somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিল্পের একটি খণ্ডিত প্রতিকৃতি

০৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ বুঁদ হয়ে আছে অবিশ্রান্ত আত্মরতির ভেতর; মানুষ তার সমস্ত সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়েছে আত্মপ্রচারণায় এবং অহঙ্কারে; চিন্তায় এবং চর্চায় মানুষ নিজেকে মনোনীত করেছে শ্রেষ্ঠতম, অমৃতের পুত্র, মহাজাগতিক কেন্দ্র হিসেবে; রেনেসাসের পরে মানবিকতাবাদ বলে একটি নতুন আন্দোলন গড়ে ওঠে, ইশ্বরকে সরিয়ে মানুষ নিজেই সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে, যৌক্তিক-সুন্দর-প্রাজ্ঞ-সৃষ্টিশীল মানুষ দিয়ে তারা পুরো পৃথিবী ভরে ফেলে; কিন্তু বিংশতিশতকেই সুশোভিত মানুষ উন্মাদনায় শয়তানীতে এক বৈশ্বিক আর্তনাদ তৈরি করে এবং আমাদের এই চারশো কোটি বছরের পুরনো পৃথিবীকে উপর্যুপরি দুটো বিশ্বযুদ্ধ উপহার দেয়; মহাযুদ্ধের ভয়াবহতায় নৃশংসতায় মানুষ দিগি¦দিকশূন্য হয়ে পড়ে, তার সমস্ত চিন্তাকাঠামো ভেঙে পড়তে থাকে, দ্বিতীয়বারের মতো আদম-হাওয়ার সন্তানেরা স্বর্গচ্যুত হয়।
জীবন মূলত নিরর্থক; নিরর্থকতায় মানুষ এবং তার চেতনা আচ্ছন্ন গত একশো বছর ধরে, ইতোমধ্যে পৃথিবীর উপরে আছড়ে পড়েছে দুটো মহাযুদ্ধ, দার্শনিক নিৎশে জানিয়েছেন সভ্যতার সিঁড়িতে ইশ্বরের মৃত্যুর সংবাদ; আলবেয়ার কাম্যু জীবনকে রূপায়িত করেছেন একটি প্রতীচ্য পুরাণের ভেতর: দেবরাজ জিউস অপহরণ করেছিলেন নদীর দেবতা অসোপাসের মেয়ে ঈজিনাকে; করিন্থের রাজা সিসিফাস জিউসের এই কুকীর্তি সবার কাছে প্রকাশ করে দেয়; এই অপরাধে পাতাল জগতে সিসিফাসকে একটি অদ্ভূত শাস্তি পেতে হয়, তাকে অনন্তকাল ধরে একটি পাথর ঠেলে তুলতে হয় পর্বতের চূড়োয়, তোলার পরই সেটা গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়, সিসিফাসকে আবার সেটা তুলতে হয় চূড়োয়, এবং অনন্তকাল ধরে সিসিফাসকে এই পরিশ্রম করতে হয়; দেবতারা ভেবেছিলেন নিরর্থক পরিশ্রমের চেয়ে কঠোর শাস্তি হয় না; কিন্তু আলবেয়ার কাম্যুর বিচারে সিসিফাস বিজ্ঞতম এবং জীবনবোধ তার অসাধারণ, আমাদের জীবন সিসিফাসের এই শাস্তির মতোই নিরর্থক- এইসব ভাবনা খুবই সা¤প্রতিক এবং আধুনিক, তবে নিরর্থকতার বোধ মানুষকে আলোড়িত করছে প্রাচীনকাল থেকে; মানুষ চেতনে কিংবা অচেতনে উপলব্ধি করেছে জীবনের নিরর্থকতা, নানা উপায়ে তাই মানুষ চেষ্টা করেছে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলবার, নিরর্থকতার ভয়ে এবং অর্থপূর্ণতার লোভে মানুষ গড়ে তুলেছে বিশ্বাস, প্রথা, রিচুয়াল, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা; সভ্যতা মানুষের অর্থপূর্ণতার আকাঙ্খার ফসল।
জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার সমগ্র মানবিক চর্চার ভেতর শিল্পকলা বিশুদ্ধ, অন্য অনেক চর্চার ভেতর অন্তর্ভূক্ত রয়েছে প্রয়োজন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই সেগুলোর উদ্ভব এবং বিকাশ, তবে শিল্পকলা এসব থেকে ভিন্ন, প্রয়োজন থেকে যেটুকু বেশি সেটুকুই শিল্পকলা, প্রয়োজনগুলোকে আরো বেশি পরিশীলিত করলে সেটা হয়ে ওঠে শৈল্পিক। তবে শিল্পকলা অপ্রয়োজনীয় কাজ নয়, শিল্পকলা কেবল ইচ্ছে কিংবা আনন্দই নয়, শিল্প উন্মোচিত করে মানুষের সম্পদ আর শ্রদ্ধাকে, মানুষের অন্তর্গত ভয়কে। শিল্প একটি ভাষা, আমাদের অনুভূতি আবেগ ভাবনার সবকিছু প্রথাগত ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, সেসব েেত্র শিল্পই প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। শব্দের ভেতর দিয়ে কোনো নৈসর্গিক সৌন্দর্য প্রকাশ করা যায় না, নিসর্গকে তুলে ধরতে আমাদের সাহায্য নিতে হবে চিত্রকলার; একটি জটিল ব্যক্তিত্বকে আমরা তুলে ধরতে পারি উপন্যাস কিংবা নাটকে; আমাদের আনন্দ বেদনা ঝরে পড়তে পারে কবিতা কিংবা সঙ্গীত হয়ে; হ্বিটগেনস্টাইন বলেছিলেন, ‘যা দেখানো যায়, সেটা বলা যায় না’; শিল্পের তাই সুনির্দিষ্ট কোনো ভাষা নেই, নানামুখী ভাষায় শিল্প প্রকাশ করে জীবন এবং মহাজগৎকে; তাত্ত্বিকরা শিল্পকে প্রধান তিনটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন: লিটারারি, ভিজুয়াল এবং পারফরর্মিং; লিটারারি আর্টের মধ্যে রয়েছে কবিতা, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প; ভিজুয়াল আর্ট হলো চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এবং ফটোগ্রাফি; সঙ্গীত, থিয়েটার, অপেরা, নৃত্য- এগুলো পারফর্মিং আর্ট। এর বাইরে একটি নতুন শিল্পের উন্মেষ ঘটেছে উনিশ শতকের শেষে, সেটা সিনেমা; সিনেমা একটি শঙ্কর শিল্প, সিনেমা একই সাথে ভিজুয়াল এবং পারফর্মিং আর্ট। শিল্পের এই নানাশ্রেণীর ভেতরে কোনটি উৎকৃষ্ট সেটা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক; শোপেনহার এই বিতর্কের একটি উপসংহার টেনেছেন, তাঁর কাছে শিল্পের শুদ্ধতা নির্ভর করে বিমূর্তায়নের উপর, বিমূর্ততম শিল্প তাই তার কাছে শ্রেষ্ঠতম শিল্প; সঙ্গীতের বিমূর্ত প্রকৃতি দেখে শোপেনহারই প্রথম বলেছিলেন, ‘সমস্ত শিল্পেরই ল্য হওয়া উচিৎ সঙ্গীতের পর্যায়ে উঠে আসা।’
শিল্পের সাথে মানুষের ঘনিষ্ঠতা চিরকালের, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ শৈল্পিক, শিল্প জড়িয়ে আছে মানুষের প্রাত্যহিকতায়; তবে এক নয় শিল্প এবং শিল্পবোধ; শিল্পের সাথে আমৃত্যু বসবাস করেও আমাদের অজ্ঞাত থেকে যেতে পারে শিল্পের ব্যস ব্যসার্ধ। মানুষের একটি অতিুদ্র অংশ হেসে ওঠার, বেড়ে ওঠার, গেয়ে ওঠার সময় থেকেই বুঝতে শেখে তারা অবাধ্য এবং অদ্ভূত; চেনা ছাঁচের ধাঁচের বাইরে তারা অচেনা; সকলেরই রয়েছে একটি প্রধান অনারোগ্য অসুখ, তারা সবাই শিল্পবোধে আক্রান্ত, তাদের রয়েছে ওই রহস্যময় অমল শিল্পব্যাধি, তারা শিল্পের শহীদ। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পচর্চার দায় এবং স্বত্ত্ব তুলে নিয়েছে কিছু অসুস্থ অসুখী মানুষ; শিল্পের সাথে শান্তির যোগাযোগ ীণ, অধিকাংশ েেত্র বিরোধী, কেবল অসুখী মানুষের পইে সম্ভব শিল্প সৃষ্টি করা। শিল্পের বিষয়বস্তু সংসার এবং জীবন, তবে সুখী সংসারী মানুষ শিল্পী হতে পারে না; শিল্পী একজন পর্যবেক, তাকে তাই ঘটনার বাইরে থাকতে হয়, দূরে থাকতে হয়; গৃহী কিংবা গৃহিণী তাই শিল্পী নন।
শিল্পকলা শব্দটিই আমাদের মধ্যে একধরনের সৌন্দর্যের অনুভূতি তৈরি করে, শিল্পকে অনেকেই মনে করেন সুন্দরের সমার্থক, যা সুন্দর তা-ই শিল্প; তবে এটি আগাগোড়া ভুল ধারনা, শিল্পের সাথে সৌন্দর্যের এরকম কোনো সম্পর্ক নেই; হারবার্ট রিডের মতে, ‘শিল্প ও সৌন্দর্য- শব্দদুটির ব্যবহারে সঙ্গতির চুড়ান্ত অভাব থেকেই শিল্প সম্পর্কে যতো ভুল ধারনা সূত্রপাত’। অনেক শিল্পকর্মই সুন্দর নয়, সৌন্দর্য শিল্পের কোনো অনিবার্য শর্ত নয়, আসলে শিল্প আর সৌন্দর্য ভিন্ন বিষয়। সৌন্দর্যের অনেক রকম সংজ্ঞা রয়েছে, একটি সংজ্ঞা আমি উল্লেখ করছি: সৌন্দর্য হলো আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে গাঠনিক সম্পর্কের একধরনের সঙ্গতি; এরকম সঙ্গতিহীনতায় শিল্পের কোনো তি হয় না, সহজ সঙ্গতির ভেতরে শিল্পের বিস্তৃতি নয়, শিল্প বরং অনেকেেত্রই সৌন্দর্যশূন্য। শিল্পকে ইন্দ্রিয়জ সঙ্গতি এবং সেই সঙ্গতি থেকে পাওয়া আনন্দের ভেতর দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; আনন্দ বিতরন শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য নয়; আনন্দ এবং সৌন্দর্য খুঁজতে গেলেই শিল্প অবোধ্য হয়ে ওঠে; শিল্পকলা বুঝতে হলে আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে কেমন করে শিল্পকলাকে বোঝা যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন বেনিদেত্তো ক্রোচে, ক্রোচে দাবি করেছেন, ‘শিল্পকে তখনই সবচেয়ে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা যায় যখন তাকে সজ্ঞা বা বিশ্লেষণ-নিরপে অনুভূতি সাপেে সংজ্ঞাত করা হয়।’ ক্রোচের এই বক্তব্য শিল্পকলার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে আমাদের, তবে ক্রোচে ব্যবহার করেছেন সজ্ঞা বা গীতিময়তার মতো ঝুঁকিপূর্ণ শব্দ; এগুলো অনেক বেশি বিমূর্ত কিংবা উপলব্ধিজাত ধারণা, এরকম শব্দের উপর ভিত্তি করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা কঠিন।
শিল্পকলার ইতিহাস অবিশ্বাস্যভাবে প্রাচীন; শিল্পকলার প্রাচীনতম যে নিদর্শন পাওয়া যায় সেটা প্রস্তরযুগীয় এবং আজ থেকে তিরিশ হাজার বছরের পুরনো; এই প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকর্মগুলোকে তাত্ত্বিকেরা তিনটি ভৌগলিক শ্রেণীতে ফেলেছেন: ফ্রাঙ্কো-ক্যান্টাব্রিয়ান, পূর্ব স্পেনীয়, উত্তর আফ্রিকীয়; এরমধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় স্পেনের আলতামিরা গুহায় আঁকা অনেকগুলো গুহাচিত্র, ছবিগুলোর বিষয়বস্তু মূলত বায়সন, হরিণ, ঘোড়া, শুয়োর; এরকম নানারকম জীবজন্তুর নয়শো ত্রিশটি ছবি এই গুহাতে আঁকা রয়েছে। এর বাইরে প্রাচীন শিল্পকর্মের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ হলো দণি রোডেশিয় ও দণি-পশ্চিম আফ্রিকায় বুশম্যানদের শিল্পকর্ম, যাদের ছবিগুলো সাধারণত দেখা যায় প্রস্তরশিলা, গুহা কিংবা অসমাপ্ত গুহার ভেতর, এই ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে তারা ব্যবহার করতো প্রাকৃতিক বর্ণ আর চর্বি দিয়ে বানানো তেল রঙ এবং ছবিগুলো সম্ভবত আঁকা হয়েছিলো হাড়ের তুলি দিয়ে; সবগুলো ছবিই আঁকা হয়েছে এমন সব জায়গায় যা তাদের বিচারে পবিত্র, কাজেই ধারণা করা হয় ছবিগুলোর সাথে ধর্মাচরণের একটা যোগাযোগ রয়েছে। এই সব ধরনের ছবিরই কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: রেখা দিয়ে টানা গুহাচিত্রগুলোতে পরিপ্রেতি তৈরির চেষ্টা নেই; গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বস্তুর বিভিন্ন অংশের প্রধান অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশে; এই আদিম মানুষের শিল্প মোটেই প্রকৃতি অনুসারী বা রিয়েলিস্টিক নয়, রূপায়িত বস্তুর তাৎপর্য প্রকাশ করার জন্য অনেক েেত্র স্বাভাবিক রূপ বিকৃত করা হয়েছে কিংবা বাদ দেয়া হয়েছে; ছবিগুলোতে ডিটেইল-এর কাজ খুব বেশি করা হয় নি, এেেত্র প্রতীকবাদী দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করতে পারে।
প্রথমদিকে শিল্পচর্চার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো বৈষয়িক; আদিম মানুষ লড়াই করেছে প্রকৃতির সাথে, শুধুমাত্র টিকে থাকার প্রশ্নে সে মুখোমুখি হয়েছে ভয়াবহ হিংস্রতার, প্রকৃতির এই আগ্রাসন তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করেছে, বিশাল দানবীয় প্রকৃতির সামনে নিজেকে তার দুর্বল অম মনে হয়েছে, কাজেই সে কল্পনা করেছে ইশ্বর; ইশ্বর- এক মহাজাগতিক প্রতিভা এবং সকল শক্তির কেন্দ্র, মানুষ তাই নিজেকে সমর্পণ করেছে ইশ্বরের পায়ে, সমস্ত আচার আচরণ প্রথা আর পূজো-অর্চনার ভেতর সে মুগ্ধ করতে চেয়েছে ইশ্বরকে; আরাধনায় সে ব্যবহার করেছে সৃষ্টিশীলতা, তাই প্রাচীনকালের শিল্পকর্ম মূলত ধর্মাচরণ, কিছু রিচুয়ালের প্রয়োজনে মানুষ নির্মাণ করেছে শিল্প। সেই আদিতম সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে শিল্পের এক উল্লেখযোগ্য অংশ সমর্পিত হচ্ছে ইশ্বরের পায়ে; পশ্চিমা প্রতিভাবান শিল্পীরা তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়েছেন যিশুখ্রিস্ট আর মাতা মেরীকে চিত্রণে, বাইবেলের অজস্র পুরাণকে তারা রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে; ইশ্বরের প্রশংসা আর গুণকীর্তনে লেখা হয়েছে অসংখ্য অসংখ্য পংক্তি, ইশ্বরের স্তবগানে মুখরিত হয়েছে বিপুল বাদ্যযন্ত্র আর অগণিত কণ্ঠ।
মানবিক শিল্পকর্মের এক বিশাল অংশ অর্পিত হয়েছে নারীর পায়ে; নারী, জগতের সমস্ত পুরুষ শিল্পীর কাছে এক আশ্চর্য অমোচনীয় রহস্য, চিরকাল শৈল্পিক পুরুষ উন্মোচিত করতে চেয়েছে নারীকে; নারী নিজেই এক অবিশ্বাস্য চিরন্তন শিল্প, সেই শিল্প পৃথিবীর সমস্ত পুরুষকে, সমস্ত শিল্পীকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। শিল্পের নির্মাণ করেছে মূলত পুরুষ, তাই শিল্পে নারী উপস্থাপিত হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিতে, পুরুষ দেখেছে তাকে শৈল্পিক চোখে, তবে সেই দৃষ্টি অনেকেেত্রই শৈল্পিক হয় নি, পৌরুষিক দৃষ্টিতে তা হয়ে উঠেছে স্থুল। নারীর আজকের ইমেজ শিল্পে পৌরুষে গত কয়েক হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী! পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি আপন অন্তর হতে।’
আবহমান কাল ধরে পুরুষ শিল্পায়ন করছে নারীত্বের, তবে নারীর মনস্তত্ব, নারীর ব্যক্তিত্ব সেসব প্রায় কখনোই শিল্পের বিষয়বস্তু ছিলো না; সমস্ত শিল্পীরা ধ্যানমগ্ন ছিলেন নারীদেহে; প্রকৃতি নারীকে আশ্চর্য ুরধার শরীর দিয়েছে, ইন্দ্রিয়গুলোর সামনে সেই শরীর গাঠনিক সম্পর্কের বিচারে আশ্চর্য নিখুঁত, একই সাথে তা প্রবলভাবে প্রলুব্ধ এবং আকর্ষিত করে পুরুষের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে; যে কোনো ইন্দ্রিয়কাতর পুরুষের চোখে তাই নারী এক মাংসের তোরণ, সেখানে আশ্চর্য রহস্যময় ভাঁজ আছে, উর্বরা কামনাদীপ্ত অঞ্চল আছে, ব্যাকুল প্রাণবন্ত গন্ধ আছে; তবে নারী যতোটা শারীরিক, তার তুলনায় অনেক বেশি মানবিক, মানবিকতায় নারী এক অনারোধ্য রহস্যময় দ্বীপ; কিন্তু শিল্পকলায় নারীর সেই বিশাল অনুদঘাটিত অঞ্চলের উপস্থাপনা শোচনীয়, নারীর প্রকৃত চিত্রায়নে শিল্প ব্যর্থ হয়েছে; আমাদের শিল্পীরা যতোটা ইন্দ্রিয়কাতর, ততোবেশি শৈল্পিক হয়ে উঠতে পারেন নি, শিল্প তাই একপেশে, অসম্পূণ থেকে গেছে। প্রাচীন পৌরাণিক দেবীরা শিল্পের ভেতর দিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছেন, শিল্পে তাদের যে মোহনীয় আবেদনময়ী রূপ তাতে করে তাদের প্রত্যেককেই মনে হয় এক একজন কামদেবী; কামপ্রবণ মানুষ এবং পুরুষ দেবীকেও করে তুলেছে যৌনতার উৎস। শিল্পের একটি বিরাট অংশ জুড়ে যেমন আছে নারী, তেমনি রয়েছে নগ্নতা, এই দুইয়ে মিলে এক বিরাট কামোদ্দীপনা তৈরি করেছে; এই উদ্দীপনা দেখেই ফ্রয়েড হয়তো বলেছিলেন, ‘সমস্ত শিল্পকলাই অবদমিত বাসনার প্রকাশ।’ গ্রিসে একসময় ব্যাপক চর্চা হয়েছে সভ্যতা আর শিল্পকলার, ভাস্কর্যে চিত্রকলায় গ্রিক দেব-দেবীদের প্রায় সকলেই নগ্ন, অনেক প্রতিকৃতিতেই কৌশলে আড়াল করা হয়েছে নারীর স্তন-যোনী এবং পুরুষের শিশ্ন; দেবদেবীর উর্বরা অঞ্চল তৈরি করতে পারে অসহ্য উন্মাদনা, একই সাথে সেটা অতিক্রম করতে পারে নন্দনতত্ত্বের ব্যাকরণ, এইসব বিবেচনা করেই হয়তো আকাশের পতি-পতœীদের পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেয়া হয় নি।
অসীম বিস্তার নিয়ে চিন্তা করেছিলেন প্লাতো, পরিকল্পনা করেছিলেন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের; প্লাতো তার এই আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করেছিলেন কবি এবং শিল্পীদের; প্লাতোর কাছে শিল্প হলো অনুকরণ, শিল্পী অনুকরণ করেন আমাদের এই পৃথিবীর, পৃথিবী নিজেই একটি অমৌলিক ব্যপার, পৃথিবী এবং তার যাবতীয় উপাদান প্রকৃত কিছু নয়, সেটা ভাবজগতের ছায়া, শিল্পী অনুকরণ করেন এই ছায়ার; কাজেই শিল্প বা কবিতা হলো ‘ছায়ালোকের ছায়া’। শিল্পকলা অনেককাল ধরে বহন করেছে অনুকরণের দায়, তবে উনিশ শতকের শেষদিকে শিল্পকলা এক নতুন ভূবনে প্রবেশ করে। কয়েকশো বছর ধরে পৃথিবী তোলপাড় করে চলছিলো রোমান্টিকতাবাদ, বাস্তবতাকে অনেক বেশি আবেগময়, আবেদনপূর্ণ, রোমাঞ্চকর, আশ্চর্য করে তোলে এই শিল্প আন্দোলন; এরপর শিল্পীরা সরে আসেন ভাববিহ্বলতা থেকে, সূচিত হয় বাস্তবতাবাদ, এখানে শিল্পী ব্যক্তিকতা পরিত্যাগ করে হয়ে ওঠেন নৈর্ব্যক্তিক, আদর্শ নৈতিকতা মহত্বের বাণী প্রচারের বিপরীতে প্রকৃত সত্যকে রূপায়িত করার সাধনা শুরু হয়। বাস্তববাদের গহ্বর ফুঁড়ে অঙ্কুরোদগম ঘটে আধুনিকতাবাদের, আধুনিকতাই শিল্পকলার অভিনব ভূবন, হ্যারল্ড রোসেনবার্গ যাকে বলেছিলেন, ‘নতুনের ঐতিহ্য’। আধুনিকতাবাদের ভেতর দিয়ে প্লাতো এবং অন্যান্য সমালোচকের হাত থেকে নিস্তার পায় শিল্পকলা, শিল্প নিজেই এক সম্পূর্ণ মহাজগৎ হয়ে ওঠে। আধুনিকতাবাদ অনুসরণ করে না প্রথাগত বাস্তবতার ধারণাকে, সে নিজেই পরীামূলক চর্চার ভেতর দিয়ে নির্মাণ করে এক নতুন পৃথিবী; এককালে মানুষ নিমগ্ন হয়েছিলো মানবিকতাবাদের ভেতর, মানুষই সব কিছু বিচারের মাপকাঠি- এই প্রতাগোরাসিয় ধারণায় মুগ্ধ ছিলো মানুষের বিচারবোধ; আধুনিকতাবাদ এই ধারণাও ভেঙে দেয়, মানবিকতার বদলে তারা চর্চা করে বিমানবিকতার, শিল্পকলাকে সরিয়ে নেয় মানুষ থেকে, ম্যালকম ব্র্যাডবুরি তাই আধুনিকতাবাদকে দেখেছেন শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ হিসেবে।
শিল্পকলার উদ্দেশ্য কী? মানুষ এবং তার মনের রয়েছে এক বিস্তীর্ণ বিস্ময়কর অলৌকিক অঞ্চল, আফ্রিকার গহীনতম অরণ্যের মতোই তার রহস্য আমাদের কাছে অনুদ্ঘাটিত, শিল্পকলা মানুষের সেই আশ্চর্যতম প্রদেশের অংশ। কোনো এক অলৌকিক উপায়ে মানুষের ভেতর সুপ্ত রয়েছে শিল্পকলার বীজ; এই বীজ অঙ্কুরিত হয়, বেড়ে ওঠে, কারো কারো েেত্র এই বীজ ফলবতী হয়; আমরা অনেকেই স্নানঘরে ঢুকলে গভীরভাবে সঙ্গীতমুখী হয়ে পড়ি, স্নানঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নির্জনতা এবং একাকীত্ব, এরকম নির্জনতা পেলে প্রায় সকলেই গান গায়, উঁচু গলায় কবিতা পড়ে, নির্জনতার ভেতরে মানুষ সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে; আমার পরিচিত অনেকেই আছেন যারা রাত গভীর হলে কবিতা লিখতে বসেন, কবিতার খাতায় তারা রাত্রির অন্ধকার চিরে নামিয়ে আনেন সূর্যোদয়; এই কবিতাগুলো তারা ছাপতে দেন না কোথাও, কাউকে পড়তেও দেন না, তারা নিজেরাই বুঝতে পারেন কবিতা হিসেবে সেগুলো অপরিণত, তবু তারা কবিতা লেখেন, লিখতেই থাকেন, অবসাদগ্রস্ত হন না। শিল্পের এই অপ্রাতিষ্ঠানিক একান্ত ব্যক্তিগত চর্চা প্রতিষ্ঠা পাবার ল্েয কেউ করেন না, এসবের পেছনে কাজ করে অন্তর্গত বোধ কিংবা তাড়না। কাজেই একটা কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই শিল্পকলার; প্রত্যেকেই নিজস্ব বোঝাপড়ার জায়গা থেকে চর্চা করেন শিল্পের।
শিল্প নানাকারণেই অদ্ভূত, শিল্পের একটি বিস্ময়কর দিক হলো এর নির্মাণ প্রক্রিয়া; অন্য অনেক নির্মাতা রয়েছেন পৃথিবীতে, তাদের নির্মাণ প্রথাবদ্ধ এবং পরিকল্পিত, তবে শিল্প এরকম কোনো প্রথাবদ্ধ পথে নির্মিত হয় না; একেকজন শিল্পী আলাদা আলাদা পথে পৌঁছান শিল্পের সদর দরজায়; একজন বিখ্যাত উপন্যাসিকের কথা মনে পড়ছে যিনি মাথায় হ্যাট না রেখে লিখতে পারতেন না; গভীর রাত ছাড়া কেউ কেউ কবিতা লিখতে পারেন না; অনেক অনেক কবির েেত্র কাব্যদেবী মাঝেমধ্যে তাদের পরিত্যাগ করেন, মাস দুয়েকের মধ্যে আর দেখা দেন না, এরকম কবিরা তাই কখনো কখনো অনুর্বর হয়ে পড়েন; লেখকদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন, স্বেচ্ছায় নয়, ইচ্ছের বিরুদ্ধে; তারা একদিন আবিষ্কার করেন শিল্পের মহাসড়ক তারা হারিয়ে ফেলেছেন, আর কোনোদিন তারা ওই সড়ক ধরে হাঁটতে পারবেন না; এই উপলব্ধি শিল্পী হিসেবে তাদের নিহত করে। বিশেষ কিছু মুহূর্ত আসে যখন শিল্পী নিজেকে ছাড়িয়ে বিশাল বিরাট হয়ে ওঠে, অদ্ভূত শক্তিশালী পংক্তি আলো ছড়াতে থাকে তার কবিতায়; একজন চিত্রকরের ক্যানভাস অমল সুরোভিত মহিমায় দর্শককে বিস্ময়াভূত করে দেয়; সেইসব যাদুকরী মুহূর্তে শিল্প নিজেই এক স্বয়ম্ভূ চরিত্র হয়ে শিল্পীর গহন থেকে তুলে আনে মণিমুক্তো।
শিল্পের নির্মাণ আশ্চর্য এবং রহস্যময়, তবু শিল্প বেশিরভাগ েেত্রই মেনে চলে কিছু সাধারণ নিয়ম, মানুষ আবিষ্কার করতে চেয়েছে এইসব অন্তর্হিত নিয়ম। শিল্পকে জ্যামিতিক নিয়মবদ্ধ করে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিলো প্রাচীন গ্রিসে, তারা বিশ্বাস করতো শিল্প আর সুন্দর সমার্থক ব্যপার, আর সুন্দর হলো রূপসঙ্গতি; রূপসঙ্গতি বা হারমনির ভেতর দিয়ে যদি আবিষ্কৃত হয় শিল্প, তাহলে সেই সঙ্গতির কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন খুঁজে বার করাও সম্ভব; এরকম কিছু বিশ্বাস ধরেই শিল্পে আমদানী হয়েছে জ্যামিতিক নিয়ম। এরকম একটি নিয়ম হলো সুবর্ণবিভাগ বা গোল্ডেন সেকশন, গত কয়েক শতক ধরে শিল্পের অন্তর্গত রহস্যভেদে এই নিয়ম বিবেচিত হচ্ছে এক প্রধান সূত্র হিসেবে; কেউ কেউ একে মনে করছেন সার্বজনীন, এবং শুধু শিল্পেই নয়, প্রকৃতির েেত্রও এই নিয়ম সমানভাবে কার্যকর, তাই কখনো কখনো এটি ভূষিত হয়েছে ধর্মীয় মর্যাদায়। ষোড়শ শতকের কয়েকজন লেখক এর তিনটি বিভাগকে তুলনা করেছেন খ্রিস্টিয় বিশ্বাস মতে ইশ্বরের তিন রূপ বা ট্রিনিটির সঙ্গে। ইউকিডের দুটো জ্যামিতিক প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই সুবর্ণবিভাগ; সাইসিং নামে এক জার্মান লেখক দাবি করেছিলেন, সমস্ত শিল্পকর্মেই এই সুবর্ণবিভাগ বিদ্যমান, যদিও পরবর্তীকালে সেই দাবি আদৌ স্বীকৃত হয় নি। কারো কারো মতে, উৎকৃষ্ট বেহালার প্রতিটি অংশই অনুসরণ করে এই নিয়ম। মিশরীয় পিরামিডের স্থাপত্যকীর্তি এই নিয়মের সাহায্যেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আবার গথিক ছাঁদের গির্জায় স্তম্ভ মিনারও এই নিয়ম দিয়ে সহজেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
শিল্পের আলোচনায় ইদানিং বহুল প্রচলিত একটি টার্ম হলো বিমূর্ত শিল্পকলা; দর্শককে কিংবা অনুরাগীকে আতঙ্কে নীল করে তোলার েেত্র অব্যর্থ ধারণা এই অ্যাবস্ট্রাকশন, যে কোনো অবোধ্য কিংবা দুর্বোধ্য শিল্পকর্মকেই আজকাল অ্যাবস্ট্রাকশন বলে চালিয়ে দেবার প্রথা শুরু হয়েছে। বিমূর্ত শিল্পকলা ধারণাটির তাই ব্যাখ্যা দরকার: বিমূর্ত শিল্পকলা একধরনের অভিনব গাঠনিক নির্মাণ, এই গঠনকাঠামোর সাথে আমাদের বাইরের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতার কোনো প্রত্য সম্পর্ক নেই; সাধারণভাবে এটির সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয় বিশশতকের নানাধারার অ্যাভেন্ট-গার্ড শিল্প। অ্যাভেন্ট-গার্ড শিল্পের উদ্ভব হয়েছে বিশশতকে আধুনিকতাবাদের গর্ভে, এটি অংশত অগ্রসর করেছে আধুনিকতাবাদকে এবং অংশত এর বিরোধীতা করে নির্মাণ করেছে প্রথাবিরোধী পরীণমূলক নতুন শিল্প। বিমূর্ত শব্দটি নির্দেশ করে সেইসব ইমেজ যা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত -তবে পুরোপুরি প্রকৃতি অনুসারী নয়- এবং বিমূর্তায়িত, যার মৌলিক জ্যামিতিক গঠন পরিবর্তিত হয়েছে অথবা সারল্যীকৃত হয়েছে। একসময় ননঅবজেকটিভ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হতো কিছু ধরনের বিমূর্তকলা, তবে এখন সেই ধারণা পরিত্যক্ত হয়েছে সমালোচক এবং ঐতিহাসিকদের কাছে। বিমূর্তকলা কনক্রিট নয়, কোনো কনক্রিট অবজেক্টএর সাথে এটা সম্পৃক্ত নয়, কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়েই একে মূল্যায়ন করা সম্ভব। অবজেক্টএর বাইরের কাঠামোগত রূপের চাইতে এর অন্তর্নিহিত কাঠামো এবং আকারকে তুলে ধরাই বিমূর্তকলার ল্য।
অন্যসব বিষয়ের মতোই শিল্পের মূল্যায়ন এক দূরহ কঠিন কাজ; সৌন্দর্যের বিচারে শিল্পকলার মূল্যায়ন হলে সেটা বেশ সহজ হতো, তবে প্রতিনিয়ত দুরত্ব বেড়েছে শিল্প আর সুন্দরের; শিল্পের মূল্যায়ন তাই অস্পষ্ট এক ধাঁধায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ সমঝদারদের েেত্র তো বটেই, সমালোচকদের েেত্রও শিল্পের সমঝদারি ভয়াবহ জটিল এক কাজ। গত শতকের শুরুতে ফ্রান্সে এক নতুন ধরনের শিল্প আন্দোলন শুরু হয়েছিলো; কোদ মোনে, এদুয়ার মানে, এদগার দাগা, পিয়ের অগুস্ত রেনোয়া, পল সেজানের মতো শিল্পীরা ছিলেন এই নতুন মিছিলে; ফ্রান্সে তখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর প্রদর্শনী হতো নতুন শিল্পকলার; এরা সকলেই ছিলেন শিল্পের নিরলস সাধক, প্রকৃত প্রস্তাবেই শিল্পের শহীদ, অথচ তাদের একটি ছবিও স্থান পায় নি সরকারি প্রদর্শনীতে; তারা নির্মাণ করেছিলেন অভিনব, প্রথাগত ধারার বাইরে এই নতুন শিল্পকলা তখন ভাবা হয়েছে বিরক্তিকর; শিল্পীরা তাই বাধ্য হয়ে নিজেরাই গড়ে তোলেন একটি সংগঠন ‘সোসিয়েতে আনোনিম’; এই সংগঠনের উদ্যোগেই তারা নিজেদের ছবির একটি প্রদর্শনী করেন; প্রদর্শনীটি চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়, শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম সকলের কাছে হাস্যকর হয়ে ওঠে, কদ মোনের একটি ছবি ‘ইমপ্রেশন: সানরাইজ’ নিয়ে তুমুল রসিকতা শুরু হয়; রসিকতার ভেতর দিয়েই এরা সবাই ইমপ্রেশনিস্ট বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই চরম অবহেলা পেরিয়ে এখন পৃথিবী জুড়ে চলছে তাদের জয়জয়কার; শিল্পের এক নতুন ধারা নির্মাণ করে দিয়েছেন তারা, যদিও তখনকার সমালোচকেরা মনে করেছেন এগুলো তুচ্ছ এবং হাস্যকর। সমঝদারির েেত্র তাই বাধাধরা নিয়ম করে দেয়া অসম্ভব, শিল্পের বিচার তাই মহাকালের হাতে ছেড়ে দেয়াই মঙ্গল; কালিক সীমানা পেরিয়ে শিল্প যখন প্রবেশ করবে অনন্তের পথে তখনই শিল্প প্রমাণ করবে নিজের মূল্য।
গত তিরিশ হাজার বছরে শিল্পকলা এগিয়েছে অনেকদূর, যদিও আঙ্গিকে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন কিংবা অভিনবত্ব আসে নি, তবু শিল্পের এক বিশাল অমূল্য ভাণ্ডার জমে উঠছে বিভিন্ন লোকালয়ে; এখন এই পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে একদল মানুষ নিমগ্ন হয়ে আছেন শিল্পচেতনায়, তারা দিনের বিষণœ প্রহরে কিংবা রাত্রির গভীর অন্ধকারে উন্মোচিত করছেন অপূর্ব আশ্চর্য জগৎ, শিল্প তাদের অবশিষ্ট সমস্ত চৈতন্য কেড়ে নিয়েছে, কেবল শিল্পের জন্যই তারা উৎসর্গ করেছেন যাবতীয় সুখ-দুঃখ, পৃথিবীকে এক নতুন রহস্যের মুখোমুখি করতে তারা অবিশ্রান্ত ডুবে আছেন শৈল্পিক সাধনায়। শিল্পকলা বিস্তৃত, ব্যাপক; কোনো বৈশ্বিক চরিত্র নেই শিল্পকলার; পুরনো অনেক ধারনাই তাই বাতিল হয়েছে নতুনের প্রতিভায়; বিষয়ের বৈচিত্র, প্রাচুর্য আর অভিনবত্বের কারণে লেখাটি শুধুমাত্র একটি খণ্ডিত এবং আপেকি পাঠ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখতে পারে; তবে এই লেখাটি অভিনব কিছু নয়।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×