somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে আমার ছোটবোন, বড় আদরের ছোটবোন...

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার চেয়ে এক বছরের ছোট, খুব দুষ্টু, মারাত্নক জংলী। আমার জন্য ওর অনেক টান। অতি শৈশব থেকে বাল্যকালের অনেক সুন্দর সময় কেটেছে ওর সাথে। আমরা একসঙ্গে খেলতাম, খাওয়া দাওয়া করতাম, পুকুর দাবড়ে বেড়াতাম, পড়তে বসতাম, টিভি দেখতাম, টেপ রেকর্ডার ছেড়ে গায়ক গায়িকার সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতাম। আরো কত কি। দুজনে একই প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। তখন আমি মনে হয় ক্লাস ফোরে আর ও ক্লাস থ্রী তে পড়ত। আমাদের স্কুল শুরু হত বেলা বারোটা থেকে। বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে শারীরিক ব্যায়ামের চর্চা শুরু হত। সবশেষে জাতীয় সংগীত গাওয়া তারপর শপথ গ্রহনের মাধ্যমে মধ্যবেলার সূর্য্যের প্রকোপ থেকে মুক্তি মিলত। অতঃপর লাইন ধরে সবাই সবার ক্লাসে চলে যেত।
তখনকার দিনে(১৯৯৩ সনে) প্রতি রবিবারে ভারতীয় চ্যানেল ডিডিওয়ান(DD1) এ বেলা সাড়ে এগারোটায় একটা কার্টুন শো দেখাত। কার্টুন শো টির নাম ছিল “DuckTales”. আমার প্রিয় কার্টুন। মাত্র তিরিশ মিনিটের শো। কার্টুন টি আমার দেখা চাই ই চাই। ভাত খাওয়া ছেড়ে দিতে পারতাম ওই কার্টুনের জন্য। যতক্ষন না আমার কার্টুন দেখা শেষ হত ও ততক্ষন আমার জন্য অপেক্ষা করত। কার্টুন দেখা শেষ করে দুজনে একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। পায়ে হেটে স্কুলে যেতে দশ মিনিটের বেশি লাগত না। কার্টুন দেখা শেষ করে দৌড়ে চলে যেতাম। তবে বদ মেজাজী অংক স্যারের বেতের বাড়ি থেকে রেহাই মিলত না। আমার ত বটেই, সঙ্গে ওর ও। আমার জন্য স্যারের বেতের বাড়ি ও মুখ বুজে সহ্য করত। কখনো কোনদিন অনুযোগ অভিযোগটুকু করেনি।

হুম, সে হল আমার আদরের ছোট বোন। আমাদের মাঝে মাত্র এক বছর বয়সের ব্যবধান। ও আমাকে খুব ভালবাসত। আর অনেক যত্ন আত্তি করত। ওর ছিল অনেক সাহস আর আমি মিনমিনে। সমবয়সী এবং বড়দের অত্যাচার থেকে আমাকে রক্ষা করা ছিল ওর একমাত্র কাজ। কি জানি এক অদ্ভুত কারনে সবাই আমাকে অনেক জ্বালাতন করত, কথাবার্তা আচার আচরন দিয়ে। আমি কোন জবাব দিতে পারতাম না, না পারতাম প্রতিবাদ করতে। অপেক্ষা করতাম কখন আমার ছোটবোন এসে উদ্ধার করবে। ও এসে সবাই কে নাস্তানাবুদ করে দিতে। সে কি যে খুশি লাগত আমার।
ও ছিল আব্বা আম্মার প্রিয় পাত্রী। মাথা ভর্তি কোকড়া চুল আর দুধে আলতা রঙ। আমাদের এক নানা ওকে আদর করে ডাকতেন লালবানু। দুস্টু নানা আমার নাম দিয়েছিলেন কালিয়া। আমি ঠিক আমার বোনের উলটো। গায়ের রঙ শ্যামলা। দেখতেও কুশ্রী। আমার বাকি ভাই বোনেরাও দেখতে মোটামুটি। কিন্তু আমিই একমাত্র এক্সেপশনাল পিস। তাই আমাকে সবাই বলত আমি নাকি এই পরিবারের পালক ছেলে। এক আম্মা ছাড়া সবাই বলত। দুস্টুমির চরম সীমা অতিক্রম করলে আম্মাও বিরক্ত হয়ে বলতেন তুই আমার পালকা পোলা। তোর মা হইল এক ফকির বেটি। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়ায়। বেশি দুস্টামি করলে তোকে তোর মায়ের কাছি ফিরিয়ে দেব। সারা দুনিয়ার মানুষেরা আমাকে পালক বললে আমার কিছু এসে যেত না কিন্তু আম্মার মুখে যখন শুনতাম তখন ছোট্ট এই মনটা দুমড়ে মোড়চে ভেঙ্গে চোখের জলের নহর বয়ে যেত। সে যে কি এক মন খারাপি এক অনুভুতি কাউকে বোঝানোর নয়। শুধুমাত্র আমার ছোটবোন এসে আম্মার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিত আর আমাকে শান্তনা দিত। ঘরে বাইরে সকলের কাছ থেকে একই কথা শুনতে শুনতে মনে বদ্ধ বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে আমি বুঝি সত্যিই এই পরিবারের পালক ছেলে। কোন একদিন হয়ত আমার আসল মা, ভিখারিনী মা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই জন্য সব সময় আমি মন মরা হয়ে থাকতাম। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করতে একদম মন চাইত না। বদের হাড্ডি ছেলেপেলে গুলো আমাকে পালক ছেলে বলে খেপাত। তাই ঘরের কোনায় বসে থাকতাম আর টিভি দেখতাম। এই ঘরকুনো স্বভাবের কারনে আব্বা আমার নাম দিয়েছিলেন কুনোব্যাঙ। আমার চেহারা আর আম্মার চেহারায় মিল না থাকলে আমি নিজেও হয়ত আজ বিশ্বাস করতাম যে আমি এই পরিবারের পালক ছেলে। যাক বাবা সান্তনা একটা পেলাম। ছোটবোন আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলত তুমি কোন চিন্তা কর না। আমি তোমাকে কিছুতেই তোমার আসল মায়ের কাছে যেতে দেব না। গদা দিয়ে পিটিয়ে ওই ফকিন্নিকে তাড়িয়ে দেব যাতে জীবনে দ্বিতীয়বার এদিকে আসার সাহস না পায়। আর সকলের মত সেও বিশ্বাস করত আমি তার পালক ভাই। তবে আমাকে সে কিছুতেই যেতে দিবে না। আহা এমন ভালবাসা কোথায় পাবেন বলেন!!!

যাইহোক, ডিসেম্বর মাসের এক পড়ন্ত বিকেল, শীত তখনো এতটা ঝেকে বসেনি। আম্মা বাসায় নেই। গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমরা থাকতাম গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক মফস্বল শহরে। সারা বছরের ধান চাল, তরিতরকারী, শাক সবজি, মাছ মাংসের অর্ধেক অংশই আসত গ্রামের বাড়ি থেকে। তখন ধান কাটার মওসুম চলছে। আম্মা গেছেন সেসব দেখতে। আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যাবে। আব্বা ব্যস্ত বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে। আমাদের পাচ ভাই বোনের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাদের একমাত্র খালার উপর। খালা আমাদের প্রচন্ড রজচটা স্বভাবের, অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যায়। আম্মা বাসায় নেই, এইবার দুষ্টুমি করলে খালার হাত থেক রেহাই নেই। বড় দুই ভাই গেছেন খেলার মাঠে, বড় আপা বান্ধবীদের সাথে গোল্লাছুট খেলায় মগ্ন। আর এদিকে আমি আর মনা(ওকে আমি আদর করে মনা বলে ডাকতাম) কার্টুন দেখছি। হঠাত কি নিয়ে যেন আমাদের মধ্য ঝগড়া লেগে গেল। খালা এসে আমাকের শলার ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা দিয়ে বাথরুমে ছিটকিনি আটকে বন্ধ করে রাখলেন। অন্যদিকে মনাকে কিছুই বললেন না। বেলা গড়িয়ে যায়। ছিটকিনি খোলার নামগন্ধ নাই। এমন সময় শোনা গেল লোহার গেটে কে যেন কড়া নাড়ছে। খালা গিয়ে গেট খুলে দিলেন।

এক রুগ্ন ভগ্ন শরীর নিয়ে ভিখারিনী এসে হাজির। চোখে মুখে করুন আর্তি। দুই দিন যাবত নাকি কিছু খায়নি। কান্না জুড়ে দিল কিছু খেতে দেয়ার জন্য। খালার আবার নরম দিল। ভিখারিনী কে ভেতরে এনে খাবার বেড়ে দিলেন। মহিলাটি মনের সুখে খাচ্ছে আর বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। আমি খালাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা কে এসেছে? বাথরুমের দরজা খুলে দাও আমি দেখব। মনাকে ডাকলাম। বললাম দরজা খুলে দে। খালা বললেন, অবশ্যই দরজা খুলব। দেখে যা তোর আসল মা এসেছে। আজ তোকে নিয়ে যাবে। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আম্মা ত বাসায় নেই। যদি সত্যি আমাকে নিয়ে যায়। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল। মনাও বুঝি ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে আগে একটা গদা নিয়ে আসল। তড়িৎ গতিতে বাথরুমের দরজা খুলে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে খাটের নিচে ঠেলে দিল আর নিজে খাটের সামনে বসে গেল গদা নিয়ে, পাহাড়াদারের বেশে। রুমের দরজাটা লাগিয়ে ছিটকিনি টেনে দিল আর বলল, দেখি ফকিন্নি বেটির কি সাধ্য আমি থাকতে আজ তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। তুমি একটুও ভয় পেও না ভাইয়া। আমি ফকিন্নি বেটির মাথা ফাটিয়ে দেব। তুমি খাটের নিচে বসে থাক। খাটের নিচে গরমে আর ভয়ে আমার শরীর ঘামতে লাগত। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে লাগল। মাগরিবের আজানের ধ্বনি আল্লাহু আকবার শোনা মাত্রই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন হারিকেন জ্বালানোয়। এদিকে আমি আর মনা অনড়। মনাকে বললাম যে আমার ক্ষিধা পেয়েছে। মনা গিয়ে আমার জন্য বিস্কুট আর কেক নিয়ে আসল। আমি খাটের নিচে বসেই সেগুলো সাবাড় করলাম। তারপর পানি এনে দিল। পানি খেলাম। খালা এসে বললেন কি ব্যাপার তোমরা দুইজন এখানে কি করছ? মনা জিজ্ঞেস করল ফকিন্নি বেটি কই? খালা বললেন সে তো খেয়ে দেয়ে দোয়া দুরুদ পড়ে সেই কখন চলে গেছে!!! মনা খালাকে জিজ্ঞেস করল তবে যে তুমি বলছিলে ফকিন্নি বেটি ভাইয়াকে নিয়ে যাবে? আরে আমি ত মজা করছিলাম, খালার নিরুত্তাপ উত্তর। সেই সাথে আমিও খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসলাম। মনা আমার দিকে তাকিয়ে সে কি এক বিজয়ের হাসি দিল। আমিও বিজয়ের হাসি ফিরিয়ে দিলাম। খালা বললেন যাও তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস। একটু পর তোমাদের প্রাইভেট টিউটর আসবেন, যাও তাড়াতাড়ি...


যদিও খালার তরফ থেকে সেটা মজা ছিল কিন্তু মনার তরফ থেকে শতভাগ চেষ্টা ছিল আমাকে রক্ষা করার। এমন আদরের বোন আমি কোথায় পাব!

সময়ের আবর্তে, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে মনা আর আমি আজ পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থান করছি। পারিপার্শিক দুরত্ব যাই হোক না কেন আমরা একে অপরের অতি নিকটে, সন্নিকটে আছি। ইনশাআল্লাহ সর্বদাই থাকব। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:০৭
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×