কানাই স্যার্। মধুপুর হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে শিক্ষকতায় আছেন। এর আগে একটি NGO তে ছিলেন।১০ বছরের মত। এর পরেই চুরির অপরাধ নিয়ে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। উনি একজন নির্ভেজাল মানুষ। উনি যে চুরি করেন নি সেটা NGO ম্যানেজম্যান্ট টিমও জানত। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কেউ নিজের মুখে চুরির কথা বল্লে কার কিইবা করার থাকে।কত অপমানই না তাকে শুনতে হয়েছিল। বিশেষ করে তার বড় বোনের জামাই হাসিব সাহেব ,কানাই স্যার চুরির অপবাদ স্বীকার করার সাথে সাথে তার সাথে কি দুর্ব্যবহারটাই না করল। অবশ্য উনি companyr জি.এম , কথা শুনাতেই পারেন। কানাই স্যার শুধু চুপ করে ছিলেন। কিছুই বলার ছিলনা তার্। কানাই স্যার মুখ লুকাতে এলাকা ছেড়েছিলেন। স্ত্রী আর ১ ছেলে কে নিয়ে মধুপুর আসেন। তারপর কত ঝড়ঝঞ্জাট। সেটা অন্য এক ইতিহাস। আমাদের আজকের গল্পের সাথে এই ইতিহাসের তেমন কোন সম্পর্ক নেই।
কানাই স্যারের আসল নাম রফিক উদ্দীন। কানাই স্যার নাম করনের ইতিহাস আরেকটা ছোট কিন্তু ভয়াবহ ইতিহাস। রফিক সাহেবের যখন স্কুলের শিক্ষকতার ২বছর তখনই উনি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন।
২০০৭/০৮ সালের দিকে মধুপুর হাই স্কুলের পরিদর্শনে এসেছিলেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে মোটামুটি সব দায়িত্ব এসে পরে রফিক উদ্দীনের ঘাড়ে। রফিক সাহেব কোন কিছুতেই না করেন না,করতে পারেন না। প্রতিমন্ত্রীর ভাষনের আগ পর্যায়ে রফিক সাহেবের দায়িত্ব ছিল উনাকে পিছন থেকে ফুল ছিটাবেন আর তারপর গলায় পড়িয়ে দিবেন ফুলের মালা। পিছন থেকে ফুল ঠিকই ছিটালেন কিন্তু মালা পড়ানোর সময় লাগল যত বিপত্তি। গলায় মালা দিবার মুহুর্তে তিনি কিসের সঙ্গে যেন হোচট খেলেন। তারপরের চিত্রটা একি সঙ্গে হাস্যকর এবং বেদনাবিদুর্। রফিক সাহেব গিয়ে পরলেন প্রতিমন্ত্রীর উপর আর উনি পরলেন টেবিলের উপর্। টেবিলও ওইদিন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। দড়াম করে ভেঙ্গে প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে পরল মাটিতে। টেবিলের উপর রাখা জগ,গ্লাস একটার পর একটা এসে ভাংতে লাগল প্রতিমন্ত্রীর মাথায়। কি বিচ্ছিরি এক অবস্তা। পরদিন তো শেষের আলো ছাপিয়ে দিল '' দুর্বিত্তের হামলায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সহ আহত ৩ ''। রফিক সাহেবের তো চাকরি যায় যায় অবস্তা। প্রধান শিক্ষক জয়নাল স্যার যদি না কোনরকমে সবকিছু ম্যানেজ না করতেন কি হত কে জানে!ওই যাত্রায় রফিক সাহেবের কানাই নামকরন ব্যতিত আর তেমন ক্ষতি হয়নি কিংবা জয়নাল স্যার হতে দেননি।
স্কুলে কানাই স্যারের একমাত্র কথা বলার মানুষ হল ওই জয়নাল স্যার্। উনি কানাই স্যার কে খুব স্নেহ করতেন। অবশ্য লোকমুখে শোনা যায় এরও একটি কারন আছে। কানাই স্যারের বউ ছিল অসম্ভব রুপবতী। কানাঘুষা চলে যে জয়নাল স্যারের সাথে কানাই স্যারের বউয়ের পরকীয়া সম্পর্ক আছে। এ সব এ শোনা কথা। কানাই স্যার ও শুনেছিলেন কিন্তু কখনও কিছু বলেন নি।
কানাই স্যার অতিরিক্ত রোগা একজন মানুষ। সবসময় ফুলহাতা শার্ট পরেন,কি গরম কি ঠান্ডা। কেউ তাকে ফুলহাতা শার্ট ছাড়া দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। বয়স ৪৫ ছুই ছুই। কিন্তু দেখলে মনে হয় ৬০এর কাছাকাছি। উনি কখনও চশমা পড়েন না। বেশীর ভাগ ই হা,হুম বলে কথা শেষ করে দেন।স্কুলের মাইনে যা পান তা দিয়ে মোটামুটি সংসার চলে যায়। সংসার বলতে উনি আর উনার স্ত্রী। ছেলে বিয়ে করে ঢাকাতেই থাকে। খুব বেশী আসে না। তাছাড়া উনি ৪/৫ ছাত্রকে টিউশনি পড়ান। মোটামুটি এই হল গল্পের প্রারম্ভিকা। চলুন আমরা মুল ঘটনায় প্রবেশ করি।
মুল ঘটনার সুত্রপাত ঘটে এক শীতের রাতে। ওই দিন কানাই স্যারের মন খুব খারাপ ছিল। স্কুলে কানাই স্যারকে নিয়ে সব স্যাররা অনেক হাসাহাসি করেছে। কানাই স্যার কিছু বলতে পারেননি, শুধু washroom এ গিয়ে চোখের পানি মুছে এসেছেন। এটা গেল বছরের আগের বছর এর কথা। কানাই স্যারের বউ সেদিন গিয়েছিল তার বাপের বাড়ী। বেচারী একা একা থেকে bore হয়ে গিয়েছিল।
ত াই কা নাই স্যার আর কিছু বলেননি। অবশ্য উনি কিছু বলেন না। সবকিছুতেই উনি সহমত পোষন করেন।
রাত আনুমানিক ১২ টা কি ১ টা। কানাই স্যার ৯ টার ভিতর ই শুয়ে পরেন। মোটামুটি এক ঘুমেই রাত শেষ হয়ে যায়। ফযরের একটু আগে উঠে নামাজ পরেন। তো যা বলছিলাম। ওইদিন কানাই স্যারের ঘুম আচমকাই মাঝ রাতে ভেঙ্গে গেল। কেউ যেন তাকে দরজায় করা নেড়ে ডাকছে।
-স্যার, স্যার ও স্যার
কানাই স্যার অবাক হয়ে গেল। এত রাতে তার বাসায় তো কোন ছাত্র আসার কথা না। তবুও উনি বলে উঠলেন, ' কে? '
আর কোন শব্দ হল না। কানাই স্যার কি ভুল শুনলেন? ঊনি ওপাশ হয়ে ঘুমানোর চেস্টা করলেন। একটু পর আবার সেই ডাক। এইবার কে বলার পর ওইপাশ থেকে বলে উঠল
-স্যার, দরজা একটু খুলবেন?
কানাই স্যার আবার বলে উঠল, ' কিন্তু তুমি কে ? '। আবার সেই নিস্তব্দতা।
কানাই স্যার কি মনে করে দরজা খুলে বাইরে উকি দিলেন। 'কে?'নাহ, কেউ তো নেই। তবে কি স্বপ্ন দেখছিলেন!নাহ,এইবার ঘুমাতে হয়। এমনিতেই শীতের কনকনে ঠান্ডা,তার উপর কুয়াশা। দরজা লাগাতে যাবেন সেই সময় কে যেন বলে উঠল
-স্যার, ভজং। একটু শুনবেন?
কানাই স্যার যদিও অনেক সাহসী মানুষ কিন্তু এইটা শোনার পর উনার পা একদম জমে গেল। ভয়ের একটা স্রোত শরীরে বয়ে গেল। উনি নিশ্চিত যে তাকে ডাক দিয়েছে সে মানুষ জাতীয় কেউ না। অশরীরি।
-স্যার কি ভয় পাইছেন?
কানাই স্যার হঠাত করে বুঝতে পারলেন তিনি আজ ঘরে একা। ভয়টা যেন আরো পেয়ে বসল। উনি দরজা বন্ধ করার মত শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। দুয়া কালাম পড়ার চেস্টা করলেন কিন্তু মাঝপথে গড়মিল লেগে গেল।
-স্যার কি দুয়া পড়তে চাচ্ছেন?খেক খেক
-কে কে?
-স্যার আমি। আমি খেকং
-কি...কি চাও?চলে যাও। আমি এই নামে কাউকে চিনিনা
-স্যার কি বেশী ভয় পাচ্ছেন? খেক খেক
কানাই স্যার সামনে কুয়াশার দিকে চেয়ে আছেন। কথাগুলো ওইখান থেকেই আসছে। উনি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন।
-স্যার,আপনি ভয় পাইয়েন না। আমি আপনার ক্ষতি করমু না।
কানাই স্যার মনে হয় একটু বুকে বল পাইছে। ঊনি বলে উঠলেন
-কে তুমি?
-স্যার,আমার নাম খেকং
-এইটা কি ধরনের নাম?
-খেক খেক, স্যার আমি তো মানুষ না তাই নামটা এমন
-তো তুমি কি ভুত?
-না স্যার,আমি ফুত। খেকং ফুত।
-ভুত শুনেছি, ফুত আবার কি?
-স্যার, মানুষের মাঝে যেমন ছেলে,বুড়ো ভাগ থাকে,আমাদেরও থাকে। বুড়ো দেরকে আপনারা ভুত বলে চিনেন তাদের বয়স ৪০০বাশ। ৪০০বাশের কমদের বলে ফুত।
-কি বল! বাশ কি আবার?
-খেক খেক,আপনারা যেটাকে বছর বলেন আমরা বলি বাশ। বাশঝাড়ে থাকি তো তাই বাশ দিয়ে বয়সের হিসেব রাখতে হই। সেটা স্যার আপনি বুঝবেন না। অনেক কঠিন হিসেব
-ও
-স্যার কি এখনও ভয় পাচ্ছেন?
- হুম,কিন্তু কম কম। আচ্ছা আমি কি সত্যি ই তোমার সাথে কথা বলছি নাকি এইটা স্বপ্ন?
-খেক খেক। স্বপ্ন ধরলেই স্বপ্ন। মানুষের যেমন অনেক নিয়ম কানুন থাকে,আমাদের ও আছে। ফুতদের চেহারা মানুষকে দেখানোর নিয়ম নেই,শুধুমাত্র ভুতরাই তা পারে। সে জন্য আপনার হইত বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছে।
-ও
-স্যার জিজ্ঞাসা করলেন না কেন আসলাম
-হুম বল
-স্যার,আপনি জানেন কেন আপনাকে সবাই কানাই স্যার বলে
-হুম
-ওইটার জন্য আমি ই দায়ী
-মানে?
-যেদিন আপনার সাথে ঘটল ওইদিন আমাদের প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা ছিল। দুস্টং এর উপর
-দুস্টং?
-আপনারা যেটাকে দুস্টামি বলেন। দুস্টং পরীক্ষায় আমাদের গ্রুপের কাজ ছিল আপনাদের প্রোগ্রামে দুস্টামি করা। আমার কাজ ছিল আপনাকে হোচট খাওয়ানো,আরেকজন টেবিল ভাংগছে,আরেকজন গ্লাস
-ও
-এতদিন পর মনে হল ব্যাপারটায় হইত আমি পরীক্ষায় পাশ করে গেছি,কিন্তু আপনার তো ক্ষতি হয়ে গেল
-হুম
-আমি অনেকবারই চাইছি আপনার কাছে আসব,কিন্তু আপনি ভয় পেতে পারেন তাই আসিনি
-ও
-স্যার,আমাদের সমাজের নিয়মে মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়ার নিয়ম নেই, থাকলে চাইতাম।
-হুম
-স্যার কি আমার উপর রাগ?
-নাহ
-স্যার ভিতরে যান,আপনার ঠান্ডা লাগবে। আমি কাল আবার আসব। আর স্যার আপনি একটু খবর নিয়েন তো আপনার স্ত্রী বাড়ীতে গেছে নাকি। যাই স্যার, ভজং
-ভজং কি?
-খেক খেক, মানুষ যেমন কথার প্রথমে সালাম,আদাব দেই আমরা তেমন দেই ভজং। স্যার আমার পড়ার সময় হইছে।নাইলে ভুত দাদা বকবে। যাই। ভজং।
কানাই স্যার ঠিক বুঝলেন উনিও ভজং বলবেন নাকি। কেমন যেন অসস্তি লাগছে। উনি দরজা বন্ধ করে শুতে আসলেন। ঠিক ভেবে পাচ্ছেন না,এইটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব। উনার ঘোর এখনও কাটছেনা। উনি ঘুমানোর আগে মনে মনে চাইলেন কালকেও যেন খেকং ফুত আসে। যদিও ব্যাপারটা হাস্যকর কিন্তু উনি ভেবে দেখলেন,অনেকদিন পর উনি কারো সাথে এত মন খুলে কথা বলেছেন। উনি একটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন । (চলবে.....)