নানা ছিলেন হেডমাষ্টার। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে তার কর্তব্য পালন করে গেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন দীর্ঘদিন। ফরিদপুরে “ঈশান হাই স্কুল” “ কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল” ও সর্বশেষে মোহনীমহন বিদ্যাপীঠে ছিলেন। গায়ের রঙ আলকাতরার মত কালো, এককালের কুস্তিকরা পালোয়ান মুগুর ভাজা বেটেখাটো শরীরের নানাকে হয়তোবা ভালোই লাগতো, যদি উনার ব্যাবহারে কোন মিষ্টির ছিটেফোটা পেতাম। একেবারে হিটলারি মেজাজ। দুচোক্ষে দেখতে পারতাম না উনাকে।
মিলপাড়ার গলির উলটো দিকেই ছিলো সবুজ খড়খড়ির লাল রঙের একটি দোতলা। গেটের দুপাশে স্বেতপাথরে লেখা “কুঠি লজ ও টেগর লজ”। ওটা ছিলো ঠাকুর এন্ড কোং এর নিজস্ব বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ আসা-যাওয়ার পথে এখানে বিশ্রাম নিতেন। সেই ঠাকুর লজের পুকুরে অনেক দুপুরে ঝাপুর-ঝুপুর করেছি। তখন সাতার জানতাম না। তাই বাধানো ঘাটে বসেই ঝাপুর-ঝুপুর করেছি। তখন ওখানে গরীব পরিবাররা থাকতো। এখন শুনেছি ওটা সরকারের তত্বাবধানে আছে। শুনে ভালো লাগলো। আমরা কুষ্টিয়া যেতাম বছরে একবার। আর বড় খালা থাকতেন গোপালগঞ্জে, তাই উনি যেতেন খুব ঘনঘন। উনার বড় মেয়ে আমাদের কল্পনা আপা কুষ্টিয়া নানাবাড়ীতে থেকেই পড়তেন। বড় খালার ছেলে-মেয়েদের খুব হিংসে হতো। ওরা বেশীদিন কুষ্টিয়ায় থাকতে পারে, আমরা পারিনা। কিন্তু আমার ঐ আপাটিকে একটুও হিংসে হতোনা। আপা না থাকলে যেন আমাদের কুষ্টিয়া ভ্রমন এতো মজার হতোনা। আমরা থাকাকালিন সময় বড় খালা ও অন্যান্য খালাতো ভাই-বোনরা এলে আমাদের মজা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যেতো। বাসায় কোন মেহমান এলেই নানী আঁচল থেকে ৫টাকা বের করে দিয়ে বলতেন, ‘মনি যাতো আম সন্দেস নিইয়ে আয়’। উফ! মাখন তালুকদারের দোকানের সেই আম সন্দেস! এখনো মুখে লেগে আছে। সে দোকানও আর নেই। মাঝে মাঝে আমরা ছোটখালার বাসায় যেতাম। উনি থাকতেন থানাপাড়ায়। এখনো আছেন। রিক্সা বোঝাই করে আমরা যেতাম। রিক্সায় জায়গা হতোনা। মেয়েরা গেলে সংসারের উনকোটি কাজ ছেড়ে নানী বেরনোর সু্যোগ সংগী পেতেন। তাই নানীর সাথে যেতে হলে রিক্সায় শাড়ী প্যাচানো হতো। তখন আমরা ঐ বদ্ধ কুটুরিতে থাকতে চাইতাম না। ঝুপ করে রিক্সার পা-দানীতে বসে পড়তাম। পায়ের কাছে বসতেই আমাদের বেশী ভাল লাগতো।
মামাদের মধ্যে সেজমামাকেও আমরা দু চোখে দেখতে পারতাম না।
গরমের বিকেলে টূনটুন করে শব্দে দৌড়ে বের হতাম। লাল সালু মোড়ানো মাটির ভান্ড নিয়ে কুলপিওয়ালা হেকে যেত। সে কুলপি না খেলে জীবনটাই বৃথা। আম্মার কাছে, কখনো নানীর কাছে যেয়ে ঘ্যানঘ্যান করে কুলপি আদায় করতাম। কলাপাতায় ঢেলে দিতো কুলপি। আহা! যেন অমৃত! শেষ হওয়ার পরও পাতা চেটেই যেতাম। কুষ্টিয়ার স্মৃতি মনে হলেই আর একটি কথা মনে পড়ে। যা এখন আর কুষ্টিয়াতে নেই। তা হলো খাটা পায়খানা। আগের দিনের বাড়ীগুলোতে এটাচবাথ ছিলোনা। গোসল-খানা ঘরের পাশে হলেও পায়খানা ছিলো উঠানের এককোনে, অনেক উচুতে। অনেক ধাপ সিড়ি বেয়ে উঠতে হতো। সেটা ছিলো আমাদের কাছে ভয়াবহ ব্যাপার।
সিনেমার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে, যাকে বলে টমটম দিয়ে। ঘোড়ার গলার ঝুনঝুন ঘন্টার আওয়াজ আর মাইকের শব্দে আমরা ছুটে যেতাম। কাড়াকাড়ি করে সিনেমার লিফলেট নিয়ে ঘরে আসতাম। সেগুলো দেখেই মা খালারা ঠিক করতেন কোন সিনেমা দেখতে যাবেন। নানাবাড়ী গেলেই অন্তত পক্ষে ২/১টা সিনেমা দেখা হতো। পাড়ার বেশ কয়েকজন মহিলা ছানাপনা নিয়ে দল ভারী করে সিনেমা দেখা হতো। কুষ্টিয়াতেই আমার রুপবান, লালন ফকির দেখা।
বড়মামার বিয়ে উপলক্ষে কাঠের মাঠে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছিলো। আর তখনই আমি প্রথম কলের গান দেখি বা শুনি। ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’ ‘ভুল সবি ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল’ এই গান দুটির কথা এখনো মনে আছে। মনে আছে আমার শৈশবের খেলার সাথি ‘ডোরা, ডুরিনের কথা। মনে আছে পাড়ার গামা মামা, লাল মামার কথা। মনে আছে কুষ্টিয়ার অলি-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার সোনালি শৈশবের কথা। আমার ভালো লাগা, ভালবাসার কথা। আমার স্মৃতিতে কুষ্টিয়া এমন করেই বেঁচে থাকবে আজীবন।
***ছবি নেট থেকে প্রাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




