somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃবৃত্ত বন্দী নীহারিকা!

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি নীহারিকা। তবে আকাশের তারাগুলোর মত অগোছালো নই। বেশ পরিপাটী একটা মেয়ে। সব কিছুতেই আমার পারফেক্ট হওয়া চাই। এ জন্য বন্ধু মোহলে আমি ''মিস পারফেকশনিস্ট'' হিসেবে পরিচিত। সব সময় গুছিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। ''খাইসি,পাইসি, গেসি'' এভাবে কথা বলা আমার একদম পছন্দ না। তাই সবার ধারণা আমার লাইফ পার্টনার যে হবে তাকেও আমার মত পারফেকশনিস্ট হতে হবে। নয়ত আমার সাথে একদম মেচ করবে না। আমি নিজেও সেদিনের আগ পর্যন্ত তাই মনে করতাম!

এম বি এ ক্লাসের প্রথম দিন। ক্লাসে সবাই সবার সাথে পরিচিত হচ্ছি। আমি দাঁড়িয়ে সবার সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরলাম।'' আমি নীহারিকা। ভালো কবিতা লিখতে পারি। গানের কন্ঠও বন্ধুরা বলে খারাপ নয়। আশা করি আপনাদের সাথে এই এক বছর খুব সুন্দর কাটবে।''

হঠাৎ পেছন থেকে একটা ছেলে বলে উঠল,''নীহারিকা! এমন নাম উচ্চারণ করতেই সবাই দম ফুরিয়ে মারা যাবে। আমি এমন কঠিন নাম উচ্চারণ করতে পারবো না। আমি জাস্ট নীহু বলে ডাকবো। তোমার ভালো লাগলে লাগুক আর না লাগলে না লাগু্ক।''

ক্লাসের সবাই তার ফোঁড়ন কাটায় হি হি করে হেসে উঠলো। আমি রেগে উঠতে গিয়েও রাগলাম না! কিছুটা বদমেজাজী হলেও কেন যেন রাগ করতে পারলাম না! ওই ছেলেটার মাঝে কেমন যেন একটা মাদকতা আছে! ওর দিকে তাকালে মাথায় ঝিম ধরে। আমি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারলাম না। নয়ত আমার নাম ছোট করে ডাকার অনুমতি আমি তাকে কখনোই দিতাম না। আমি আমার নাম খুব পছন্দ করি। এটাকে ছোট করে ডাকা আমার পছন্দ না।

তারপর ছেলেটি দাঁড়িয়ে তার পরিচয় দিল ,''আমার নাম রিসাত। নিশ্চিত থাকুন এই এক বছর আপনাদেরকে অনেক জ্বালাতন করব। ভাবছেন সৌজন্যতা দেখাচ্ছি? মোটেও না! কেউ বিরক্ত হলে হন, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না!''

আমিও তার বেলায় ফোঁড়ন কেটে প্রতিশোধ নিলাম! ''আপনার নাম রিসাত বলে তো ডাকতে পারবো না। কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা শোনায়। আপনাকে আমরা 'রাসু' বলে ডাকবো। এর মাঝে একটা গুন্ডা গুন্ডা ভাব আছে।'' ক্লাসের সবাই আমার কথা শুনেও হেসে উঠলো এবং সম্মতি জানালো। আমি নিজে আমার নিজের বিহেভিয়ারে কিছুটা অবাক হলাম! কি আশ্চর্য আমি একটা ছেলের নাম বিকৃত করছি! এভাবে কারো নাম বিকৃত করা পারফেকশনিস্টদের মানায় না। অবশ্য তার নাম বিকৃত করলেও আমি তাকে রিসাত নামেই ডাকতাম।

যা হোক এই ধরণের মানুষদের আমি একদম পছন্দ করি না! এরা সব কিছুতেই ইম্পারফেক্ট। তবে মজার ব্যাপার হল এরা এটাকেই ক্রেডিট মনে করে। আসলে যে সবার সামনে জোকারে পরিণত হয়েছে সে খেয়াল এদের নেই! রিসাতের সাথে আমার দাঁ কুমড়ো সম্পর্ক শুরুতেই পাক্কা হয়ে গেলো। তবে তার মানে এই নয় আমি ওর সাথে ঝগড়া করব। আমি ঝগড়া কখনোই করি না। এটা পারফেকশনিস্টদের মানায় না। আমি জাস্ট ওকে এভয়েড করব। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই আমি এগোচ্ছিলাম।

এক মাস পরের কাহিনী। রিসাত ক্লাসের মাঝে কলমের নিব খুলে সবার শার্টে কালি মাখাচ্ছে। আর ছেলেগুলো এত ভীষণ মজা পাচ্ছে। কিছু মেয়ে গিয়েও ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্তু আমি গেলাম না। আমি এ ধরণের ফান একদম পছন্দ করি না! হঠাৎ রিসাত নিপ খুলে কলমের কালি আমার সাদা জামায় ভরিয়ে দিল। আমি তো রেগে মেগে ফায়ার!
যেই কাজটা আমি কখনোই করি না আজ কেন যেন সেটাই করলাম! আমিও আমার কলমের নিব খুলে কালি বের করে রিসাতের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছি! রিসাত দৌড়ে ক্লাসের এই মাথা থেকে ঐ মাথা! আমিও তাই করছি! সবাই বেশ মজা পাচ্ছে আমাদের ছেলেমানুষীতে। কিন্তু সে খেয়াল আমার কই? আমি দৌড়াচ্ছি না, যেন উড়ছি! নিজেকে নীল আকাশের পাখি মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে ডানা মেলে আমি সহস্র শীতল মেঘ পুঞ্জ ছেড়ে রিসাতের পিছু পিছু উড়ে চলছি! পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই! শুধু আমি আর রিসাত!

রিসাতের কাছ থেকে ওর কিছু বদগুণ আয়ত্ব করতেও আমার সময় লাগল না। কিছুদিনের মাঝেই আমার ভাষা ,''খেয়েছি,পড়েছি, গিয়েছি'' থেকে ''খাইসি, পড়সি,গেসি'' তে পরিণত হল! কি আশ্চর্য! যেভাবে কথা বলা আমি ঘৃণা করতাম আজ সেভাবে কথা বলছি। কথায় কথায়,''তুই একটা চামার।'' ,''যা ভাগ শালা'' এই ধরণের কথাগুলো খুব সুন্দর করে বলা শুরু করলাম! ইম্পারফেক্ট জীবনে কখনো এত সুখ থাকতে পারে আমি কোন দিন ভাবি নি। সত্যি রিসাত তুমি সবই পারো! তুমি আমাকে ইম্পারফেক্ট লাইফ শিখিয়ে পারফেক্টলি হ্যাপি হতে শিখিয়েছো! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখন আমি কেবল একটি কথাই বলি,''হাউ পারফেক্টলি হ্যাপি আই এম!!! আমি তোমাকে কত ভালোবাসি রিসাত! হাউ ক্যান আই সে হাউ মাচ আই লাভ ইউ!''

''নীহু তোমাকে ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি তোমাকে নীহু! নীহু আমি তোমাকে কোন দিন ভুলে যাবো না! কোন দিনও না!!!! অনেক ভালোবাসি নীহু তোমায়'' কথায় কথায় এসব ডায়ালগ ছাড়া রিসাতের নিত্য দিনকার অভ্যাস! ধীরে ধীরে এই অভ্যাস কিছুটা বেয়াদবিতে রুপ নিল! ওর সাহসের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো! আমিও প্রশ্রয় দিয়ে যেতাম। রিসাতের মুখে নোংরা কথাগুলো শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম! অথচ আমি মেয়ে হিসেবে বেশ ভালোই কনজারভেটিভ। খুব তীব্রভাবে ঘৃণা করি এধরণের নোংরামী। কিন্তু রিসাতের বেলায় কেন যেন কোন যুক্তিখাটে না! ও যখন একটা অশ্লীল গান গেয়ে বলে বাসর রাতে ঐ গানটা তোমাকে শোনাবো, আমি প্রতিবাদ করি না। আমি উৎসুক!! প্রচন্ড উৎসুক! তবে মুখে সব কথা বলার মত লজ্জা তখনো হারাইনি। আমার চিন্তা চেতনা কল্পনাতে তখন পুরোপুরি রিসাতের বাস! আমার চিন্তায় ওর সাথে সহবাস! ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত ভাবা আমার জন্য মৃত্যুর মত ভয়ংকর! তাই কখনো ভার্সিটি ছুটি হলে ওকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতাম! কি তীব্র এই দু চোখের তৃষ্ণা!

এ দিকে দেখতে দেখতে আমাদের এম বি এ ক্লাস শেষের দিকে চলে আসে। পরীক্ষা দিয়ে সবাই বাসায় চলে যায়। আমার রিসাতের সাথে কথা ছিল যে সে পরীক্ষার রেজাল্ট দিতেই আমাদের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবে। তারপর হবে আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাসর। যেই তৃষ্ণায় দুজনেই তৃষ্ণার্ত! যেই ভালোবাসার অপেক্ষায় দুটি প্রাণের এত ছটফটানো!

কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে রিসাতের ফোন অফ! তাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এম বি এ তে আমরা দুজনেই ভালো ফলাফলে উত্তীর্ণ হলাম। তবু রিসাতের কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেলো না! আমি রিসাতের বাসার এলাকায় চলে গেলাম ওকে খুঁজতে! গিয়ে জানলাম রিসাত তার এক কাজিনকে বিয়ে করেছে! আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! আমি কি সত্য শুনছি! রিসাত আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলো! আমার পৃথিবী যেন ভেঙে আসতে থাকলো! চোখের সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকলো আমার অস্তিত্ব! যেদিকে তাকাই শুধু রিসাত আর রিসাত! কানের মাঝে সাইরেনের মত সব সময় বাজতে থাকে ''নীহু তোমাকে ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি! কোন দিন তোমাকে ভুলে যাবো না নীহু! কোন দিন না! অনেক ভালোবাসি নীহু তোমায়!'' আমি আর পারছিলাম না। রিসাত ছাড়া আমি কিচ্ছু নই! কিচ্ছু না! ওকে ছাড়া এক মুহূর্তও আমি বাঁচার কথা চিন্তা করতে পারি না!''

আমি হয়ত এক ধরণের ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। রিসাতের ঘোর! একদিনের ঘোরের ভেতরেই এক মুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেই ফেসবুকে রিসাতের তার স্ত্রীকে নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাস পড়ে! নিজেকে আর সংবরণ করতে পারছিলাম না। রিসাত একটা কথা প্রায়ই বলতো,''জানো বিধাতা স্বামীর বুকের পাঁজরের হাড় দিয়ে তার স্ত্রীকে বানিয়েছেন। তুমি আমার বুকের পাঁজর নীহু!'' সেই রিসাত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে ''আমার বুকের পাঁজর স্ত্রীটাকে নিয়ে কক্সেসবাজারে হানিমুনে এসেছি। সবাই দোয়া করো!'' যেই আমি এতদিন ছিলাম তার বুকের পাঁজর আজকে হয়ে গেছে আরেকজন! আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না! তীব্র ঘৃণা আর কষ্ট বুকেতে চেপে বসেছিল! যে করেই হোক আমি তার থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম!

কিন্তু জীবন আমাকে মুক্তি দিল না। কয়েকদিন পর হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিস্কার করলাম। বাবা মা আমাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত! তারা এখন আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে! তাদের এত বুঝদার, সুচিন্তার অধিকারী মেয়েটা হঠাৎ করে হয়ে গেলাম গলগ্রহ!

মাস খানেক পরে শাহেদ নামক এক বিজনেস ম্যানের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আমার! শাহেদ খুব পারফেক্ট একটা ছেলে। রিসাতের সাথে সম্পর্কের আগে আমি যেমন ছেলেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু একবার ইম্পারফেক্ট লাইফের নেশা রক্তে ঢুকে গেলে এই নেশা কি এত সহজে কাটে! আমি স্বামী হিসেবে শাহেদকে মেনে নিতে পারলাম না! আর এটার সাথে শাহেদও সহজেই মানিয়ে নিল। ঝগড়াঝাঁটি করে পাড়া প্রতিবেশীকে ঘরের কথা শোনার লোক শাহেদ নয়। পারফেকশনিস্টরা এ ধরণের অভিনয় খুব সহজেই করে পারে! দেখে কখনো বোঝা যাবে না ভেতরে কতটা যুদ্ধ চলছে!

এদিকে শাহেদের সাথে আমি ঠিকই দূরত্ব বজায় রেখেছি। দুজনের বেড এখনো আলাদা! তারপর একদিন ফেসবুকে রিসাতের স্ট্যাটাসে দেখলাম তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা! মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর! সাথে তীব্র ঘৃণা তো আছেই! হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলাম রিসাত যদি পারে আমিও পারবো!

শাহেদ বাড়ি ফেরার পর আজ স্বেচ্ছায় ওকে জড়িয়ে ধরলাম! কিন্তু ওর হাতের বাঁধন শক্ত হতেই আমার দম আটকে আসতে থাকল! আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম! তারপর আবার নিজেকে বোঝালাম,''তোকে পারতেই হবে নীহারিকা! রিসাত পেরেছে! তুই কেন পারবি না? আর শাহেদ তো কোন দোষ করে নি! তোর মত অন্যের প্রেমের অন্ধ হয়ে সুইসাইড করতে চাওয়া একটা মেয়েকে জেনে শুনে বিয়ে করেছে। বিয়ের পরেও তোর কোন রকম অমর্যাদা করে নি! তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোকে জোর করে পেতে চায় নি। তবে কোন অপরাধে শাহেদ কষ্ট পাবে?'' আমি আবার শাহেদের কাছে ফিরে গেলাম। শাহেদের ঠোটে ঠোট রেখে ওকে ওর অনুযোগগুলো থামিয়ে দিতে চাইলাম! কিন্তু বুক ঠেলে বমি আসতে থাকল। আমি দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগালাম। শাহেদের উদ্বিগ্ন কন্ঠ ,''তুমি কি অসুস্থ নীহারিকা? দরজা খোলো! আমাকে তোমাকে হেল্প করতে দাও!''

আমি তখন তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়েছি। বুক ভাঙা কান্না! মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। আমি তো অক্ষম নই। রিসাতের সাথে থাকলে জৈবতৃষ্ণায় পাগল হয়ে উঠতাম! কিন্তু সেই তৃষ্ণা মেটাবার মত সাধ্য তখন হয় নি। কিন্তু এখন আছে! রিসাতের সাথে নয়, অন্য কারো সাথে! কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি অক্ষম। ''তুমি ভুল বলতে রিসাত! তোমার মনে হত ভালোবাসা মানে বেশির ভাগই কামনা! তাই যদি হবে তবে আজ কেন আমি এতটা অসহায়! তুমি ভুল ছিলে রিসাত! তুমি সম্পূর্ণ ভুল!''

আমার অসহায়ত্ব শাহেদ বুঝে নিয়েছিল। পারফেক্ট মানুষদের নিয়ে অনেক সুবিধা। ওরা সহজেই সব কিছু বুঝতে পারে। তবে ধীরে ধীরে শাহেদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে শাহেদের স্পর্শকে খুব স্বাভাবিক মনে হতে লাগল। কষ্টের তীব্রতাও শাহেদের স্নেহময় স্পর্শে কমে এসেছিল। আমি আস্তে আস্তে সাংসারিক হচ্ছিলাম। আবার হচ্ছিলাম সেই আগের মত পারফেকশনিস্ট। জীবন গুছিয়ে আসছিল। এভাবে যদি জীবন চলে যায় তবে মন্দ হয় না। শাহেদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আমার চিন্তাতেও অনেক পরিবর্তন আসে। আমি ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকি। সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে শাহেদের উপর মায়া বাড়ে। আমি মায়া আর ভালোবাসার মধ্যে গুলিয়ে ফেলি। শাহেদকেই এখন মনে হয় ভালোবাসা। তাই তার খুব কাছাকাছি সময় কাটানোতেও কোন সমস্যা হয় না। এখন দিব্যি রাতের পর রাত শাহেদের বুকে মাথা রেখে পাড় করে দেই! এমন কি আমরা আমাদের পরিবার আরো বড় করার কথাও ভাবছি। পরিবারের নতুন শিশু অতিথির আগমন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

কিন্তু শাহেদ আর আমার সুখের সংসারে ঝড় উঠতে বেশি সময় লাগল না! একদিন মার্কেটে আমার রিসাতের সাথে দেখা! আমি দেখেও না দেখার ভান করে হেটে চলে আসছিলাম। রিসাতই পেছন থেকে ডাকলো ,''কেমন আছো নীহু?'' আমি শুনেও শুনলাম না। রিসাত তো সেদিন আমার কথা শোনে নি। আজ আমি কেন শুনবো? রিসাত আবারো ডাকল,''নীহু আমার সাথে কথা বলবে না?'' আমি এবার বললাম ,''কেন বলব না? কিন্তু আমি একটু ব্যস্ত। আমার স্বামী ঘরে অপেক্ষা করে আছে। আরেক দিন না হয় বলব!'' কিন্তু রিসাত আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। ''অনেক দিন পর তোমাকে দেখছি নীহু! একটু বসে যাও। এই যে সামনে রেস্টুরেন্ট। অন্তত আমার সাথে এক কাঁপ কফি খেয়ে যাও। তোমার খুব বেশি সময় নিব না।''

আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলাম। রিসাতের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখের নিচে কালি পড়েছে। কয়েকদিন ঘুমায় নি বোধয়। রিসাত আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর একটা প্রশ্ন আমাকে খুব তাড়িয়ে বেড়াতো।''রিসাত আমাকে কেন ছেড়ে গেলো? আমার কি দোষ ছিল?'' বহুবার ভেবেছি ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু ঘৃণায় সে জিজ্ঞাসা আর করা হয়ে ওঠেনি। আজো করলাম না। কারণ আজ এ প্রশ্ন আমার কাছে অর্থহীন। আমার স্বামীটা এতই ভালো আর ওকে পেয়ে আমি এতটাই পারফেক্ট জীবন পেয়েছি যে আমার ইম্পারফেক্ট লাইফের সেই মাদকতা কেটে গেছে। আমি নিজে থেকেই জানতে চাইলাম,''কেমন আছো রিসাত? তোমার স্ত্রী কেমন আছে?''

রিসাত কিছুক্ষণ ঝাপ্সা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। মনে হল যেন কিছুই শুনতে পায়নি। কিছুক্ষণ পর বলল ,''রেণু মারা গেছে নীহু! সাথে আমার সন্তানও মারা গেছে!'' রিসাতের কন্ঠ ভেঙে আসছিল! আমার বুঝতে অসুবিধা হল না রেণু রিসাতের স্ত্রী! রিসাতের কাছ থেকে জানতে পারলাম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে তার স্ত্রী। সন্তানকে নিয়ে রিসাতের খুব স্বপ্ন ছিল। নামও ঠিক করে রেখেছিল। ঘর ভরে ফেলেছে খেলনা কিনে। কিন্তু খেলনা নিয়ে খেলার জন্য শিশুটি পৃথিবীতে আসে নি। তার মাকে নিয়ে চলে গেছে পরপারে! রিসাত অনেক কেঁদে কেঁদে বলেছে ,''রেণু আমার বাবুটিকে নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো!'' কিন্তু ওরা ফিরে আসেনি। চলে গেছে অভিমান করে।

রিসাতের কষ্টের কথাগুলো শুনে আমার মায়া হতে লাগল। ইচ্ছা করছিল রিসাতের টেবিলের উপর রাখা হাতের উপর হাত রেখে একটু সান্ত্বনার বাণী শোনাই। কিন্তু শাহেদের কথা মনে হতেই নিজেকে সংবরণ করলাম! এদিকে রিসাতও যেন আজ বাঁচাল হয়ে গেছে! অনর্গল বলে চলল ,''আমাকে ক্ষমা করে দিও নীহু! তোমার সাথে অন্যায়ের শোধ নিয়তি আমার উপর থেকে নিয়েছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, ভাগ্য আমাকে কষ্ট দিয়েছে! সব কষ্ট সুদে আসলে পুষিয়ে দিয়েছি নীহু!'' রিসাত আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরে। আমি ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,''এখন আর এসব বলে কি হবে? আমরা দুজনেই অনেক দূরে চলে এসেছি। ভালো থেকো রিসাত। আমি এখন আসি। আমার স্বামী অপেক্ষা করছে!''

আমি রিসাতকে ছেড়ে চলে আসি। কিন্তু আদৌও কি আসতে পেরেছি! ঘরে এসে দেখি শাহেদ সোফার উপর শুয়ে আছে। আমি আজ একটু বেশিই আহ্লাদ করি। ওর কপালে গিয়ে চুমু খাই। শাহেদ অবাক হয়ে বলে,''এই যে মহারানী আজ যে একটু বেশিই ভালোবাসা বেড়েছে! ব্যাপার কি?'' ওর জায়গায় রিসাত হলে নিশ্চয়ই বলত,''এই পেত্নী ,এত ভালোবাসা দেখাচ্ছ রহস্যটা কি?'' বেয়াদপ কোথাকার! এই যা আমি রিসাতের কথা ভাবছি! আমি জোর করে রিসাতকে আমার মন থেকে তাড়িয়ে শাহেদের দিকে মন দেই। ওর সাথে গল্পে মেতে উঠি। হঠাৎ গল্পের মাঝে বলে উঠি,'' শাহেদ তুমি একটা চামার! আমার কোন কথা শুনছো না!''
শাহেদ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়!,''এ কি ভাষায় তুমি কথা বলছো নীহারিকা!''
তাই তো! আমি এ কোন ভাষায় কথা বলছি! আমাকে কি আবার সেই ইম্পারফেক্ট লাইফের রোগের ধরল নাকি? আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। দু হাত তুলে বিধাতা কাছে বলি,''আমাকে শক্তি দাও! আমি যেন কিছুতেই আমার স্বামীকে না ঠোকাই।''

ইদানিং ফেসবুকে রিসাতের সাথে আমার প্রায়ই ইনবক্সে যোগাযোগ হয়। কয়েকবার ভেবেছি ওর সাথে আর যোগাযোগ করব না। কিন্তু আবার মনে হয়েছে মাঝে মাঝে মেসেজ দিলে কি হয়? কতজনের সাথেই তো যোগাযোগ থাকে। ওর সাথেও না হয় থাকল।

একদিন রিসাত ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে আমাকে তার অফিসে কফি খেতে ইনভাইট করে। আমি শুরুতে ''না'' করে দেই। তারপর ওর জোরাজুরিতে রাজী হই। এক কাপ কফিই তো! এক সাথে খেলে কি এমন আসবে যাবে!

আমি রিসাতের অফিসে যাই। ও আমার জন্যই ওয়েট করছিল। আমাকে দেখেই হাসি মুখে ভেতরে আমন্ত্রণ জানালো। অনেক অগুছালো ওর অফিস! টেবিলের উপর ফাইলগুলো ছড়ানো ছিটানো। এমন হও্য়াটাই স্বাভাবিক! রিসাতের অফিস বলে কথা! কিন্তু আমার স্বামীর অফিস বেশ গুছানো। একদম পরিপাটি।

আমি ওর সামনের চেয়ারে গিয়ে বসি। একটু পর মেতে উঠি হাসি ঠাট্টায়। আজ খুব পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে! সেই ভার্সিটির ওলি গলি ধরে রিসাতের পিছু পিছু ছুটে বেড়ানোর দিন! ওর শার্টে কালি ভরানোর কথা উঠতেই রিসাত টেবিল থেকে কলম তুলে নিয়ে নিব খুলে হু হু করে হেসে বলল ,''আসো তোমার শাড়িতে কালি ভরিয়ে দেই!'' এই বলে সে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম ,''ভালো হবে না রিসাত। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!'' বলে টেবিলের চারিদিকে দৌড়ে পালাতে লাগলাম! কিন্তু রিসাত ধরে ফেলল! হঠাৎ যেন প্রচন্ড আবেগ নিজের মাঝে চেপে বসে। আমি রিসাতের বুকের মাথা রেখে কেঁদে উঠলাম। রিসাতের চোখ থেকেও ফোটায় ফোটায় অশ্রু এসে গড়িয়ে পড়ছে আমার গালের উপর! আমি আবারো সিক্ত হচ্ছি আমার পারফেক্টলি ইম্পারফেক্ট লাইফের শীতল বারিধারায়! হঠাৎ শাহেদের ভাবনা মাথায় এলো! কিন্তু সেই ভাবনা আমাকে পারলো রিসাতের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। আমি শুধু নিশ্চুপে বললাম,''আমাকে ক্ষমা করে দিও শাহেদ! আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করছি! হয়ত নিয়তি আমাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না! নিয়তি এত বড় অন্যায় ক্ষমা করে না। কিন্তু ভালোবাসা করে! রিসাতের প্রতারককেও নিমেষেই পারে ক্ষমা করে দিতে। পারে আমার মত পারফেকশনিস্টকে এক পলকেই প্রতারক বানাতে! আমরা যে সবাই ভালোবাসার কাঙাল! ভালোবাসার বৃত্তে বন্দী!''
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:২৮
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×