
নামাজকে বলো এখন কাজ আছে
সাইয়িদ রফিকুল হক
দেশে এখন ধার্মিকের ছড়াছড়ি! আনাচেকানাচে সরকারি জমি দখল করে তৈরি হচ্ছে মসজিদ। আর এর চারপাশে গিজ গিজ করছে কথিত ধার্মিক। কিন্তু আসল ধার্মিক খুঁজতে গেলে ‘কম্বলের লোম বাছা’র মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আসল ধার্মিক লোকদেখানো ইবাদত করেন না। তাঁরা থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। মহান আল্লাহর সৃষ্টিধ্যানে। এঁদের নিয়ে আমাদের সমাজজীবনে কখনো কোনো সমস্যাসৃষ্টি হয় না।
সমস্যা হচ্ছে এখন ভণ্ডদের নিয়ে। এরা নিজেদের ধার্মিক প্রমাণের জন্য যত্রতত্র ধর্মবুলি আওড়ে যাচ্ছে। এদের স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান নেই। এরা সীমাহীন অজ্ঞান এবং অকাট মূর্খ। ধর্মের নামে এদের বাড়াবাড়ি আজ সহ্যের বাইরে।
এদের জীবনে সততা, সত্যবাদিতা, পরার্থপরতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঘুষবিমুখতা, আদবকায়দা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা ইত্যাদির কোনো লেশমাত্র নেই। এরা লোকদেখানো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে আবার নিয়মিত ঘুষ খাচ্ছে, সুদ খাচ্ছে, মানুষখুন করছে, মানুষখুনকে সমর্থন করছে, পরকীয়া করছে, হারামকে হালাল বানাচ্ছে, হালালকে হারাম বানানোর পাঁয়তারা করছে, লোভ-হিংসা ও অহংকারের মধ্যে ডুবে আছে। কিন্তু এরাই মুখে-মুখে বলছে নামাজ-নামাজ! যেন শুধু নামাজ পড়লেই সমাজ বদলে যাবে! এরা কতকাল নামাজ পড়ছে—কিন্তু উপরিউক্ত অপকর্মগুলো থেকে এখনও বিরত থাকতে পারেনি। এরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য দেশের বিভিন্ন দেওয়ালে, বাসের গায়ে, সিএনজি’র গায়ে খুব স্পর্ধার সঙ্গে লিখে রেখেছে—কাজকে বলো নামাজ আছে!
নামাজ মানুষ পড়তেই পারে। আর মুসলমানের জন্য নামাজ পড়ার হুকুম বা বিধানও আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে—মুসলমানকে জরুরি, সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজ বা দায়িত্ব ফেলে যখনতখন নামাজে শামিল হতে হবে। আমাদের দেশের একশ্রেণীর অতিমূর্খ এখন তা-ই করছে। এদের বুঝতে হবে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-কর্তব্যের স্থান সবার উপরে। আর এগুলো অবহেলা করে কখনোই ধার্মিক হওয়া যাবে না।
‘কাজকে বলো নামাজ আছে’—বলে মূর্খরা প্রতিনিয়ত কী-কী ক্ষতি বা সমস্যার সৃষ্টি করছে—তার সংক্ষিপ্ত নমুনা এখানে দেওয়া হলো:
১. একটি অ্যাপার্টমেন্টের নিচে রাখা তিনটি মোটর সাইকেল এক রাতে চুরি হলো। সকালে এর মালিকগণ ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়লো। পুলিশ এলো। দায়সারা তদন্তও হলো। ভবনের কেয়ারটেকারকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করলো। কেয়ারটেকার জানালো, সে ফজরের নামাজ পড়তে গিয়েছিল! কখন কী হয়েছে সে জানে না!
২. রোগীকে দেখা বাদ দিয়ে ডাক্তারসাহেব গেছে মসজিদে। তার ধর্ম চলে যাচ্ছিলো! তাই, সে দৌড়ে, ঝড়ের বেগে মসজিদে গিয়েছে। আর এদিকে রোগীকে ঠিকভাবে-সময়মতো ইনজেকশন ও স্যালাইন পুশ না-করায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
৩. গত ২৯-এ জুলাই, শুক্রবার, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, মিরেরশরাইয়ের খৈয়াছড়া’তে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে আরও ছয়-সাতজন। আহতরাও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এরা সবাই বয়সে তরুণ।
দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় দুপুর ১টা ৩৩মিনিটে। এইসময় রেললাইনের লেভেল-ক্রসিংয়ের গেইটকিপার যথাস্থানে ছিল না। সে মসজিদে গিয়েছিল নামাজ পড়তে! তার দায়িত্ব ছিল ট্রেন আসার কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট আগে দুইপাশের লেভেল-ক্রসিংয়ে লোহার বড়সড় ডান্ডা বা বাঁশ ফেলে রাখা। যাতে কোনো গাড়ি এইসময় রেললাইনে কোনোভাবেই উঠে যেতে না-পারে। কিন্তু গেইটকিপার ‘সাদ্দাম’ (গেইটকিপারের নাম) সব জেনেশুনেও তা না-করে মসজিদে গিয়ে বসে ছিল! অথচ, তার সরকারি দায়িত্ব ছিল এই গেইট পাহারা দেওয়া। সে জেনেশুনেও সরকারি-রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অবহেলা করে ওইসব মূর্খের স্লোগান ‘কাজকে বলো নামাজ আছে’ নামক মূর্খতায় ডুবে ছিল। কিন্তু তার বোঝা উচিত ছিল—তার এই কাজের দায়িত্ব ও গুরুত্ব কতখানি। তার ওই লোকদেখানো নামাজের জন্য ঘটনাস্থলেই নামাজের সময় ১টা ৩৩মিনিটে ঝরে গেছে ১১টি তাজাপ্রাণ।
দেশে এরকম অহরহ ও অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নামাজের কথা বলে ভণ্ডরা দায়িত্ব ও কর্তব্য ফাঁকি দিচ্ছে। পাঠক, উদাহরণ হিসাবে উপরিউক্ত তিনটিকেই যথেষ্ট মনে করেছি। অতিরিক্ত উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধের কলেবরবৃদ্ধি করাটা কাম্য নয়।
মানুষের বোধ ও বিবেক জাগ্রত হোক। আমাদের দেশের সীমান্ত-পাহারা দিচ্ছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরা যদি সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়তে যান তাহলে দেশের কী অবস্থা হবে? এইরকম পুলিশ, আর্মি যথাস্থানে নামাজ পড়েও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু রেলওয়ের ওই দায়িত্ববিমুখ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন গেইটম্যান সাদ্দামের মতো ভণ্ডধার্মিকের প্রয়োজন আমাদের দেশে নেই।
নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সবাইকে বুঝতে হবে। সরকারি ও রাষ্ট্রীয় দায়্ত্বি অবহেলা ও পালন না-করার কোনো সুযোগ কারও নেই। তাই, মুর্খদের সঙ্গে সুর না-মিলিয়ে দায়িত্বশীল সবাইকে ‘কাজকে বলো নামাজ আছে’ না-বলে বলতে হবে—নামাজকে বলো আমার এখন কাজ আছে। এখন আমি কাজ করবো। কাজশেষে নামাজ পড়বো।
মহান আল্লাহ, সবাইকে ধর্ম সঠিকভাবে বোঝার শক্তি ও ক্ষমতা দিন। আমীন।
বিনয়াবনত
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
০৩/০৮/২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




