ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কুরআন-শিক্ষার নামে কেন এই নাটক। একবার ভাবুন।।
সাইয়িদ রফিকুল হক
সম্প্রতি একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্তরে কিছুটা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তবে যারা পজিটিভ আলোচনা-সমালোচনা করছেন তাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ। কিন্তু একশ্রেণির উজবুক ও অর্বাচীন না-বুঝেই ধর্ম-স্বাদের সস্তা ঢেকুর ও জিগির তুলে পরিবেশটাকে অহেতুক ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অবশ্য এটা চেষ্টা নয়—সরাসরি অপচেষ্টা। এরা সেই ১৯৭১ সালের মতো দেশবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সর্বক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অসৎ-কার্যকলাপ শুরু করেছে।
এই রমজান-মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র-নামধারী (যারা বিভিন্ন ইসলামি ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় নেতা, কর্মী, সমর্থক ও সদস্য) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে হঠাৎ করে একটা সাইনবোর্ড ও একটা আধুনিক বোর্ড টাঙ্গিয়ে ‘কুরআন-শিক্ষা’র নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে অপচেষ্টা করেছে। আর এভাবে এরা দেখাতে চেয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন পড়ালেখা বাদ দিয়ে ‘কুরআন-শিক্ষা’ নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর দেশটা এই তালেবানদের দখলে এসে গেছে। এমন একটা শয়তানি ভাবধারা থেকেই ওরা আচমকা এই অপকর্মটি একেবারে ভেবেচিন্তে (আর স্ব-স্ব সংগঠনের ছায়াতলে থেকে) সংঘটিত করেছে।
তা নয়তো কী? দেশে ‘কুরআন-শিক্ষা’র এত-এত জায়গা থাকতে হঠাৎ বটতলায় বসে কুরআন তিলাওয়াত বা কুরআন শিখতে হবে কেন? বটতলায় বসে ‘কুরআন-শিক্ষা’ করলে কি সওয়াব বেশি হবে? নাকি বটতলায় বসে ‘কুরআন-শিক্ষা’র কথা কুরআনের কোথাও লেখা আছে? নাই মানে নাই। কুরআন পাঠের বা শেখার জন্য অনেক জায়গা আছে। আর ‘কুরআন-শিক্ষা’র জন্য দেশে কোনো বিধিনিষেধও নেই। ‘কুরআন-শিক্ষা’র জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান একেবারে উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু সবজায়গায় সবসময় কুরআন তিলাওয়াত বা ‘কুরআন-শিক্ষা’ গ্রহণ করতে হয় না। এমনকি সবসময় সবজায়গায় কুরআন তিলাওয়াত বা ‘কুরআন-শিক্ষা’ করাও সমীচীন বা জায়েজও নয়। এব্যাপারে স্পষ্ট বিধিনিষেধ আছে। আর কুরআন শেখানো বা পড়ানো হয়ে থাকে মসজিদের ভিতরে বা মসজিদের বারান্দায়, মসজিদের সামনে আর মাদ্রাসার কম্পাউন্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মাদ্রাসা নয় (অবশ্য এখনও তা হয়ে সারেনি, এটাকে মাদ্রাসা বানানোর চেষ্টা চলছে। তাহলে, দেশে ধর্মান্ধতা নতুন মাত্রা পাবে)।
আমাদের নবীজি সা. কুরআন তিলাওয়াত করেছেন কাবাঘরের বারান্দায় বসে, কাবাঘরের পাশে বসে, নিজের গৃহে, এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নব্বীতে। তিনি কখনো মাঠে-ময়দানে, কারও বাড়ির আশেপাশে বা সামনে কিংবা তাঁর শত্রু আবু জেহেলের বাড়ির সামনে, মক্কার যেকোনো মাঠেঘাটে, মদিনার রাস্তাঘাটে, কারও বাড়ির সামনে কুরআন তিলাওয়াত করেননি। এবং সাহাবিদেরও কখনো তা করতে বলেননি। এমনকি তিনি তাঁর সাহাবিদেরও কুরআন শিখতে কোনো মাঠেঘাটে যেতে বলেননি। আর নিজেও তাদের উন্মুক্তস্থানে ডাকেননি। মৃত মুসলমান নর-নারীর পারলৌকিক মুক্তির জন্য কবরের পাশে বা গোরস্থানে বসেও কুরআন তিলাওয়াত করা যায়। তাই বলে সেখানে কুরআন শেখানোর আসর জমানো যায় না। ‘কুরআন-শিক্ষা’র নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। এর বাইরে নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রাসুল সা.-এর সাহাবিরা কুরআন শিখেছেন রাসুলের কাছে বা অন্য কোনো বড়মাপের ও অভিজ্ঞ সাহাবির কাছে কিন্তু মসজিদে নব্বীতে বসে।
যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ‘কুরআন-শিক্ষা’র নামে একটা নাটক করেছে—আর তারা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে এই নাটকটি করেছে। তারা যদি ভালো হতো তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের ভিতরে বসে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের ভিতরে যে মসজিদ রয়েছে সেখানে কিংবা নিজেদের অন্য কোনো নির্জনস্থানে বসে ‘কুরআন-শিক্ষা’র আসর জমাতে পারতো। আসলে, এই নরপিশাচদের ‘কুরআন-শিক্ষা’র কোনো লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা ভক্তি নেই। এটা ওদের একটা বাহানামাত্র। ওদের আসল উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি হচ্ছে ‘কুরআন-শিক্ষা’র নামে ওদের পিতৃপুরুষের রাজনৈতিক দলের ‘শয়তানি ও ভণ্ডামি’ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পাপিষ্ঠচক্র ১৯৭১ সালে আবির্ভূত পৃথিবীর সর্বকালের সর্বকুখ্যাত জালিম-অত্যাচারী এবং মানুষ ও মানবতার চিরদুশমন পাকিস্তানী নরখাদকদের বংশধর। এদের বাপ-চাচা, মামা-খালু, নানা-দাদা, ফুফা বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন পাকিস্তানীদের দোসর ছিল। এরা সেই চিহ্নিত ও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি-কমিটির সক্রিয় নেতা, কর্মী, সদস্য ও সমর্থকদের সন্তানসন্ততি। এরা কোনেদিনও বাংলাদেশ-রাষ্ট্রকে স্বীকার করেনি আর আজও করবে না। এরা এদের বাপ-দাদাদের মতো দেশবিরোধী ঘাতক হয়েই চিরকাল বেঁচে থাকবে। তা থাকুক গে। এদের পাত্তা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আর এরা কখনোই ধার্মিক নয়, প্রকৃত মুসলমানও নয়, এরা মানুষ হওয়া তো দূরের কথা—মানুষ হওয়ার চেষ্টাকারীও নয়। এরা ভবিষ্যতের জঙ্গি। আপনাদের জ্ঞাতার্থে পূর্বেই বলেছি, এরা সাধারণ কোনো ছাত্র নয়। দেশের চিহ্নিত ইসলামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নিয়মিত ও সক্রিয় সদস্য। এরা পবিত্র কুরআন শিখতে সেদিন বটতলায় জমায়েত বা সমবেত হয়নি। তাদের অন্য উদ্দেশ্য ছিল।
তাদের অসৎ-উদ্দেশ্য ত্রিবিধ:
১. ‘কুরআন-শিক্ষা’র নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মগজ-ধোলাই করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আর তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে।
২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবিরের অপরাজনীতি এখনও নিষিদ্ধ। এভাবে বিভিন্ন ব্যানারে তারা কর্মসূচি চালাতে চাচ্ছে। সেটা এই ‘কুরআন-শিক্ষা’র আড়ালে স্পষ্টত প্রতীয়মান।
৩. পবিত্র কুরআনকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জামায়াত-শিবির’ সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।
এদের এই শয়তানি কার্যকলাপকে ভালোভাবে বোঝাবার জন্য আপনাদের ফ্লাশব্যাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সেই আশির দশকে। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিকজান্তা জিয়াউর রহমান। আর এই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা-দখল করেই দেশের পবিত্র সংবিধান থেকে রাষ্ট্রপরিচালনার চারমূলনীতিকে মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিয়েছিল। সর্বোপরি একাত্তরের সর্বস্তরের পরাজিতশক্তি তথা রাজাকারদের পুনর্বাসিত করার অপচেষ্টাও করছিল। আর একটা ‘গোলাম আযমে’র মতো চিহ্নিত ও ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্পেশাল বিমান পাঠিয়েছিল। এবং এই জিয়াউর রহমানই তাকে সসম্মানে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু কৌশলগত কারণে জিয়াউর রহমান সেদিন-তখনও ‘জামায়াত-শিবির’কে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার হুকুম দেয়নি। তবে জিয়ার আশ্রয়প্রশ্রয়ে তারা বসে থাকেনি। তারা গোপনে আবার সংগঠিত হতে থাকে। জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের রাজাকাররা এইসময় নিজেদের ‘মহামান্য খলিফা’ হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে তার অধীনে ধর্মচর্চা ও ধর্মের নামে অপরাজনীতি শুরু করে দেয়। তারা ভিতরে-ভিতরে খুব সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। এইসময় থেকেই তারা নিজেদের মতাদর্শী লোকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য দেশের বিভিন্নস্থানে ‘ইফতার-মাহফিল’ বা ‘ইফতার-পার্টি’সহ নানাবিধ ভুঁইফোঁড় সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে ‘সুধী-সভা’র আয়োজন শুরু করে দেয়। আসলে, এটা নামেই ছিল ‘ইফতার-পার্টি’ আর ‘সুধী-সমাবেশ’। কিন্তু আসলে এটা ছিল কর্মীসভা আর নিজেদের (জামায়াত-শিবিরের) এজেন্ডা বাস্তবায়নের এক চূড়ান্ত ও মৌন জনসভা। আপনারা মনে রাখবেন, বঙ্গবন্ধু-সরকারের আমলে সাংবিধানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এদের রাজনৈতিক সুবিধা দিতে সেই সময় জিয়াউর রহমান সংবিধানের অনেক ধারা ও উপধারা বাতিল করলেও যুদ্ধাপরাধীরা গণরোষের ভয়ে সরাসরি মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছিলো না। তাই, এরা (জামায়াত-শিবির) সেই সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না-পেরে কৌশলীয় ‘ইফতার-মহফিলে’র ছত্রচ্ছায়ায় নিজেদের রাজনীতির পথকে সুগম করতে থাকে। সেই থেকে এই বিদআতি কার্যক্রম ‘ইফতার-মাহফিল’ বা ‘ইফতার-পার্টি’ ভাইরাসের মতো বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে আশির দশকে জিয়াউর রহমানের স্নেহধন্য যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ‘ইফতার-মাহফিলে’র ব্যনারে নিজেদের আবার ঘাতকরূপে সংগঠিত করতে থাকে। আর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আরেক সামরিকজান্তা এরশাদ নিজের ক্ষমতা ও ইমেজ ধরে রাখতে স্বাধীনতাবিরোধীদের (জিয়ার মতো একই কায়দায়) রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়।
আজও যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ‘কুরআন-শিক্ষা’র নামে সস্তা নাটক জমাতে চেষ্টা করেছে তারা ওই জামায়াত-শিবিরের অপআদর্শে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসী। ওরা আজও মহান আল্লাহ-রাসুলের চেয়ে “মওদুদী, মওদুদীর গ্রন্থসমূহ, রাজাকার-সর্দার গোলাম আযম, জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান ও স্বার্থ-রাজনীতিকে” বেশি ভালোবাসে। ওরা চিরদিন ওই পরাজিতশক্তির বংশধর। তাই, ওরা কখনোই পবিত্র কুরআনের পবিত্রতায় ও তার বাণীতে বিশ্বাসী নয়। এরা শুধু রাজনৈতিক অপশক্তি-বৃদ্ধির লক্ষ্যে পবিত্র কুরআনকে ‘ঢাল’ বানিয়ে এইসব ছ্যাবলামি করে যাচ্ছে। পবিত্র ইসলামধর্ম ওদের কাছে সবসময় ব্যবসার হাতিয়ার। আর তাই, নিজেদের ফায়দা লুটতে ওরা ঐতিহাসিক বটতলায় ‘কুরআন-শিক্ষা’র আসর বসাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। এটা করে ওরা বরং পবিত্র কুরআনকেই অপমান করেছে। তার কারণ, কুরআন এত সস্তা জিনিস নয় যে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যেখানে-সেখানে শিক্ষা দিতে হবে। সময় এসেছে আজ সত্য বলার। আর এদের শক্তহাতে প্রতিরোধ করার। দলমতনির্বিশেষে এদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে।
আমাদের কোনো দল নেই।
আমরা রাজাকার ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০২