অদ্ভুত ঘটনাঃ
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে উৎসুক জনতার ভিড়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এমনিতেই অনেক ভিড় থাকে।রোগীর ভিড় আর উৎসুক জনতার ভিড়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। রোগীর ভিড়ের কোলাহল 'বেশি ঝামেলা করলে ডাক্তার আসবে না' বলে থামানো যায় । কিন্তু উৎসুক জনতাকে এই ভয় দেখিয়ে লাভ নাই।তারা আপনাকে কচু দেখিয়ে দিবে! যাই হোক, ভিড়ের কারন-এ আসা যাক। এই ভিড়ের কারণ হল এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সএ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ছেলে মানুষ বাচ্চা প্রসব করেছে! তাজ্জব হওয়ার ঘটনাই বটে। অতি উচ্চ কল্পনা ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ কেউ কিভাবে বাচ্চা বের করে এনেছে ডাক্তার সেটাও কল্পনা করে ফেলেছেন। বাইরে পৃথক একটা জটলা হয়েছে। এক লোক বর্ণনা দিচ্ছেন কিভাবে ডাক্তার বাচ্চাটাকে কোন জায়গা দিয়ে বের করে এনেছে! যারা ভিড়ের কারনে ভিতরে যেতে পারছেন না তারা এই ঘটনার বর্ণনা শুনে কান জুড়াচ্ছেন। এই লোক সত্যি বলছে। তার কাছে তথ্য আছে। ডাক্তার তার আপন চাচাতো ভাইয়ের খালাতো শ্বশুর! তাই এই ঘটনার বর্ণনা অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না! কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকটা জটলা তৈরি হয়েছে। এই পুরুষের পেটে কিভাবে সন্তান হল তার রগরগে বর্ণনা চলছে!
এইসব ঘটনা যাকে নিয়ে সে ভিড়ের দিকে পিঠ করে শুয়ে আছে। সদ্য প্রসূত বাচ্চা মেয়েটার দিকে সে তাকাতেও চাচ্ছে না আবার চোখও সরাতে পারছে না।কি চমৎকার ফুটফুটে বাচ্চাটা! মাথায় ঘন কালো চুল।এই চুল নিয়েই যে মেয়ে জন্মায় তার চুলের গোছা ভবিষ্যতে চোখ আটকে যাওয়ার মতো হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু জন্মদাতার তাতে কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার ডান চোখের পানি নাক টপকে তেল চিটচিটে বালিশে পড়ছে। এক নার্সের সাথে কথা বলে যা জানা গেছে তার সারমর্ম অনেকটা এইরকম - 'যে ছেলে সে আসলে ছেলে না কারণ যে ছেলে সে ছেলে ছিল না, যে ছেলে সেই মেয়ে, মেয়েই ছেলে বা ছেলেই মেয়ে.।.।।'' পাঠকের মতো কৌতূহলিরও মাথা আউলে গেছে। সে অল্প স্বল্প যা বুঝল তা হচ্ছে 'মেয়েই ছেলে,ছেলেই মেয়ে!" বাইরে আসতেই যারা ভিতরে ঢুকতে পারছিল তাদের কিছু তাকে ছেঁকে ধরে। 'ভাই ভাই, কাহিনী কি বুঝলেন?' 'ভাই আসলে কাহিনী হচ্ছে সে মেয়ে সেই ছেলে, যে ছেলে সে আসলে ছেলে না, ছেলেই মেয়ে, মেয়েই ছেলে ......." "ধুর মিয়া কি বকতাসেন?" । আগ্রহীরা মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল।তারা যা শুনতে চায় তা শুনতে না পেয়ে আশাহত। মানুষ তাই শুনতে পছন্দ করে যা সে শুনতে চায়!
ফ্ল্যাশব্যাকঃ
ছোট একটা মেয়ে বছর চারেক বাড়ির উঠোনের এক কোনে মাটি নিয়ে খেলছে। তাদের উঠোনে শোকের মাতম চলছে। বাচ্চা মেয়েটার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সবাই কাঁদছে দেখে একবার সে ভাবলো তারও কাঁদা উচিত বোধ হয়। তাই সেও কিছুক্ষণ চিৎকার দিয়ে কেঁদে মাটিয়ে শুয়ে পড়লো। কেউ সেদিকে নজর দিলো না। কিছুক্ষণ কেঁদে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে বাচ্চাটা কান্না ছেড়ে দিল।আবার মাটি নিয়ে খেলা শুরু করলো। উঠোনে সাদা কাফনে মরা মানুষটা তার বাবা।মানুষটা চলে গেছে আর ফিরে আসবে না এই ব্যাপারটা বাচ্চাটার মাথায় এখনো ঢুকার বয়স হয়নি। মেয়েটা দেখলো তাদের উঠোনের উপর আকাশ কালো করে মেঘ জমছে,কিছুক্ষন মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে তার ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেছে।সে মাথা নামিয়ে আবার খেলায় মন দিলো। আমি কি চার বছরের বাচ্চাটাকে 'মেয়ে' বলে সম্বোধন করলাম? করলেও ভুল করিনি। গরিবের ঘরে কন্যাসন্তান 'মেয়ে' হয়েই জন্মায়। তার 'বাচ্চাকাল'টা জন্মের সাথে সাথেই 'মেয়েবেলা' বলে বিবেচিত হয়। তাদের 'বাচ্চা' হওয়াটা আর ঠিক হয়ে উঠেনা!
মেয়েটা এখন কিশোরী। এইমধ্যে সে বুঝে গেছে পেটে খাবার না থাকলেও মেয়ে মানুষের চাইলেই কারো কাছে হাত পাততে পারে না। কারণ যার কাছে হাত পাততে যাবে ,বিনিময়ে সে অন্য কিছু চাইবে! তার বাড়িতে কাজ করলেও হবে না, কাপড় ধুয়ে দিলেও হবে না 'অন্য কিছু' লাগবেই। এটাই যেন নিয়ম! কিশোরী মেয়েটা এটা যখন বুঝলো তার কমবয়সী মা ততদিনে এইসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মেয়ে এসে যখন মাকে এইসব বলে তখন মায়ের জবাবটা অনেকটা সোজাসাপটা ছিল- 'এটাই নিয়ম।এটাই হয়!এটাই স্বাভাবিক!বাঁচতে হলে এইসবই করতে হবে" । মেয়েটা এসব মেনে নিতে পারছিল না। মেয়ে হয়ে জন্মানোর পাপটা সে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। মেয়েটার মাও হয়তো বুঝতে পারছিল,সেও হয়তো মেনে নিতে পারছিলো না।তাই সে আরেকজনকে বিয়ে করে গ্রামান্তরে যায়। সেই বর আগের ঘরের 'পাপ' গ্রহন করবে না তাই মেয়েটা এখানেই থেকে যায়, এই গ্রামেই,বৃদ্ধা দাদীর সাথে। মেয়েটার নাম বলিনি এখনো? ও! মেয়েটার নাম নাজমা আক্তার। মেয়েটার নাম এতক্ষণ বলিনি।কিন্তু আপনার শুনতে নিশ্চয়ই শ্রুতিকটু লাগে নি।আপনি হয়তো টেরই পাননি যে আমি এতক্ষণ 'মেয়ে' বলে যাকে ডাকছি তার নামই বলিনি। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। সে "মেয়ে' এটাই তার বড় পরিচয়। মেয়ে মানুষের আবার নামের দরকার কি? যতসব বাহুল্য!
মা অন্যের বউ হওয়ার পর থেকে মায়ের সাথে আর তার দেখা হয়নি। নতুন বাবা এইসব পছন্দ করেননা। মায়ের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেছে। মায়ের যে আবার বিয়ে হল নাজমার এই ব্যাপারটা একদমই খারাপ লাগেনি। কারণ মা 'মেয়ে' পাপ ঘুচানোর জন্য, বাঁচার জন্য সামনে সে কয়টা পথ খোলা ছিল তার মধ্যে সমাজের চোখে 'ভালো'টা বেছে নিয়েছে। এখানে পাপ নেই। বাঁচাটাই আসল। নিঃশ্বাস নেয়াটাই বাঁচা! তাই সব বুঝে নাজমা মাকে হাসিমুখে দায়মুক্ত দেয়। সেও আর মায়ের সাথে আর দেখা করতে যায়নি। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এদিকে,এই পাঁচ বছরে সে মানুষের চোখের ভাষা পড়তে শিখেছে। চোখ যে কতো কথা বলে, চোখ যে কোথায় কোথায় যায় আর কিভাবে কি নির্লজ্জভাবে আটকে থাকে এইসব দেখেছে। স্বাভাবিক নিয়মে তার যৌবনে পা দেয়াটাও যে 'মেয়ে' জন্মের সবচেয়ে গুরুতর পাপ এবং বিপদজনক সময় এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে খুব ভালোভাবে। সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল।একটা মুক্তির পথ সেও খুঁজে পেয়েছে। সে জন্মের পর থেকে যাদেরকে 'বিপদজনক প্রাণী' হিসেবে বুঝে আসছে সে প্রানীরাই তার মুক্তির পথ বাতলে দিলো! দাদীর বয়স হয়েছে। ঘোলা চোখে কোনদিকে যেন চেয়ে থাকে। এক সন্ধ্যায় মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা দাদীর পাশে সে বসে আছে। এই দাদি ছাড়া সে আপন আর কাউকে পায়নি।মায়ের পর এতোটা বছর এই দাদীই ছিল তার শেষ আশ্রয়। দাদীর হাত ধরে নিজেকে আর আটকাতে পারলো না।হু হু করে কেঁদে দিলো। দাদীর চোখ খুলে নাতনীর দিকে তাকায়। ছানি পড়া ঘোলা ওই চোখে নাজমা কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।দাদির ঘোলা চোখে যেন সে নিজের ঝাপসা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। কিছু করার নেই। হোক ঝাপসা, এই পথেই তাকে হাঁটতে হবে।দাদীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দাদি অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ে নেন।ঠিক কি বুঝেছেন কে জানে,তবে তিনি একটা জিনিস বুঝতে পারছেন এবার থেকে এই ঘরে আর কেউ আসবে না তাকে দেখতে। তার ঘোলা দৃষ্টি আরও ঘোলা হয়ে গেলো।
নতুন শহরঃ
শহরের খুপরির মতো বস্তিতে এক নতুন ভাড়াটিয়ার আগমন।চুল ছোট করে ছাঁটা। বয়স পনের। নাম নাজমুল ইসলাম। বাবা মা নেই। ছেলে রিক্সা চালিয়ে দিনকাল চালায়। চেহারায় মধ্যে ছোট বাচ্চা মেয়ের মতো আদুরে একটা ভাব আছে,গলার স্বরেও এখনো কোমলতা।ছেলেদের মতো ভারি গলা হওয়ার বয়স তার এখনো হয়নি তো তাই! কিন্তু জীবনের তোপে পড়ে এক ভীষণ কাঠিন্য ছেয়ে আছে ওই মুখে। পনের বছরের একটা বাচ্চা ছেলে কিন্তু হাসতে তার যত আপত্তি। কি এক সংগ্রামে নেমেছে সে।তাকে অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে সবার চোখে সব ধরা পড়ার আগেই! টাইট কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে পুরনো একটা শার্ট গলিয়ে সে সকালে বেরিয়ে যেত রিক্সা চালাতে।
দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো। বেশ কিছু টাকাও কামাতে লাগলো। কিন্তু তাও অল্প কিছুদিন।সে ধরা পড়ে যায়। ধরা পড়ে যায় যে সে নাজমুল ইসলাম, এককালের নাজমা! বাঁচার জন্য নাজমা বেশ ধরেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকার উপায় একটা, ছেলে সেজে ছেলের ভিড়ে মিশে যাওয়া! যে বয়সে তার অকারনেও চুলে হাত বুঝিয়ে ঢং করার কথা, যে বয়সে তার মেয়েলি ভঙ্গিতে কোমর বাঁকিয়ে হাঁটার কথা, যে বয়সে নিজেকে বার বার আয়নায় দেখার কথা সেই বয়সে মেয়েটা চুল ছেলেদের মতো ছেঁটে ফেলে। গলার স্বরের কমনীয়তা লুকাতে স্বর মোটা করে কথা বলার চেষ্টা করে, ছেলেদের মতো হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু এতো করেও লাভ হল না। ধরা তো পড়েই গেলো। ওই ৩৮ বছরের লোকটা কিভাবে যেন সব বুঝে গেলো। এক গভীর রাতে নাজমুল(বা নাজমা!) ঘুমাচ্ছিলো। দরজায় টোকার শব্দে সহজ মনেই দরজা খুলে দেয়। এভাবে এতো তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যাবে সে ভাবেনি। কল্পনাও করেনি! । সেই রাতে নাজমুলের জীবন বদলে গেলো। ৩৮ বছরের রফিকুল ১৫ বছরের নাজমুলকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিলো যে নাজমা নাজমাই। নাজমা নাজমুল সাজলেও রাহুর কবল থেকে সে মুক্তি পাবেনা! এরপর নাজমা রফিকুলের হাতে পায়ে অনেক ধরল তাকে বিয়ে করার জন্য,নাহলে সে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।আমাদের সমাজের নিয়ম হল ধর্ষক ধর্ষিতা বিয়ে করলেই তার সাত খুন মাফ! কিন্তু রফিকুল পাপ মোচন করতে চায় নি! সে উল্টো নাজমাকে তার পরিচয় ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়! নাজমা দেখলো বিপদে সে পড়েই গেছে। মরতে তাকে হবেই।তার আগে শেষ কয়টা দিন অন্তত বাঁচার অভিনয় করা যাক! এভাবে চলছিলো কিন্তু যা হওয়ার তা হয়েই গেলো একদিন। চারদিকে সোর পড়ে গেলো ছেলে নাজমুল ইসলাম গর্ভবতী! এক সন্ধ্যায় প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসে নাজমা নিজেই,সাথে আর কেউ ছিল না। ভোরে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়।পেটের দায়ে ২ বছর ধরে নিজের নাম গোপন করে ছদ্মবেশে রিকশা-ভ্যান চালাতে শুরু করে সে। সবার কাছে পরিচিতি পায় নাজমুল ইসলাম নামে।যে জীবন সংগ্রামে জিততে নাজমা থেকে নাজমুল হয়,নতুন বেশ ধরে , সেই সমাজ ব্যবস্থায় নিরাপদে দরিদ্রতা আর জয় করা হলো না তার।ঘৃণ্য লম্পটের লালসার শিকার হয়ে জীবন সংগ্রামে পরাজিত নাজমা এখন 'পুরুষ মা'! পাশে পরীর মতো সুন্দর 'মেয়ে' বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নাজমা বলে "মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে বাঁচতে আমি পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করি। নিজের নাম পাল্টে নাজমুল ইসলাম রাখি। তারপরও নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি রে। নিজেকেই বাঁচাতে পারিনি তোকে বাঁচাবো কি করে? কেন এলি পোড়ামুখি? কেন এলি এই দুনিয়ায়?...।" তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে তার জন্ম দেয়া সন্তানটিও 'মেয়ে'! কি আছে এই মেয়ের কপালে?- কান্নায় ভেঙে পড়ে নাজমা।সে কান্না দেখার কেউ নেই ।
(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৬