দারিদ্রতা দূরীকরণ বা সমাজ বিনির্মাণে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তারা সব সময়ই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু বস্তুত অর্থে কারা সামাজকে এগিয়ে নিয়ে যান বা এগিয়ে নিতে চান, তা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য।
আপনি যদি সহজেই বলে বসেন, যারা দান দক্ষিণা করেন, যারা গরিব মেয়েদের বিয়েশাদীতে সাহায্য করেন, যারা অসুস্থ লোকদের সাহায্য করেন অথবা যারা মোটাদাগে লেখা লেখি করেন তারাই সমাজ উন্নয়ণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। আমি বলব, তা মোটেই নয়। আপনি আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু আপনি যে কোন বিষয়ে সুচিন্তা ধারণের অধিকার রাখেন নিশ্চয়ই। আর তাই আপনাদেরকে দু'টি গল্প বলি। হয়ত তা, আপনার চিন্তার খোরাক জোগাতেও পারে।
গল্প এক
আলহাজ্ব আলকাছ সম্প্রতি হজ্ব মোবারক শেষ করে দেশে ফিরলেন। অর্থ বিত্তের কোন অভাব নেই। দেশে ফিরেই তিনি মনস্থির করলেন, এলাকার যত গরিবগুরাবা আছে, তাদের মেয়েদের বিয়েশাদীতে নিজে সাহায্য করার পাশাপাশি নিজ আত্মীয়দের সাহায্য করতে উৎসাহী করবেন। বস্তুত, এই গরিব বৃদ্ধদের অধিকাংশই আলকাছ সাহেবের ক্লাসমেটের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এরা এখন উনাকে মনিব বা মহাজন বলেই জানে। আলকাছ সাহেবকে তাগড়া যুবক দেখালেও তার ক্লাসমেটগুলো বিভিন্ন অসুস্থতায় আক্রান্ত থেকে থেকে দেখতে প্রায় বৃদ্ধবস্থার দরজায় এসে দাড়িয়েছে। এরা সকলেই এখন গ্রামের উন্নয়নকর্তা হিসেবে আলকাছ সাহেবকেই বিশ্বাস করে। এবং নিজেদের সার্বিক প্রয়োজনে আলকাছ সাহেবকে পাশে পায়।
যদি কখনো আলকাছ সাহেব অনিহা প্রদর্শন করেন, তবে ব্যবসায়ী মহাজন মফস্বল সাহেব তো আছেনই। মফস্বল সাহেব কখনো তার দরজা থেকে কাউকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না। তিনি কেবল সাহ্যযের সাথে একটু ইন্টারেস্টের শর্ত যুক্ত করে দেন। বিপদগ্রস্ত দরিদ্রের কাছে উপস্থিত বিপদের চেয়ে এই স্বল্প ইন্টারেস্ট তেমন বড় কিছু না।
এলাকার মেম্বর জগদীশ ঠাকুর একজন শিক্ষিত লোক। সকলেই তারে সমীহ করে চলে। যারা তাকে একসময় সমীহ করত না, আজকাল তারাও তাকে খুব সমীহ করে। তিনি নিজ কৌশলী দক্ষতায় তাদের থেকে তা আদায় করে ছেড়েছেন। আলকাছ সাহেব ও মফস্বল সাহেবের কাজ কারবার তার কাছে "জব্বর ইন্টারেস্টিং ব্যাপার"। যদিও মেম্বর সাহেবের সাথে থাকা চামচারা বুঝে উঠতে পারে না, আলকাছ সাহেবের ইন্টারেস্ট না চেয়ে মানুষকে সাহায্য করাটা কেমনে ইন্টারেস্টিং ব্যপার হয়!
গ্রামের বাকি অর্ধবিত্ত বলুন আর মধ্যবিত্ত বলুন, গ্রামের উন্নয়নে কেউ হয়ত উপরোক্ত মহাজনদের সাথে যুক্ত, আর না হয় কেউ পেছনে গিবত চর্চায় ব্যস্ত।
গল্প দুই
মামুন। জন্মে এই গ্রামের বাসিন্দা হলেও তার পূর্বপুরুষের আগমন নোয়াখালি থেকে। তবে কেউ এদের আচরণ বা কথোপকথনে তা নির্ণয় করতে পারবেনা। এরা পুরোপুরি মিশে গেছে গ্রামের প্রকৃতি, বাতাস, সূর্য ও দরিদ্র মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবে বিত্তবানদের সাথে নয়। চার ভাই ও এক বোন নিয়ে তার এই পিতৃহীন পরিবারের দায় তার উপর। অসুস্থ মা কিছু করতে না পারলেও প্রতিবেশি দরিদ্র মহিলারা প্রায়ই দূধ রুটি নিয়ে আসে তার জন্য। তার কাছ থেকে এই মহিলাগুলো শিখেছে হাতের তৈরি বিভিন্ন পিঠাপুলির বানানোর নিয়ম।
মামুন জমি চাষাবাদ করে পরিবার চালায়। একসময় চাষ করতো ভাগে। কয়েকবছর হল তা উঠেগেছে। এখন কাটা হিসেবে ৪ হাজার টাকা দিয়ে করতে হয় চাষ। গতবছর ছিল কাটা প্রতি তিন হাজার। একবছরে বেরেছে এক হাজার। সাথে শুকনো জমির জন্য পানির টাকা। হালের টাকা। চারা রোপণে কাজের লোকের টাকা। সারের টাকা। ধান কাটার লোকের টাকা। ধান মারা দেওয়া লোকের টাকা। সব মিলে আগের চেয়ে অসম্ভব রকমের খরচ বৃদ্ধি। আগে বন্যার পানি বা খড়ায় দান গেলে মালিক ও কৃষক উভয়ের ক্ষতি হত। এ ক'বছর যাবত ক্ষতির পুরো ভার পড়ে কৃষকের উপর। লাভ ঘরে তুলে গতবছরের ক্ষতির সাথে হিসেব করলে দেখা যায়, আসলে লাভের খাতা শূন্য। কিন্তু জমির মালিকের বরাবরই লাভের হিসাব তাকে ঠিক।
মায়ের অসুস্থতার এক পঞ্চমাংশ আসে জমির মালিক আলকাছ সাহেবের দানের হাত থেকে। সাথে আরো কিছু যুক্ত করে মামুন তার মায়ের অর্ধেক অসুস্থার সেবা দিতে পারে। ভাইবোনদের পড়ালেখার খরচ আর বোনের বিয়ের খরচ জমানোর টেনশনে সে নিতান্তই দুর্বল হয়ে থাকে সমসময়। দুঃশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে থাকলেও, ঘরে ফিরে সে থাকে হাসিখুশি সবসময়।
বোনের জন্য মেম্বর দিয়েছেন কাপড় সেলাই করনের মেশিন। কিন্তু সেটা আজকাল বন্ধ থাকে। পাড়ায় আরো চারটা মেশিন দেওয়া হয়েছিল এক সাথে। এখন সকলেই নিজ কাপড় নিজে সেলাই করতে পারে। মেম্বর সাহেব এলাকার প্রবাসীদের উদ্যোগে সেলাই ট্রেনিং কোর্স চালু করেছিলেন। এটা তারই সুফল। এলাকার উন্নয়নে মেম্বর খুবই সুচিন্তিত পরিকল্পনায় এগিয়ে চলেছেন দিনকে দিন।
দেখা যায়, আলকাছ, মেম্বর ও মফস্বল সাহেব সহ গ্রামের সকল বিত্তেবানেরাই নিজ মেয়েদের বিয়েশাদীতে শ-পাঁচেক মানুষ খাওয়ানো ও দুনিয়া ভর্তি কাটমাল ফ্রিজ দিয়ে থাকেন। এবং ছেলেদের বিয়েতে এভাবেই হামলে পড়েন বেয়াই সাহেবের বাড়িতে। এই বিত্তবানেরা তাদের বিত্তের বিশালতায় গ্রামের দরিত্র পিতার কন্যাদের বিবাহের সার্বিক খরচের মোটা একটা অংশ গ্রহণ করে এই পিতাদেরকে দায়মুক্ত করেন। এবং তখন তাদের কন্ঠে শুনা যায় এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গর্জন। তবু তারা গ্রামের দরিদ্র মানুষের সাহায্যে এগিয়ে থাকেন সবসময়। তবে ছেলেদের বিয়ের দায় গ্রহণ করেন না। আর সেই কারণে বয়স চল্লিশ হয়ে গেলেও মামুনের মত অনেক পুরুষই বিবাহের দুঃস্বপ্ন দেখে না। কারণ, তারা অর্থ জমানোর কোন সুযোগই পায় না।
এই হল ঘটনা দুই। একটি গ্রামকে দারিদ্র্য দুর্দশা থেকে বের করে আনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এলাকায় অনেক সুশিক্ষিত জ্ঞানী লোক থাকলেও তারা নিজেদের চরকা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পরিকল্পনা আওরানোর সময় তাদের কই! আর গ্রামের সভ্য মানুষগুলো শহরে এসে ধারণ করেন দার্শনিকের রূপ। যা তাদেরকে শহরের বড় চিন্তাগুলোতে ব্যস্ত রাখে পুরোটা সময়। তার উপর দেশের জন্যও তো চিন্তা করতে হয়।
চলবে...
ছবিঃ মাতব্বর চিত্র!
(ব্লগ লিখার সময় সুযোগ কোনটাই হয়ে ওঠে না; ব্যস্ততার কারণে। আজ দু'দিন হল করোনা পজেটিভ, বাসায় বসে আছি অকর্মা হয়ে। সে সুযোগে আজ একটু বসলাম। লেখার ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আলোচনার মূল বিষয়ে দৃষ্টিপাত আশাকরি।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৩১