somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুষ্টিয়া আমার ভালবাসার শহর (২য় ও শেষ পর্ব)

২৬ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নানা ছিলেন হেডমাষ্টার। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে তার কর্তব্য পালন করে গেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন দীর্ঘদিন। ফরিদপুরে “ঈশান হাই স্কুল” “ কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল” ও সর্বশেষে মোহনীমহন বিদ্যাপীঠে ছিলেন। গায়ের রঙ আলকাতরার মত কালো, এককালের কুস্তিকরা পালোয়ান মুগুর ভাজা বেটেখাটো শরীরের নানাকে হয়তোবা ভালোই লাগতো, যদি উনার ব্যাবহারে কোন মিষ্টির ছিটেফোটা পেতাম। একেবারে হিটলারি মেজাজ। দুচোক্ষে দেখতে পারতাম না উনাকে। X( আমার ফর্সা, নীলনয়্না, পানের রসে রাঙ্গানো ঠোটের পাতার বাঁশীর মত নানীর বর ঐ কালো পালোয়ানের মত, বদমেজাজী লোক, আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হতো। /:) নানা বৃটিশ আমলের বিএবিটি, রেলের গোরা গার্ডকে হান্টার মেরে অনেকদিন ফেরারী ছিলেন। বাসাতেও উনার হান্টারোয়ালা মেজাজ চালাতেন। বাইরের ঘরে বিনা বেতনে ছাত্ররা এসে পড়তো। তাই আমাদের উপর কড়া হুকুমজারী হতো, “টু শব্দটি যেন না হয়”।:| তখন শিক্ষক মানেই আদর্শের পরাকাষ্ঠা দেখানো হতো। উনারা মেট্রিকের আগে বিনা বেতনে ছাত্রদের পড়াতেন, নোট করে দিতেন। বিনিময়ে অভাবকে নিত্য সঙ্গি করে নিতেন। নানাও তার ব্যাতিক্রম হননি। এমনি তো বিকেল পর্যন্ত স্কুলে থাকতেন। সন্ধ্যার পর ছাত্ররা আসতো। ছুটির দিনে সারা দিনই ছাত্রদের আনাগোনা থাকতো। রান্নাঘরের জানালা ছিলো দরজা সমান। দুই পাটের খড়খড়ি। নিচের দিকে দু/তিনটা শিক আলগা করা ছিলো, ঐদিক দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। :) গড়াইএর তীরে, চরে ঘুরতাম। শ্বশানেও যেতাম। ভাঙ্গা দেয়ালে কয়লা আর ইট দিয়ে নাম লেখা থাকতো। ছোট ছোট গর্ত থেকে কখনো কখনো ছোট্ট হাত পা বেরিয়ে থাকতে দেখতাম। নির্জন শ্বশান বাঁশ-ঝাড় আর বটগাছে অন্ধকার হয়ে থাকতো। আমার সাথে কেউ যেতে চাইতোনা। আমি একা একাই ঘুরে বেড়াতাম। পাড়ায় একটা পাগল ছিলো। নাম মনে নেই। জানালার ধারে পায়ে-হাতে শেকল দেয়া সুদর্শন সেই যুবককে দেখতাম আপন মনে ইংরেজিতে বিড়বিড় করছে। অনেকেই ঢিল ছুড়তো। শুনেছি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো সে। ইংরেজিতে গোল্ড-মেডেলিষ্ট। তার এ পরিনাম দেখে খুব খারাপ লাগতো। স্বাধীনতার পর আর তাকে দেখিনি।

মিলপাড়ার গলির উলটো দিকেই ছিলো সবুজ খড়খড়ির লাল রঙের একটি দোতলা। গেটের দুপাশে স্বেতপাথরে লেখা “কুঠি লজ ও টেগর লজ”। ওটা ছিলো ঠাকুর এন্ড কোং এর নিজস্ব বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ আসা-যাওয়ার পথে এখানে বিশ্রাম নিতেন। সেই ঠাকুর লজের পুকুরে অনেক দুপুরে ঝাপুর-ঝুপুর করেছি। তখন সাতার জানতাম না। তাই বাধানো ঘাটে বসেই ঝাপুর-ঝুপুর করেছি। তখন ওখানে গরীব পরিবাররা থাকতো। এখন শুনেছি ওটা সরকারের তত্বাবধানে আছে। শুনে ভালো লাগলো। আমরা কুষ্টিয়া যেতাম বছরে একবার। আর বড় খালা থাকতেন গোপালগঞ্জে, তাই উনি যেতেন খুব ঘনঘন। উনার বড় মেয়ে আমাদের কল্পনা আপা কুষ্টিয়া নানাবাড়ীতে থেকেই পড়তেন। বড় খালার ছেলে-মেয়েদের খুব হিংসে হতো। ওরা বেশীদিন কুষ্টিয়ায় থাকতে পারে, আমরা পারিনা। কিন্তু আমার ঐ আপাটিকে একটুও হিংসে হতোনা। আপা না থাকলে যেন আমাদের কুষ্টিয়া ভ্রমন এতো মজার হতোনা। আমরা থাকাকালিন সময় বড় খালা ও অন্যান্য খালাতো ভাই-বোনরা এলে আমাদের মজা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যেতো। বাসায় কোন মেহমান এলেই নানী আঁচল থেকে ৫টাকা বের করে দিয়ে বলতেন, ‘মনি যাতো আম সন্দেস নিইয়ে আয়’। উফ! মাখন তালুকদারের দোকানের সেই আম সন্দেস! এখনো মুখে লেগে আছে। সে দোকানও আর নেই। মাঝে মাঝে আমরা ছোটখালার বাসায় যেতাম। উনি থাকতেন থানাপাড়ায়। এখনো আছেন। রিক্সা বোঝাই করে আমরা যেতাম। রিক্সায় জায়গা হতোনা। মেয়েরা গেলে সংসারের উনকোটি কাজ ছেড়ে নানী বেরনোর সু্যোগ সংগী পেতেন। তাই নানীর সাথে যেতে হলে রিক্সায় শাড়ী প্যাচানো হতো। তখন আমরা ঐ বদ্ধ কুটুরিতে থাকতে চাইতাম না। ঝুপ করে রিক্সার পা-দানীতে বসে পড়তাম। পায়ের কাছে বসতেই আমাদের বেশী ভাল লাগতো।

মামাদের মধ্যে সেজমামাকেও আমরা দু চোখে দেখতে পারতাম না। X( চেহারা সুরতে নানার সম্পুর্ন বিপরিত ছিলেন উনি। একেবারে গ্রীক ভাস্কর্যের মতো দেখতে ছিলেন। কিন্তু মেজাজটা ছিলো পুরোই নানার মত। একদিন সেজমামা বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলেন, আমি আশেপাশেই খেলছিলাম। বুঝতে পারলাম তারা কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছে। ৩/৪টা সাইকেলে করে তারা রওনা দিলো। আমি শুধু অপেক্ষা করলাম গলিটা পার হওয়ার। তারপর আমিও ছুটলাম তাদের পিছে। কালী নদীর ব্রীজের কাছে এসে তারা পিছন ফিরে আমায় দেখে। সঙ্গে সঙ্গে বরাবরের মতো আমার কানে মামার হাত। /:) বন্ধুদের মধ্যস্ততায় আমার কান রক্ষা পায়। মামা তো সেই মুহুর্তেই আমায় বাসায় ফেরত দিয়ে যায়। বন্ধুরা জোর করে তাদের একজনের সাইকেলের পিছনে আমায় বসিয়ে নেয়। চলে গেলাম ছেউড়িয়া। লালন ফকিরের মাজারে। পাশাপাশি দুইটি কবর, অনেক লম্বা। লাল সালু দিয়ে মোড়ানো। হয়তো তখন আমি ছোট ছিলাম বলেই কবর দুটি অনেক লম্বা লেগেছিলো। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু বাউল বসে একতারা বাজিয়ে গান গাইছিলো। ফেরার সময় আমি মামার সাইকেলে উঠিনি।;)

গরমের বিকেলে টূনটুন করে শব্দে দৌড়ে বের হতাম। লাল সালু মোড়ানো মাটির ভান্ড নিয়ে কুলপিওয়ালা হেকে যেত। সে কুলপি না খেলে জীবনটাই বৃথা। আম্মার কাছে, কখনো নানীর কাছে যেয়ে ঘ্যানঘ্যান করে কুলপি আদায় করতাম। কলাপাতায় ঢেলে দিতো কুলপি। আহা! যেন অমৃত! শেষ হওয়ার পরও পাতা চেটেই যেতাম। কুষ্টিয়ার স্মৃতি মনে হলেই আর একটি কথা মনে পড়ে। যা এখন আর কুষ্টিয়াতে নেই। তা হলো খাটা পায়খানা। আগের দিনের বাড়ীগুলোতে এটাচবাথ ছিলোনা। গোসল-খানা ঘরের পাশে হলেও পায়খানা ছিলো উঠানের এককোনে, অনেক উচুতে। অনেক ধাপ সিড়ি বেয়ে উঠতে হতো। সেটা ছিলো আমাদের কাছে ভয়াবহ ব্যাপার। :| কারন সেগুলোতে কোন প্যান ছিলোনা। পা-দানী আর একটা গর্ত। সে গর্তের নিচে মাটির চাড়ি(গামলা) পাতা। অন্ধকার থাকতে মেথরেরা সে চাড়ি পরিস্কার করতো। কুষ্টিয়ার সব কিছুর জন্য পাগল থাকলেও ঐ চাড়ি আমার জন্য ভিতিকর ছিলো। :| তাই আমাদের জন্যই একটা বাথরুম বানাতে হয়েছিলো।
সিনেমার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে, যাকে বলে টমটম দিয়ে। ঘোড়ার গলার ঝুনঝুন ঘন্টার আওয়াজ আর মাইকের শব্দে আমরা ছুটে যেতাম। কাড়াকাড়ি করে সিনেমার লিফলেট নিয়ে ঘরে আসতাম। সেগুলো দেখেই মা খালারা ঠিক করতেন কোন সিনেমা দেখতে যাবেন। নানাবাড়ী গেলেই অন্তত পক্ষে ২/১টা সিনেমা দেখা হতো। পাড়ার বেশ কয়েকজন মহিলা ছানাপনা নিয়ে দল ভারী করে সিনেমা দেখা হতো। কুষ্টিয়াতেই আমার রুপবান, লালন ফকির দেখা।
বড়মামার বিয়ে উপলক্ষে কাঠের মাঠে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছিলো। আর তখনই আমি প্রথম কলের গান দেখি বা শুনি। ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ ‘ভুল সবি ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল’ এই গান দুটির কথা এখনো মনে আছে। মনে আছে আমার শৈশবের খেলার সাথি ‘ডোরা, ডুরিনের কথা। মনে আছে পাড়ার গামা মামা, লাল মামার কথা। মনে আছে কুষ্টিয়ার অলি-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার সোনালি শৈশবের কথা। আমার ভালো লাগা, ভালবাসার কথা। আমার স্মৃতিতে কুষ্টিয়া এমন করেই বেঁচে থাকবে আজীবন।

***ছবি নেট থেকে প্রাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৩৭
৫৫টি মন্তব্য ৫১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×