দুই হাজার বছরের দাসত্বের রেশ অত সহজে কাটে না; তাই পরপর দুবার স্বাধীনতা পেয়েও শেষ প্রভুদের প্রতি মানসিক দাসত্ব ঘুচছে না। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব-জিডিপির ২২.৬% ছিল তৎকালীন ভারতের জিডিপি, যা ছিল তখনকার সমগ্র ইউরোপের জিডিপির সমান। আর ১৯৫২ সালে তা হয়ে গেল ৩.৮% মাত্র। ঐতিহাসিক Angus Maddison এর দেওয়া এ তথ্যমতে, ব্রিটিশ শোষণে উপমহাদেশের অর্থনীতির আকার প্রায় ৬ গুণ ছোট হয়ে গেছিল। Zero-sum game থিওরি অনুযায়ী, আমাদের বাকি ৫ গুণ সম্পদ ব্রিটিশদের ঘরে গেছে। ব্রিটিশ ভারত ছিল ব্রিটিশদের জন্য নিছক captive market. অর্থাৎ, তৎকালীন শিল্পব্যবস্থা ধ্বংস করে এ দেশীয় কাঁচামাল নিয়ে যেত পানির দামে, আর তাদের উৎপাদিত পণ্য আমাদের কাছেই বিক্রি করত চড়া দামে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সাথে বানিজ্যের পথ বন্ধ করে আমাদের শোষণ করে গেছে দুই শতক ধরে। যে সুবা বাংলা ছিল মুঘল ভারতের সমৃদ্ধতম অঞ্চল, ব্রিটিশ শাসনাবসানে সেটা হয়ে গেল অন্যতম দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল। অর্থাৎ, উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমরা কয়েকগুণ বেশি শোষিত হয়েছি। তাহলে আমাদের এই করুণ দারিদ্রের জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশ ছাড়া আর কাকে দুষতে পারি? হ্যাঁ, তাদের রেখে যাওয়া মানসিক গোলামদের কিছুটা দুষা যায়; যারা তাদের রাণীর মরণে কাতর হয়ে এদেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। অথচ এদেশে জাতীয় আনন্দ ঘোষণা করা দরকার ছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সংঘটিত করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশকে খুন করেছিল এই এলিজাবেথ-২ এর পূর্বসূরিরা; তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে তার বাবার রাজত্বে আরো ৩০ লক্ষাধিক খুন। অর্থাৎ বিশ্বে এখন বাঙালির সংখ্যা ৩০ কোটির বদলে ৫০ কোটি হওয়া কথা ছিল। আমরা কি এত সহজে ক্ষমা করে দিতে পারি তাদেরকে? কখনোই না। হয়ত প্রতিশোধ নিতে পারব না বা নেব না; কিন্তু তাদের প্রতি পাকিস্তানের সমান ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে যাব, যতদিন না তারা অন্তত ক্ষমা চেয়ে অনুতপ্ত হবে। ক্ষতিপূরণ না দিক।
ভারতে ছয়শ বছরের মুসলিম শাসনামলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অহরহ। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে, যেখানে মুসলমান রাজা-বাদশাহ'র মন্ত্রী-সেনাপতি ছিল হিন্দু, যেমন মানসিংহ, টোডরমল, হিমু প্রমুখ; আর হিন্দু রাজাদের মন্ত্রী-সেনাপতি ছিল মুসলমান, যেমন ইব্রাহীম গার্দী। ধর্মের চেয়ে ট্যালেন্ট ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্রিটিশরা সে-সুন্দর পরিবেশ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে নিয়ে এসেছে হিন্দু-মুসলিম ঘৃণার সংস্কৃতি। একের পর এক দাঙ্গা ঘটিয়েছে, বপন করে গেছে রামমন্দির ইস্যুর মত ভয়াবহ সমস্যার বীজ। স্বাধীনতাকামী কোনো বিপ্লবী হিন্দু হলে তার পিছে লেলিয়ে দিত গোঁড়া মুসলিম পুলিশ, আর মুসলিম হলে তার পিছে লেলিয়ে দিত গোঁড়া হিন্দু পুলিশ। তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ভারত তো ভাগ হলোই, সেই সাথে হিন্দু-মুসলিম দ্বৈরথের ফলে এখনো উপমহাদেশের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। বলা হয়, একটি পুকুরে দুইটি মাছ ঝগড়া করলে, বুঝতে হবে সেখানেও ব্রিটিশদের হাত আছে।
সিরাজুদ্দৌলা, মীর কাশেম, ভবানীচরণ, মজনু শা, তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, মঙ্গল পাঁড়ে, বাহাদুর শাহ, তাঁর শহীদ প্রিন্সরা, নানা সাহেব, রাণী লক্ষীবাঈ, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, আমাদের গ্রামের মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, নেতাজী ও এমন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরের আত্মবলিদানকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করা হলো এই রাষ্টীয় শোক দ্বারা। অধিকতর পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের প্রশাসনযন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও মিলিটারি এখনো ব্রিটিশ সম্রাজ্যের পচাগলা মৃতদেহ ধারণ করে আছে নির্বিকারচিত্তে। এখনো পুলিশ চলে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনে, বিচারবিভাগের প্রতিটি স্তরে ব্রিটিশ নিয়মনীতি, চলে অবাধ ইংরেজি। লজ্জাজনক!
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমাদের করা সবচেয়ে বড় জাতীয় ভুল কোনটি? কেউ বলে ঘাতক রাজাকারদের দ্রুত বিচার না করা, কেউ বলে যুদ্ধ শেষেই মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে শহীদগণের তালিকা না করা, কেউ বলে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী সরকার গঠন না করা ইত্যাদি; কিন্তু আমি বলি, সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের ক্রীত গোলামদের প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও মিলিটারি সমূলে উৎপাটিত করে নতুন আইন-কানুনসহ সম্পূর্ণ নতুন প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও মিলিটারি গড়ে না তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:১৭