সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁকে নিয়ে কবিস্তুতি চলবে এখন এখানে ওখানে হয়তো বা বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে অনেক উদীয়মান কবি হয়তো বা প্রতিষ্ঠিত কবিও অচিরেই একটা দুটো শঙ্খ পুরস্কারে ভুষিত হবেন। সংবাদ শিরোনামে থাকবে তাঁদের নাম। বইমেলায় শঙ্খ পুরস্কার বিজয়ী কাব্যগ্রন্থে কবির স্বাক্ষর সংগ্রহের লাইনও পড়বে ইতি উতি। বাংলা সাহিত্যের হাটে শঙ্খ আরও বেশ কিছুদিন বিরাজ করবেন নানান ভাবে। শঙ্খসাহিত্যের দিগন্ত নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় গবেষক স্বীকৃতি লাভে সফল হবেন আগামীতে অনেকেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের শঙ্খজনিত প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে আরও বেশি মার্কস তুলতে। ফলে এটা ঠিক। শঙ্খ ঘোষ আমাদেরকে জড়িয়ে থাকবেন নানান ভাবে। অবশ্য বেশ কিছু শঙ্খভক্তও শঙ্খকেও জড়িয়ে থাকবেন। স্ব স্ব ব্যক্তি পরিসরের ছোট ছোট গণ্ডীতে। কিন্তু এর বাইরেও বৃহত্তর শিক্ষিত লেখাপড়া জানা জনমানসে শঙ্খ আদৌ কোনদিন কোন স্থান করে নিতে পারবেন কিনা, এখনই বলা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কেন বলছি, তার একটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। নব্বই বছর বয়সী শঙ্খ প্রায় সাত দশকের বেশি সময় বাংলা সাহিত্য সমাজে দুই হাতে তাঁর সাধনার ধন বিলিয়ে গিয়েছেন। এবং এই সাত দশক ব্যাপী সময় সীমায়, বাংলার সাহিত্য সমাজ ও পাঠক সমাজকে কবি অত্যন্ত কাছ থেকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই অবলোকন করে গিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তির গভীরতায় তিনি বাংলার পাঠক সমাজকে এবং অবশ্যই বাংলার সাহিত্য সমাজকেও তাঁর অতুলনীয় লেখনীতে বিশ্লেষণ করে গিয়েছেন সময় সময়। আর সেই বিশ্লেষণী শক্তির বলে তিনি বুঝতেও পেরেছিলেন সাহিত্য এবং বিশেষ করে কবিতার বিষয়ে বাঙালির, জাতি হিসাবে অনীহার কথা। এখন বিশেষ করে কবিতার মতো সাহিত্যের একটি ধারার প্রতি একটি জাতির যদি বিশেষ আগ্রহই না থাকে, তবে কবির প্রতিই বা কদিন আর কতখানি আগ্রহ থাকবে, থাকতে পারে সেই জাতির?
না, ভুল কিছু পড়েন নি। আমি যে কথা বলছি। অক্ষরে অক্ষরে সত্য। শঙ্খের চিন্তাদর্শনের সাথে যাঁদের ন্যূনতমও যোগাযোগ সংযোগ রয়েছে। তাঁরা সকলেই এই বিষয়ে অবহিত। তাঁরা জানেন, নিজ জাতির সাহিত্যের পাঠক সম্বন্ধে শঙ্খ সত্যের কত গভীরে পৌঁছিয়ে ছিলেন। খুব দ্ব্যর্থহীন ভাবেই শঙ্খ বলেছিলেন, “মেনে নিতে প্রথমে একটু অসুবিধে হলেও, একথা সত্যি যে সাধারণভাবেই আমরা কবিতাবিমুখ”। এখন এখানে ‘আমরা’ বলতে কবি অবশ্যই বাঙালির কথা বলেছেন। কেননা বাংলা কবিতা সাহিত্যের পাঠক নিয়েই আলোচনা করছিলেন তিনি তাঁর সেই বক্তৃতায়। কিন্তু কেন বলেছিলেন শঙ্খ এমন কঠিন সত্য? বলেছিলেন গভীর, গভীরতম দুঃখে। বুঝতে পারি নিজের ভিতর নিরন্তর দহনের জ্বালা কতটা তীব্র ও মারাত্মক হলে একজন কবি তাঁর সামাজ ও জাতির বিষয়ে এমন কঠিন কথা এমন দ্ব্যর্থহীন ভাবে উচ্চারণ করতে পারেন। আসলে শঙ্খ পুড়ছিলেন ভিতরে ভিতরে। পুড়তে থাকার সেই দহন জ্বালার অভিজ্ঞতাই শঙ্খকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সরাসরি সত্যের মুখোমুখি। আর এক কবি শঙ্খের জন্মের পরপরই বলে গিয়েছিলেন। “সত্য বড়ো কঠিন, সেই সত্যকেই ভালোবাসিলাম”। কঠিনকে কে কতটা ভালোবাসতে পারে, তাই নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। কিন্তু সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারা অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে একজন কবি’র পক্ষে। একজন সত্যদ্রষ্টার পক্ষে।
একজন বাঙালি হিসাবে আমরা গর্ব বোধ করতেই পারি। শঙ্খ ঘোষ সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পেরেছিলেন। এবং আরও বড়ো কথা। সেই খবরটুকুও আমাদের জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। এবং দ্ব্যর্থহীন ভাবেই জানিয়ে গিয়েছিলেন। একান্ত অকপট ভাবে। শঙ্খ ঘোষ কত বড়ো মাপের মানুষ। এই তার একটি পরিচয়। শঙ্খ ঘোষের তীব্র পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল, বাঙালি কবিতার পাঠক কবিতার ভিতরে গল্প খোঁজে মূলত। কবিতা খোঁজে না। সে ইতিহাসের কাহিনী খোঁজে। রূপকথার বর্ণনা খোঁজে। সামাজিক বিষয়ভিত্তিক প্রতিবাদী বক্তৃতা খোঁজে। কিন্তু কখনোই কবিতার খোঁজ করে না। ফলে কবিতার মুখোমুখি হলে বাঙালি কবিতার পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেয় কবিতার থেকে। এখানে অনেকের ভিতরে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই। তাহলে কবিতা কোনটা? কাকে কবিতা বলে বুঝতে চাইছেন কবি। শঙ্খকেই উদ্ধৃত করি বরং, নিজের কথা না বলে। দেখা যাক কবি, কবিতা বলতে কি বুঝতে ও আমাদেরকে বোঝাতে চাইছেন। আসুন দেখে নিই একবার। শঙ্খ বলছেন, “কবিতা হলো তা-ই যার ভিতর দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকাকে ব্যাপকভাবে ছুঁয়ে থাকতে পারি আমরা। কবিতা হলো তা-ই, যা আমাদের অধিচেতনা আর অবচেতনার সঙ্গে কেবলই যুক্ত করে দেয় আমাদের সময়ের চেতনাকে। কবিতা হলো তা-ই, যা আমাদের অতীত আর ভবিষ্যতকে বর্তমানের একটা বিন্দুতে এনে বাঁধে। কবিতা যিনি পড়বেন, তাঁকে এগোতে হয় এরই বিশ্বাস থেকে, এরই আগ্রহ থেকে”।
এই প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণে থাকার কথা আরেক কবির কয়েকটি লাইন। জীবনানন্দ তাঁর নিজের কবিতার বিষয়ে আলোচনায় বলে গিয়েছিলেন, মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত যে সময়চেতনা, সেই সময়চেতনাই তাঁর কাব্যের সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো। জীবনানন্দ আরও বলেছিলেন, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। ফলে কবিতা কাকে বলে বলতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ যে যে কথা বললেন, তার সাথে জীবনানন্দের কাব্য বোধের অতুলনীয় মিল বিশেষ ভাবে লক্ষ্মণীয়। অর্থাৎ শঙ্ঘ নতুন কোন বিশেষ কথাও বলছেন না এখানে। কবিতার যা সত্য, সেই সত্যকেই নিজের ভাষ্যে তুলে ধরে আমাদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন। আমরা কবিতা বলতে যা বুঝি, তা কিন্তু আসলেই কবিতা নয়। কবিতা অন্যকিছু। অনেক বেশি গভীর কিছু। এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রশ্নের সাথে, প্রাত্যহিক সত্যের সাথে জড়িত কিছু। শুধুই শব্দের সাথে শব্দের মিলের ছন্দগাঁথা কল্প কাহিনী নয়। যেদিকেই আমাদের ঝোঁক সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কেন এই প্রবণতা আমাদের ভিতরে? সে উত্তরও আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন শঙ্খ। শঙ্খের কথায়, “আমরা অধিকাংশ মানুষ কেবল উপরিতলের ভাসমান একটা জীবনকে ছুঁয়ে থাকি শুধু, কায়ক্লেশে প্রাত্যহিক জীবনযাপনকেই বেঁচে থাকার চুড়ান্ত অবস্থান ভেবে নিশ্চিন্তে থাকি। দুধারে গর্জিত এই প্রবল বহমান সংসার এতই আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যে, কোন এক জীবনপ্রশ্নের দিকে পৌঁছাবার আর কোন সময় বা গরজ হয় না আমাদের”। শঙ্খ বলছেন, এই আগ্রহের অভাবেই যথার্থ কবিতা থেকে বেশির ভাগ সময়েই আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকি।
আমরা শঙ্খের কথার সূত্র ধরে আর একটু ঠোঁটকাটার মতো বলতে পারি, সময় ও সুযোগ থাকলেও কোন এক জীবনপ্রশ্নের অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার মতো আগ্রহ ও তাগিদ অনুভব করি না আমরা প্রায় কেউই। তাই আমরা বাংলা কবিতার তথাকথিত পাঠকরাই প্রকৃত কবিতা’র থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকি। এড়িয়ে যেতে থাকি গুরুত্বপূর্ণ জীবনপ্রশ্নগুলিকেই। শঙ্খ যদিও বলেন নি, আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে একথা ভয়ানক ভাবেই সত্য, আমরা আদতেই পলায়নবাদী। এই পালিয়ে পালিয়ে থাকার প্রবণতাই আমাদেরকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধা দিতে থাকে ক্রমাগত। আমাদেরকে বাস্তব প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যেতে প্রলুব্ধ করে বড়ো বেশি। ফলে আমরা এক স্বকল্পিত সত্যের ভঙ্গুর মিনারে চেপে বসে থাকি। যে মিনারের অপর নাম দেওয়া যেতে পারে, অর্থ বিত্ত খ্যাতি যশ প্রতিপত্তি। এর বাইরে দাঁড়িয়ে জীবনকে জীবনানন্দের ভাষ্যে ছুঁয়ে ছেনে দেখার শক্তি আমাদের অর্জিত হয় নি আজও। তাই শঙ্খের ভাষ্যমতো, “বোধের যে তন্ত্রে আঘাত করবে কবিতা, তাকে আমরা এতই অসাড় করে রাকি, অধিকাংশ সময়ে আমাদের আকাঙ্খা আর কল্পনা এতই ক্ষীণ হয়ে থাকে যে, শিল্পের জগৎ থেকে প্রায়ই যেন আমরা যক্ষের মতো নির্বাসিত”।
আর এই নির্বাসনের ফলেই জাতি হিসাবে বাঙালি আজীবন কবিতা বিমুখ। কবিতা যে আসলেই জীবনযাপনের এক প্রগাঢ় পদ্ধতি, সেই সত্য বাঙালি আজও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় নি। না শঙ্খ ঘোষের মতো এমন এক মহীরুহের প্রায় একশতাব্দী ব্যাপী জীবনসাধনাতেও সেই সৌভাগ্য ঘটলো আমাদের এখনো। শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণে শোকের কিছুই নাই। মানুষ আসবে। তাঁর যা দেওয়ার তা দিয়ে চলে যাবে একদিন। কিন্তু তাঁর সেই দান যখন কেউ গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না, শোকের সময় ঠিক তখনই। তাই শঙ্খের এই নব্বই বছর ব্যাপী সুদীর্ঘ জীবনজুড়েই এই শোকের ধারা বয়ে চলছিল নিরন্তর ধারায়। সেই ধারাতেই শঙ্খ উত্তর বাঙালি কবিতাপ্রেমী ঘুরপাক খেতে থাকবে আগের মতোই। এবং দিনে দিনে একদিন শঙ্খ ঘোষও ছায়া হয়ে হারিয়ে যাবেন হয়তো বা।
২২শে এপ্রিল’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:১৪