্বও থাকবে না। এমনিতেই এখনই কোটি কোটি বিহারী ও বর্তমান ঝাড়খন্ড নিবাসী অবাঙালিদের জমি জায়গা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ফলে আজ থেকে কয়েক দশক পর, ফারাক্কা ব্যারেজের উত্তরভাগের পশ্চিমবঙ্গকে বিহারের সাথে আর দক্ষিণভাগের পশ্চিমবঙ্গকে ঝাড়খণ্ডের সাথে জুড়ে দিতে পারলেই হিন্দু-হিন্দী-হিন্দুস্তানের প্রবক্তাদের গোবলয়ের পরিধি আরও বিস্তৃত করার সুপ্ত স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠবে।

সেদিনের সংখ্যালঘু বাঙালি যারা চিরকালই আগে ভারতীয় পরে ভাগ্যবিড়ম্বনায় বাঙালি, গোবলয়ে লয় হয়ে গেলেও আনন্দিত হবেন তাঁদের ভারতীয় হওয়ার সার্থকতায়। সেদিনই হয়তো তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ ভারতীয় মনে করে গর্বিত বোধ করবেন। এবং বিধানচন্দ্র রায়ের পশ্চিমবঙ্গকে বিহারের সাথে জুড়ে দেওয়ার স্বপ্নের সার্থক রূপায়নে আনন্দিত হবেন সেদিন। আনন্দিত হবেন হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার ভরতীয় পরিকল্পনায় তাঁদেরও ঐতিহাসিক ভুমিকা পালনের বাস্তবতায়। এনআরসি’র প্রবক্তরা পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালিদের প্রকৃতি এত নিপুণ ভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন বলেই এই এনআরসি করে দুই কোটি বাঙালিকে অনুপ্রবেশকারীর তকমা দিয়ে তাড়ানোর হুঙ্কার দিয়ে রেখেছেন। যে হুঙ্কারের প্রাথমিক সাফল্য দেখা গিয়েছে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। পরবর্তী সাফল্যের ইতিহাস লেখা হবে রাজ্যের বাঙালি হিন্দুদের বদান্যতায়। দিন আগত ঐ।

১৪ই ডিসেম্বর’ ২০১৯

কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:১৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×