'ডেটা সুরক্ষা আইন' নিয়ে করা একটি পোস্ট কিছুদিন যাবত আমাদের সামু ব্লগে স্টিকি করে রাখা হয়েছে। যে পোস্টের শিরোনাম ও পুরো লেখা পড়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের ডেটা নিরাপত্তা কিংবা স্বাধীকার হরণের ধারণা জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক। অনেক ব্লগারের কাছে তো বিষয়টি কোন গুরুত্বই পায়নি, এসব মূলত লেখকের অস্পষ্ট মতামত প্রকাশের ফল।
"বাংলাদেশ" নাম দেখা মাত্রই আমরা পুরো বাংলাদেশের সর্বসাধারণকে নিয়ে ভাবি। বাংলাদেশের ভেতর থাকা সকল সম্পদ নিয়ে ভাবি। যে কারণে আমরা নিজেদের মতামত প্রকাশের পূর্বে চিন্তা করি সাধারণ থেকে অসাধারণ সকল শ্রেণির মানুষের কথা। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশের সম্পদ বলুন আর সর্বসাধারণ বলুন, এই পুরো দেশটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সরকার ব্যবস্থা। যা সংখ্যায় অতি অল্প হলেও মারাত্মক ক্ষমতাধর। এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রেখে চিন্তা করতে হবে, আমরা জনগণের পক্ষে তথা ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যেন নিজ দেশের কোন ক্ষতি করে না বসি। পাশাপাশি আমেরিকার রাষ্ট্রদুতের কথায় রেগে যাওয়া বা নিজ দেশের স্বাধীকার রক্ষার নামে নিজেদের নিরাপত্তা বিকিয়ে দেওয়া কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সব কিছু গভীরভাবে চিন্তার মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। এখন আসা যাক মূল বিষয়ে এবং অতি সংক্ষেপে।
আমাদের সকলের জানা, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন" এর নামে একটি আইন বাস্তবায়ন করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এই আইনের দ্বারা জনগণের টুঁটি চেপে ধরা হয়। হরণ করা হয় বাক স্বাধীনতা। নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায় সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের। তাদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করলেই গ্রেফতার। মূলত এই আইনের দ্বারা সরকারের দুর্নীতি ও অপরাধী শক্তিকেই নিরাপত্তা দেওয়া হয়ে থাকে। যা স্পষ্ট হয়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা মামলার বাদীপক্ষের পরিমাণে। যেখানে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মামলার শতকরা ৮৫ ভাগ বাদীপক্ষের জায়গা দখল করে আছেন বর্তমান সরকার দলীয় কর্মী। সূত্র> এই লিংকে।
তখন 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে'র নামে হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর উঠে। প্রতিবাদ থামাতে সরকার থেকে আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দেয়া হয় এবং বলা হয়, সাংবাদিকরা জনগণের স্বার্থে সংবাদ প্রকাশে এই আইনের শিকার হবেন না। কিন্তু না আজ পর্যন্ত এই আইনের কোন পরিবর্তন আসলো, না সাংবাদিকেরা বলতে পারছে স্বাধীনভাবে কথা। ফলস্বরূপ মোট ৫৩ জন সাংবাদিককে যেতে হয়েছে জেলে। এমনকি লেখক মুশতাক আহমেদকে পুলিশি হেফাজতে কাশিমপুর কারাগারে আটক অবস্থায় মারা যেতে হয়েছে। সূত্র> এই লিংকে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশের খসড়া 'ডেটা সুরক্ষা আইন' নিয়ে কথা বলতে গিয়ে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন'এর কথা আসছে কেন। দেখুন, এগুলো একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার বা টিকটকে যদি কোন অপরিচিত আইডি থেকে সরকার দলীয় কারো অপকর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয় যা রাষ্ট্রের পক্ষে পড়ে এবং সরকার ঐ লোকটিকে ধরতে চায়, তাহলে সরকারকে সেই আইডিধারী সম্পর্কে জানার জন্য ফেসবুক বা টুইট ইত্যাদি কোম্পানির কাছে আবেদন করতে হয়। এই আবেদনের একটা লিমিট সংখ্যা আছে। কিন্তু যখন এরকম ব্যক্তির ডাটা সরকারের কাছেই থাকবে তখন সেই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার বিষয়টি সরকারের কাছে হাতের ময়লার মত হয়ে যাবে।
আমরা ব্লগাররা ও ব্লগ পাঠকেরা খুব ভালোভাবেই জানি, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলার একটা লিমিট আছে। সরকারের ঐসব কাজকারবারের গঠনমূলক সমালোচনা করা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন করে। এবং এটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলেরও বৈশিষ্ট্য বটে। এখন রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন আটকাতে যে কোন নাগরিক তার দলের বা বিরোধী দলের যে কোন কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারে। এটা তার গনতান্ত্রিক অধিকার।
এখন যদি এরকম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন নাগরিক তার নিজের অধিকার কিংবা রাষ্ট্রের অধিকার রক্ষায় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে জেলে গিয়ে মরতে হয়, তাহলে এই আইনের দ্বারা জনগণের কী উপকার হল?
দেখুন, ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে যে সব নাগরিকদেরকে বাকস্বাধীনতা হরণ করা যাচ্ছে না, যাদের ডাটা সরকারের কাছে না থাকায় সরকার তাদের টুঁটি চেপে ধরতে পারছে না, তাদেরকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসাই এই 'ডেটা সুরক্ষা আইন'এর উদ্দেশ্য। আর হ্যাঁ, এই সীমার মধ্যে সামু ব্লগ সহ মুক্তমনা ব্লগ এমনকি ব্যক্তিগত ব্লগের ডাটাও সরকারের কাছে থাকতে বাধ্য; যারা বাংলাদেশে বসে ব্লগিং করবেন। বাংলাদেশে বসে মাল্টি নিক ইউজ করবেন, তার আর প্রয়োজন পরবে না।
উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের ডেটা নিজেদের সংরক্ষণে রাখছে। এটা তাদের জন্য পার্ফেক্ট। অনুসন্ধান করে দেখুন, তারা নিজেদের বিরুধী দলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যারা তাদের সমালোচনা করে, তারা সমালোচনাকারীদের প্রতি অন্তত আক্রমনাত্মক মনোভাব লালন করে না। আর আমরা? জানেন, শতকরা ৪১ ভাগ মামলা সরকার দলীয় নেতাদের সাথে বেয়াদবী পূর্ণ কথার কারণে।
কী একটাবস্থা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের পাশাপাশি তাদের চামচারা পর্যন্ত নিজেদেরকে প্রভুর আসনে বসিয়ে জনগণকে শাসন করছে। এটা একেবারে মহল্লা থেকে রাজধানীর বিচার বিভাগ পর্যন্ত। প্রভুদের বিরুদ্ধে কিছু বলাই যাবে না। আসলে, জনগণেরই বা কী করার, এক সাথে এতো প্রভুর কীভাবে উপাসনা করবে ওরা। কিন্তু প্রভুদের কি তা বুঝার বিষয়! মোটেই নয়।
দেখুন, এতো বছর যাবত যেখানে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' সংশোধন করা হচ্ছে না। তার উপর এই 'ডাটা সুরক্ষা আইন' এর নামে নতুন আরেক শিকল।
যদি 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' এর সকল জটিলতা দূর করার পাশাপাশি এই আইনটিকে সরকার দলীয় নেতাদের আঁচল থেকে বের করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে প্রয়োগ করা হত, তবে হয়ত নতুন এই 'ডেটা সুরক্ষা আইন'কে জনগণের সুরক্ষা আইন বলেই ধরে নেওয়া যেত। 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' যেখানে জনগণের বাকস্বাধীনতা, নিরাপত্তা সব কেড়ে নিয়েছে সেখানে নতুন ' ডেটা সুরক্ষা আইন' তো একেবারে গলাটিপে মারার হাতিয়ার বৈ অন্য কিছু হওয়ার কথা নয়।
তাছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন এই আইন তৈরি করতে হবে? এটা কি বিরোধী দলীয় কর্মীদের ইনবক্স সহ সব কিছু নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা? যা সাধারন জনগণকে বুঝানো হচ্ছে স্বাধীকার রক্ষা বা নিরাপত্তা রক্ষার নামে!
একজন সচেতন ব্লগার হিসেবে এখন আপনি/আমি/আমরা কোন নিশ্চয়তায় এই আইনের পক্ষে কথা বলতে পারি!
কেউ হয়ত বলবেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' পরিবর্তন হয়েছে। আরে ভায়া, এটা কেবল সাংবাদিকদের সাথেসাথে গ্রেফতার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। জামিনে রেখে টুঁটি চেপে ধরা তো আটকানো হয়নি!
যাই হোক, এই পর্যন্ত আমি যা বললাম, তা হয়তো স্রোতের বিপরীতে অনেকের চিন্তার উলটো ভাবনা হতে পারে। দয়া করে কেউ ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বিষয়টিকে গুলিয়ে দিবেন না। দেখুন, এ বিষয়ে ব্লগে অনেক অল্প লেখা আসতেছে। এটি আপনার আমার আমাদের সবার নিরাপত্তার বিষয়। আমেরিকার রাষ্ট্রদুতের কথায় রেগে যাওয়া বা নিজ দেশের নাগরিকদের স্বাধীকার রক্ষার নামে নিজেদের নিরাপত্তা বিকিয়ে দেওয়া কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবই এখন আমাদের সামনে স্পষ্ট।
শুভ ব্লগিং
(জানি না, এই শুভকামনা ক'দিন সবার জন্য থাকছে। তবু আশা রাখবো, যেন সকলে নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারি।)
খসড়া 'ডেটা সুরক্ষা আইন' নীতিটি পড়তে ক্লিক করুন:
এই লিংকে।
ছবি: গুগল ও বিবিসি নিউজ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৮