২০১১ জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় দুই দেশেরমধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের বিষয়টি ছিল। এরপর রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
চুক্তিটি এমন সময় স্বাক্ষরিত হয় যখন পরিবেশবাদীরা প্রবল প্রতিবাদ করছে এবং হাই কোর্টও সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করতে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি
করেছে। এতকিছুর পরেও ২০ শে এপ্রিল বিদ্যুৎ ভবনে ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।
#চলুন তবে চোখ ফেরানো যাক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাভ ক্ষতির দিকেঃ
.
প্রথমেই আসি আর্থিক ব্যাপারটায় : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণ মোট ব্যয়ের ৭০% বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ আনা হবে। ওই ঋনের সমস্ত সুদ বহন করবে বাংলাদেশ। বাকি ৩০% ব্যয়ের ১৫% বহন করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠান পিডিবি এবং ১৫% ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি।
প্রকল্পের লাভ ভাগ হবে ঠিক সমান হারে!
অর্থাৎ ৫০% বাংলাদেশ, বাকি ৫০% ভারতীয় এনটিপিসি!
প্রকল্প কোনও রকম আর্থিক ঝুঁকির মুখোমুখি হলে সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি বহন করবে বাংলাদেশ!!
এই ৭০% ঋণ আমাদের দিবে পার্শ্ববর্তী বন্ধুদেশ ভারত। এবার হিসাবটা খুব সহজ- ৮৫% ব্যয় ও সমস্ত আর্থিক ঝুঁকি বহন করে বাংলাদেশের লাভের পরিমাণ (যদি আদৌ হয়) ৫০%, আর ১৫% ব্যয় ও কোনরূপ আর্থিক ঝুঁকির ভাগিদার না হয়েই ভারতীয়
এনটিপিসি'র লাভের পরিমাণ ৫০%!
হিসাব এখানেই শেষ নয়।
বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ দেশে তিনটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করছে। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে 4
টাকা প্রতি ইউনিট ও খুলনার লবণচড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্ল্যান্ট থেকে ৩.৮০ টাকা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হবে।
অথচ রামপাল থেকে একই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমরা কিনবো ৮.৮৫ টাকা দরে!!!!
দ্বিগুণেরও মাত্র বেশি কিছু টাকা!!!!!!
রামপালে প্রয়োজনীয় সমস্ত কয়লা আমদানি করা হবে বন্ধুদেশ থেকে। এ ব্যাপারে চুক্তিও কমপ্লিট।
টন প্রতি দাম পড়বে মাত্র ১৪৫ ডলার!
প্রতিদিন লাগবে মাত্র ১৩০০০+ টন কয়লা।
বিশ্ববাজারে কয়লার টন প্রতি দামটা জানেন??
কোয়ালিটি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫০- ৮০ ডলারের কাছাকাছি।
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যদি ২০ ঘণ্টা করে ৩০ বছর চালু থাকে এবং ইউনিট প্রতি ৪.৮৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি ধরা হয় কেবল তাহলেই অঙ্কটা দাঁড়াবে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা!!!
.
এবারে চোখ ফেরানো যাক পরিবেশের
ক্ষতির প্রশ্নের দিকেঃ অন্যান্য দেশে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫-২০ কি.মি.-এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। কারন- কয়লাভিত্তিক যেকোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে অন্য যেকোন প্রকল্পের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষত ভষ্মিভূত কয়লার ছাই এবং উৎপন্ন গ্যাসের ফলে বায়ু ও পানি দূষণের যুগপৎ প্রভাবের কারণে এই ক্ষতি হয়। এ ধরনের প্রকল্প এলাকার আশেপাশের অঞ্চলে এসিড বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে যা বৃক্ষ এবং বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে ভয়ানক মাত্রায়।
এব্যাপারে সহজ উদাহরন হতে পারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এই ভারতীয় কোম্পানিকেই তার নিজের দেশে এই যুক্তিতে মধ্য প্রদেশে একটি অনুরুপ প্রকল্প
করতে দেয়া হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রধান ড. কল্যাণ রুদ্র বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের কোথাও সংরক্ষিত অরণ্যের এত কাছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার কোনও নজির নেই। ভারতে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ীই এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘রেড ক্যাটাগরি ইন্ডাস্ট্রি’-র গোত্রে পড়ে; অর্থাৎ এই শিল্প পরিবেশের জন্য অতি বিপজ্জনক, এটা ‘এফ্লুয়েন্ট’ ও ‘এমিশন’ দুটোই করে।
সেখানে কোনও অভয়ারণ্যের খুব কাছে এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
এই প্রকল্প এলাকা সুন্দরবনের ঘোষিত সংরক্ষিত ও স্পর্শকাতর অঞ্চল থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে। এমনকি ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত ১৩২০
মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকেমাত্র ১৪ কি.মি. দূরে!
আবার সুন্দরবন থেকে দূরত্ব আসলেই ১৪ কি.মি.
কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। খোদ ইআইএ রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে প্রকল্পের স্থানটি একসময় একেবারে সুন্দরবনেরই অংশ ছিল।
কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রতি ৫০০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। রামপালের প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে মেটানো হবে পশুর নদী থেকে। পশুর নদীরপানি নোনা ও মিঠা জলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই নদীটির সাথে ওই গোটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংযোগ রয়েছে। এটি ওই অঞ্চলের জনবসতির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী।
কিন্তু এই প্রকল্প তৈরি করতে গিয়ে আমরা সেই নদীর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলার এক মহৎ উদ্যোগ হাতে নিয়েছি।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি বছর কয়লা লাগবে ৪৭ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য, ধারন ক্ষমতা প্রায় ৪৭ হাজার মেট্রিক টন এমন ১০০টি জাহাজ প্রতিবছর কয়লা নিয়ে পশুর নদীর আকরাম পয়েন্ট/ হিরণ পয়েন্ট এ গিয়ে নোঙ্গর করবে। সেখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০০(৪০X১০০) লাইটার জাহাজ কয়লা নামিয়ে রামপালে নিয়ে ডিসচার্জ দিবে। বুঝা যাচ্ছে যে, ৪৭ লক্ষ টন কয়লা প্রতি বছর ২ বার করে ডিসচার্জ হবে। একবার আকরাম পয়েন্টে, আরেকবার রামপালে। হাজার হাজার লাইটার জাহাজ থেকে নির্গত বর্জ্য, ধোঁয়া, তেল থেকে যেমন হবে পানি আর বায়ু দূষণ তেমনি হবে শব্দ আর আলো দুষণ। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়ে গেলে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। পশুর নদী থেকে প্রতি ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উচু চিমনী থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ফলে আশেপাশের তাপমাত্রা বেড়ে
যাবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেবছরে ৭,৫০,০০০ টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ,সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম,বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। কিন্তু আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪
একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাই এর বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানি সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও
মাটির নীচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এটা পরিষ্কার বলা যায়। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার,
নাইট্রোজেন,কার্বন ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ কিংবা পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণ ছাড়াও কুলিং টাওয়ারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণেও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আকারে নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়বে।
.
.
আসুন মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টা দেখে
নেইঃ ১৮৩০ একরধানী জমি অধিগ্রহণের ফলে ৮০০০
পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্ম সংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয় আমরা প্রতি বছর হারাবো কয়েক কোটি
টাকার কৃষিজ উৎপাদন। এই ক্ষতি পোষানোর বিকল্প ভেবে দেখেছেন কি??
.
সুন্দরবনের বহুমুখী গুরুত্বঃ “সুন্দরবন”প্রাকৃতিক ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল জাতিসংঘের আর্ন্তজাতিক কনভেনশন ‘রামসার’ কর্তৃক স্বীকৃত। এর বেশ কিছু অংশকে ইউনেসকোর ‘ওর্য়াল্ড হেরিটেজ’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবনের সবচেযয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব এর সংরক্ষণমূলক ভূমিকা। এ বন উপকূলভাগের ভূমিক্ষয় রোধ করে, উপকূলীয় এলাকা
পুনরুদ্ধার করে এবং নদীবাহিত পলি স্তরীভূত করে। এর মোহনা অঞ্চল বহু ধরনের মাছের প্রজনন কেন্দ্র। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প-
কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলস এবং হার্ডবোর্ড মিলস; প্রথমটির কাঁচামাল গেওয়া এবং দ্বিতীয়টির সুন্দরীবৃক্ষ।
উদ্ভিদনির্ভর অন্যান্য শিল্প-কারখানার মধ্যে রয়েছে দিয়াশলাই ও নৌকা তৈরির কারখানা। এ বনভূমি জ্বালানি, ট্যানিন, ঘরের ছাউনি তৈরির উপকরণ, কাঠজাত দ্রব্য, ভেষজ উদ্ভিদ এবং পশুখাদ্যের অন্যতম প্রধান উৎস ও যোগানদার। দেশের অধিকাংশ মধু ও মোম সংগৃহীত হয় সুন্দরবন
থেকেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রজেক্ট স্থান হিসেবে রামপালই কি সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান?
রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপনে যতগুলি ক্ষতির ব্যাপার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাতে এটাকে অবশ্যই আমরা সর্বশ্রেষ্ট স্থান হিসেবে মানতে পারিনা।
আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রধানত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। উৎস হিসেবে তেল ও পানি থেকে যে বিদ্যুৎ আসে তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় রকমের সম্ভাবনা রয়েছে।
এযাবৎ যেসব কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোর ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। বড়পুকুরিয়ায় এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে নীতিগত আপত্তি দেশের কারো নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যদি ওই এলাকার অন্য কোন স্থানেও হয়, তাতে কেউ আপত্তি তুলবে বলে মনে হয় না। যারা আপত্তি জানাচ্ছেন বা বিরোধিতা করছেন, তাদের আপত্তি বা বিরোধীকার কারন স্থান, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধরন নয়। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির বাইরে অর্থনৈতিকভাবেও এ
প্রকল্প থেকে লাভবান হওয়া যাবে না। (পরিবেশ এবং আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে উপরে আলোচনা করা হয়েছে)
দুঃখের বিষয়, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার মতো স্পর্শকাতর ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষের কাছে ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ প্রকল্পের ফলে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা হবে আত্মঘাতী। রামপালের বিকল্প আছে, সুন্দরবনের নেই। কাজেই রামপালকে সুন্দরবনের ‘দুঃখ’ বানিয়ে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন এ দেশের মানুষ চায় না।
.
.
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে সরকারের বর্তমান অবস্থান এবং সমস্যার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎঃ সব বাধা উপেক্ষা করে বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণাধীন প্রকল্পের কাজ চলছেই। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, মূল
প্রকল্পের কাজ এখনও শুরু না হলেও এর প্রস্তুতি হিসেবে যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তা মূল প্রকল্পের হিসাবে ৩ শতাংশ। প্রকল্প এলাকা ঘুরে আসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেখানে এখনও মাটি ভরাটের কাজ চলছে। যদিও নির্ধারিত জায়গার বিপরীতে এখনও পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়নি বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)।
এ কারণে এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির সঙ্গে ভূমি ইজারা চুক্তি করতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
সম্প্রতি সরকারের দেয়া বিজ্ঞপ্তি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে যা বলেছেন, তার সঙ্গে তাদের আগের বক্তব্যের তেমন কোনো ফারাক নেই। সরকার বারবার বলছে যে, এ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। যদিও বিশেষজ্ঞরা সরকারের এ দাবির সঙ্গে অনেকেই একমত নন। এত কিছুর পরেও কথাটা যথেষ্ট হাস্যকর। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে- সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ককে যতটা আমলে নিচ্ছে, সুন্দরবনকে ততটা আমলে নিচ্ছে না। এ কারণেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার বিষয়ে তারা বদ্ধপরিকর।
প্রকল্পের যে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করা হয়েছে, তাতে প্রকল্প এলাকাকে গ্রাম্য বসতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। গ্রাম্য বসতিতে শিল্প
স্থাপনের মানদণ্ড আর সুন্দরবনের কাছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার মানদণ্ড এক হতে পারে না। অথচ ইআইএ সুন্দরবনের জন্য আলাদা কোনো মানদণ্ড হাজির করেনি।
অর্থাৎ সরকারের ইআইএ সুন্দরবনকে বিবেচনায় নেয়নি। বিদ্যুতের জন্য এরকম ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত
নেবার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে বড় আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
তবে তা যেন পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর না হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার। দেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। কিন্তু অস্তিত্বের ওপর হুমকি সৃষ্টি করে এমন
উন্নয়ন কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবেশ, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রাক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে। ফলে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর কোনো কিছুই কাম্য হতে পারে না।
সুন্দরবনের সুরক্ষায় অবদান রাখা সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিৎ।
.
শেষ কথাঃ এতকিছুর পরেও আপনি যখন এইরকম একটি বিশাল কয়লা পোড়ানো বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইবেন সুন্দরবন থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার দুরে, আর এতে যদি আপনার কোনরকম আতঙ্ক কাজ না করে তাহলে আপনাকে কি বলবো?
অন্ধ?
নাকি দলদাস?
নাকি অন্ধ দলদাস?