নাফিসার জায়গায় অন্য কোন পেসেন্ট হলে হয়ত এতক্ষণে মানসিক রোগী হিসেবে একটি ডায়াগনোসিস ধরিয়ে দিয়ে মেন্টাল ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দিতাম। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে কিছুতেই মানসিক রোগ মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছে না। এই তো বিকেলেই ওর সাথে কথা হল। সুন্দর সাদা চামড়ায় ভাঁজ পড়ে ধুতরা দিয়ে গেছে। তবুও দেখে বোঝা যায় এক সময় অসম্ভব রুপবতী ছিল। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে পুরু কালো দাগ, তবুও চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ। তাতে বুদ্ধিদীপ্তি চাহনী।
আমার দিকে ভ্রু নাচিয়ে বলল ,''তুমি কি আমাকে পাগল ভাবছো?''
আমি কিছু না বলে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
আমি আর নাফিসা ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়েছি। তুখোড় ব্রিলিয়ান্ট ছিল নাফিসা, এস এস সি, এইচ এস সি তে স্টার মার্ক্স, তারপর ভার্সিটি থেকে পাস করতে না করতেই সেই ভার্সিটিতে বায়োকেমেস্ট্রিতে চাকরী। আর আমি হলাম সাইকিয়াট্রিস্ট। যৌবনের সেই দুরন্ত সময় নাফিসার রুপে ক্রাশ খেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার কাছে ভালোবাসা প্রকাশের আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। সে স্বামীসহ চলে যায় ইউ কে। তারপর শুনেছি সেখানে তার একটি মেয়েও হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুরোদুস্তুর সুখের সংসার। এখন আবার বহু বছর পর ফিরে এসেছে। একদম একা! স্বামী এবং মেয়ে দু জনই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এমন অবস্থায় মানুষ POST TRAUMATIC STRESS DISORDER এ ভুগতেই পারে। নাফিসার ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হয়েছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করছি।
নাফিসা আবার বলল ,''তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো আমি সত্যি বলছি! আমার মেয়ে বিপদে আছে। সে স্বপ্নে আমাকে বার বার কিছু বলতে চাইছে! কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না!''
-''নাফিসা,তোমার মেয়ে আসিফা এখন সব প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে। সে কি করে বিপদে থাকবে? তার জীবনের সব থেকে বড় বিপদটিই সে উতরে যেতে পারে নি। তাই সে তোমাকে ছেড়ে বিধাতার কাছে চলে গেছে। বিশ্বাস করো সেখানে সে ভালো আছে! তুমি অযথাই তাকে নিয়ে ভাবছো।''
নাফিসার মুখে এবার কিছু বিরক্তির ছাপ। ''আচ্ছা তোমরা সাইকিয়াট্রিস্টরা বিধাতায় বিশ্বাস করো?''
-নাফিসা, তুমি ভালো করেই জানো আমি মনে প্রাণে একজন আস্তিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। এ প্রশ্ন কেন করছো?
-কারণ আমি বুঝতে চাইছি তুমি টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করো কিনা? আমার ধারণা বিধাতা আমাদের মা এবং মেয়ের মাঝে যোগাযোগের অদৃশ্য ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছেন! জানো ,আসিফার বয়স যখন আট বছর তখন সে স্কুল থেকে ফেরার পথে একবার রাস্তার পাশের কুয়াতে পড়ে গিয়েছিল। তারপর আমরা সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। তিন দিন তাকে খুঁজে পাই নি। তারপর একরাতে ঘুমের ঘোরে আমি স্বপ্নে দেখি আমার মেয়ে কুয়াতে বসে কাঁদছে। তারপর সবাইকে নিয়ে সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখি সে আসলেই সেখানে ছিল!
অঝোরে কাঁদতে শুরু করে নাফিসা। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি না। সন্তান হারা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই। কাঁদুক। কেঁদে যদি মন হালকা হয়! তারপর না হয় অন্যভাবে কাউন্সেলিং করা যাবে।
কিছুক্ষণ পর রুমাল দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু সে। যেন কথা বলার ঘোর চেপেছে। ''জানো, এখন আমি প্রায় রোজ রাতে স্বপ্নে দেখি আমার মেয়ে একটি রুমে বন্দী, তাকে পাড়ার বোখাটে শিম্পাঞ্জিমুখো চিকনা ছেলেটা এসে বিরক্ত করছে! এই ছেলে আসিফা বেঁচে থাকতেও তাকে বিরক্ত করতো! এজন্য আসিফার বাবা একবার পুলিশ কেইসও করেছিলেন।''
-কিন্তু নাফিসা, তোমার মেয়েকে সে এখন কি করে বিরক্ত করবে? তুমি তো নিজের চোখে তোমার মেয়ের লাশ দেখে এসেছো! তাকে কবর দিতে দেখে এসেছো! একটা মৃত মেয়ের কাছে তার কি প্রয়োজন হতে পারে! তুমি একদম অযথা ভাবছো। তুমি স্বামী ,সন্তান এক সাথে হারিয়ে স্ট্রেসে আছো। তাই এমন হচ্ছে!
-'আমি জানি না' বলে আবার কাঁদতে শুরু করে নাফিসা।
''আমার মেয়ে রোজ রাতে এসে আমাকে বলে, 'মা তুমি আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেছো! ঐ কুকুরটা রোজ রাতে এসে আমাকে বিরক্ত করে। আমাকে রেপ করতে চায়! তুমি এসে আমাকে বাঁচাও মা!''
নাফিসার মাঝে স্ট্রেস আর এংজাইটি ছাড়া আমি মেজর কোন মেন্টাল এবনরমালিটি পেলাম না। তাকে কিছু সিডেটিভ ড্রাগ দিয়ে বললাম ,''ঠিক মত খাও আর নামাজ পড়ে আসিফার জন্য দোয়া করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। মানুষ যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন সে আপনজনদের কাছে একটি জিনিসই চায়। তা হল দোয়া। দেখবে এরপর থেকে স্বপ্নে তুমি আসিফাকে খুশি দেখবে। দেখবে সে ভালো আছে।''
নাফিসা বুদ্ধিমতি মহিলা। তার চেহারা দেখে মনে হল সে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে।
তারপর প্রায় মাসখানেক পর লন্ডন থেকে নাফিসার ফোন। ''জানো আমি স্বপ্নে ঠিকই দেখেছিলাম। আমার মেয়ে সত্যি বিপদে ছিল। সে দিন যখন তোমার সাথে কথা বলে বাড়ি গিয়েছি সে দিন রাতে মেডিসিন নেয়ার পরও আমি একই স্বপ্ন দেখেছি! তারপর আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারি নি। সোজা টিকিট কেটে দু দিন পর চলে এসেছি লন্ডনের গোরস্থানে আমাকে মেয়েকে দেখতে! এসে দেখে ওর কবর অনেক খানি খোড়া হয়েছে। এখানে আরো কয়েকটা কবর থেকে নারী শব গায়েব! তারপর রাতের বেলা পুলিশ নিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম! দেখি ঐ জানোয়ার বোখাটে ছোকরাটা ওর সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে এসে আমার মেয়ের কবর ধরেছে। সেই রাতে ওর লাশ গায়েবের কথা ছিল! ওরা নারী শবের সাথে সংগমে মিলিত হয়। তারপর বডি নদীতে ফেলে দেয়। এ নিয়ে এদেশের পত্রিকায় বিশাল রিপোর্টও হয়েছে। আমি তোমাকে ইমেইলে লিঙ্ক সেন্ড করেছি, দেখো। ভাগ্যিস আমি সময় মত এসেছিলাম! নয়ত ওরা আমার মেয়েও......।''
নাফিসার কন্ঠ ধরে আসে। সে লাইন কেটে দেয়।
আমি নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম! বহু আগে মেডিকেলে NECROPHILIA বলে একটি টার্মের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু কখনো তেমন পেসেন্ট চোখে পড়েনি। আজ বাস্তবতা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আরো বেশি অবাক হচ্ছি নাফিসা আর তার মেয়ের মাঝে সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন জগতের মধ্যে মমতার সেতু বন্ধন দেখে। মাতৃত্ব হয়ত সীমানা, কাল, মহাবিশ্বের সীমারেখা এমন কি পরজগতকেও বশ মানিয়ে মনের অদৃশ্য দরজাগুলো খুলে প্রিয়জনের কাছে পৌছে দিতে পারে কান্না,হাহাকার, অথবা সুখ-দুঃখের কথাগুলো। ব্যাখ্যার অতীত কত কিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে!
ইমেইল খুলে রিপোর্টটা পড়লাম। নাফিসা তার মেয়ের একটা ছবিও পাঠিয়েছে। নীল চোখের হাস্যজ্জ্বল সতের কি আঠারো বছরের একটা মেয়ে! হঠাৎ করে কেন যেন মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। আস্তে করে বললাম, যেখানেই থাকো ভালো থেকো আসিফা।
তারপর আবার পেসেন্ট দেখায় মনোযোগ দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:০৫