somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমিয়াকুম,এক অনিন্দ্য সুন্দরীর খোঁজে(শেষ পর্ব)

২৬ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোর হওয়ার আগেই আমার ভোর হয়ে গেল স্বভাবতই!কে বা কারা রাতে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল তা না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই।বাইরে বেড়িয়ে দেখি গয়াল বাবাজীদের শত শত পায়ের চিহ্ন।ওরাই যে দল বেঁধে আমাদের পাহারা দিয়ে গেল নিশ্চিত হলাম।ভাগ্যিস!শুধু চেকইন দিয়েই চলে গেছিল!!নইলে আমাদের সাথে কমেন্টস করতে আসলেই দফারফা হয়ে যেতো! তাবু গুটিয়ে আলো আঁধারিতেই ব্যাকপ্যাক গোছানো শুরু করে দিলাম।আজকেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত মায়াবিনীর দেখা পাওয়ার কথা।সময় নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।সবাইকে ডেকে তুলে তাড়া দিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সূর্য্যি মামা জেগে উঠার আগেই আমরা বেড়িয়ে পড়বো।সবাই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বের হতে যাচ্ছি কিন্তু আমাদের দুই গাইড ঝংলং আর ভানলালের তাতে খুব একটা সায় নেই মনে হচ্ছে!ওরা নানা তালবাহানায় দেরী করতে চাচ্ছে।জিজ্ঞেস করতেই কিছু না বলে সামনে হাঁটা শুরু করে দিল।আমরাও তাদের পিছু নিলাম।কিছুদূর এগুতেই দেখি দাঁ হাতে নতুনপাড়ার দিক থেকে একজন আসছে।এতো আরেক মসিব্বত!এমনি সারারাত গয়ালের তাড়া খেয়ে এখনও ঠিকমত হজম করতে পারলাম না আর এদিকে ভোর না হতেই আর একজন আসছেন দাঁ উঁচিয়ে আক্রমন করতে!আর একটু এগিয়ে দূর থেকেই সে ডাকছে আমাদের আধো বাংলা আর ত্রিপুরা ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে।সে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাষা।খেয়াল করে বুঝতে পারলাম সে আমাদের ওদিকে যেতে মানা করছে।মানে আমরা ভুল পথে যাচ্ছি।তাকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের কথা জানালাম।সে জানালো সে চেনে এবং আমাদের সাথে যেতেও রাজি আছে।ঝংলং আর ভানলাল দুজনেই চোখ টিপে হাসছে। নিশ্চয় কাহিনী আছে!জিজ্ঞেস করতেই রহস্য বেড়িয়ে আসলো।আমাদের অতি অভিজ্ঞ দু’জন গাইড সামনের রাস্তা আর চেনেননা। তাই গত রাতে গিয়ে তাকে ঠিক করে আসছেন গোপনে যেন উনি এসে খুব সকালে আমাদের সাথে যোগ দেন।তাহলে সাপও মরল লাঠিও ভাঙলনা!বিশাল ষড়যন্ত্র! ভাবছিলাম, মানিক দা যদি আর একটু পর আসতেন তাহলে কি হত!আমরা হয়তো আরও কয়েকদিনের জন্য পাহাড়েই ঘুরতাম আর গাইডের মুণ্ডুপাত করতাম।
আস্তে আস্তে আমরা মেঘের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছি





কুয়াশা ভেজা দ্যোতং পাহাড় থেকে নেমে আসলাম আমরা।এর পর যে পাহাড় আমাদের অপেক্ষায় ছিল তা পুরোটাই ঘন জঙ্গলে ভরা।বোঝাই যাচ্ছিল,এই রাস্তায় অনেককাল কারও পা পড়েনি।এবারও ভরসা সেই মানিক দা।তার দাঁ’য়ের কারিশমা দেখলাম এবার।দুমদাম জঙ্গল কেটে আমাদের জন্য কোনরকম পা দেওয়ার মত রাস্তা করে দিলেন।ঘণ্টা দু’এক জঙ্গল সাফ করার পর অবশেষে আমরা আবার পরিচিত সবুজের পাহাড় পেয়ে গেলাম।সবুজ পাহাড়ে ট্রেকিং করতে খুব বেশি কষ্ট হয়না কখনও।এভাবে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর একটা আমলকী গাছ পেলাম।আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝংলং বানরের মত লাফ দিয়ে গাছে উঠে গেল আর আমাদের জন্য কিছু নিয়ে নেমে আসলো অবলীলায়।পানি আর আমলকী দিয়ে নাস্তা করে শরীর টা একটা ঝাঁকি দিয়ে নিলাম।যদিও সামনের রাস্তা খুব একটা কঠিন না।তবে আমরা এখন যে পাহাড়ে আছি এটা থেকে রেমাক্রি তে নামতে অনেকক্ষণ লেগে যাবে।বেশ উঁচু একটা পাহাড়।একটু পর পর মেঘ এসে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।এরকম নির্জন পাহাড়ে মেঘের আদর খেতে ভালই লাগছিল!আর ফ্রি ফ্রি যেহেতু পাচ্ছিই তাকে নিষেধ করি কি করে !যতক্ষণ ধরে নামছিলাম নিচের দিকে তার অনেকক্ষণই মেঘের দল আমাদের সঙ্গ দিয়েছে,পরম মমতায় ভাসিয়ে দিয়েছে আমাদের।ক্লান্ত শরীরের ভারটুকো বহন করেছে নিজদায়িত্বে আর আমাদেরকে পূর্ণ করে দিয়েছে বিশুদ্ধ ভালবাসায় ।
সেই বিখ্যাত গয়ালের দল



বহমান শান্তধারা



ক্লান্ত পথিক





ঘণ্টাখানেক নামতে নামতে অবশেষে রেমাক্রির দেখা পেলাম।৩দিন টানা পাহাড় বাওয়ার পর সে এক অনন্য ভাললাগার অভিজ্ঞতা।দূর থেকেই মনে হচ্ছিল কখন নিজেকে সঁপে দিব ঠাণ্ডা জলধারায়।তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একজন তো এক নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছিল প্রায় শেষ ঠিকানায়।কোনরকম শেষ মুহূর্তে গাছ ধরে রক্ষা!পানির স্পর্শে যেন নব প্রাণ জেগে উঠলো প্রাণে।কিছুক্ষণ লম্ফঝম্ফ চলল সমান তালে।ছবি তোলারও এক অলিখিত প্রতিযোগীতায় নেমে গেল সবাই।বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে আমরা রেমাক্রি খাল ধরে সাতভাইকুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল এই পথ।যেহেতু খুব বেশি মানুষের পা পড়েনি এই পথে সেজন্য পাথুরে পিচ্ছিল রাস্তা যেন মৃত্যু ফাঁদ হয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।বিশাল বড় সব পাথরের সাক্ষাত পাচ্ছিলাম একটু পর পরই।বহমান পানির স্রোত সাথে শ্যাওলায় পিচ্ছিল হয়ে থাকা পাথর পেরুতে লাগলাম খুব সাবধানে।একটু পর পর আমাদের আবার খালের এপার ওপার করতে হচ্ছে।যখন খাল পাড় হচ্ছি তখন আমরা সবার হাত ধরে সিরিয়ালি পাড় হচ্ছিলাম।যেন একজন স্রোত আর পিচ্ছিল পাথরে পড়ে গেলেও অন্য যে কেউ তাকে আটকাতে পারে।আর কিছুক্ষণ এগিয়ে একটা চালতা গাছ পেলাম।গাছ ভর্তি চালতা।এবার আমিই উঠে গেলাম।কিন্তু খেতে পারলাম না।এতো তিতা আর টক।ওরে বাব্বা।ভাবছিলাম পাইছি আজ।চালতা দিয়াই লাঞ্চ সারবো।কিন্তু কোথায় কি!শেষে রেমাক্রির পানিই ভরসা।আর একটু এগিয়ে পেয়ে গেলাম হাতী পাথর।দেখতে একদম হাতীর শুঁড়ের মত পাথর টা।আর কিছুদূর এগিয়েই আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের গন্তব্য সাতভাইকুমের দেখা।সে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা।চারদিকে জেলখানার মত বিশাল সব উঁচু পাথরে ঘেরা ।আর সামনে নীল সমুদ্রের মত স্বচ্ছ জলরাশি।ওখান থেকে দূরে তাকালে শুধু আকাশ টাকেই নজরে পড়ে।এক আকাশ বাড়ি আমার।এতো নির্জন গাঁ ছমছমে পরিবেশে এক আশ্চর্য মাদকতায় আক্রান্ত হলাম আমরা।মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা।এর পর সামনে আর এগুনোর রাস্তা নেই আমাদের।অনন্তকাল ধরে ওখানেই থেকে যেতে হবে আমাদের।আমরা সেখানে থেকে যেতেও প্রস্তুত।এমন স্বর্গীয় ছোঁয়ায় যুগ যুগ ধরে থাকা যায়।বাস্তবিকই সেখান থেকে সামনে এগোনোর রাস্তা বন্ধ আমাদের।কারন সামনে গভীর পানির স্রোত আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ।যে জলধারা চলে আসছে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত আমিয়াকুমের বক্ষ চিরে।এই গভীর পানির স্রোত পেরুতে হলে একটাই কর্তব্য।আর তা হল ভেলা।তিন গাইডকে কাজে লাগিয়ে দিলাম বাঁশ কেটে আনতে।মানিক দা’র দাঁয়ের কেরামতি আবার কাজে লেগে গেল।প্রতি পদে পদে মনে হচ্ছিল সে না থাকলে কি হত আমাদের!নিজের মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেললেও কেউ আমাদের বাঁশ দিতনা!ওরা ভেলা বানাচ্ছে আর আমরা আবার মেতে ওঠলাম ছবি তোলার প্রতিযোগিতায়।অবশ্য ছবি কিছুতেই ওখানকার নির্জনতাকে ধারন করতে পারবেনা,যেমন পারবেনা অনুভূতি গুলো কে বন্দী করতে ক্যামেরার শাটারে।তাই আনত মায়া ভরে পুরে নিলাম দু’চোখ, এক ভালবাসার স্বর্গোদ্যানে।





একটা ছোট মাছ অনেকক্ষণ ধরেই আমার দিকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল বারবার।সে হয়তো আমাদের দেখে গয়ালের মত জবাবদিহি চাইতে আসছিল বারবার।কে হে তোমরা আমাদের রাজত্যে!সময় থাকতে পালাও এখান থেকে।এখানে শুধু আমরাই থাকি।পিচ্ছি কি আর তখনও জানে ওর মত কত পিচ্ছি বড়দের ধরে আমি কতল করেছি অবলীলায়।জানলে কি আর আমাকে হুমকি দিতে আসতো!গভীর পানিতে মাছ ধরতে হলে (বিনা অস্ত্রে)টাইমিং টা খুব জরুরী।আর একবার যখন হুমকি দিতে আসতে যাচ্ছিল তখনি ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর আমার সাধের গামছা নিয়ে।গামছাকে জাল বানিয়ে যখন ওপরে তোললাম তখন দেখি বেচারা আমার করতলে।সবাই হাততালি দিয়ে আমার বিজয় উদযাপন করলো।আর আমার সেকি ভূবন জয়ের হাসি।যেন এইমাত্র তেপান্তরের রাজ্য জয় করে ফিরলাম।ভি চিহ্ন দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তোলা ছবিও সেই সাক্ষই দেয়!
ভেলা তৈরি।তাও একটা না দুইটা।যদিও একটা ছোট।কোনরকম একজন যেতে পারবে।সবারই খুব খুব ইচ্ছে ছিল এখানে তাবু ফেলবে।কিন্তু মাত্র বাজে ১ টা।এতো সময় নষ্ট করার মত সময়ও আমাদের হাতে নেই।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আগাই আমাদের সুন্দরীর দিকেই।আমাদের একজন সব ব্যাকপ্যাক নিয়ে প্রথম ভেলায় চলে গেল।সাথে ঝংলং গেল ভেলা ফিরিয়ে আনার জন্য।আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।স্রোতের উল্টা পথে ভেলা চালিয়ে যাওয়া সোজা কথা না।২৫/৩০ মিনিটের কমেতো হবেইনা।তার মানে ফিরে আসতে আবার এক ঘণ্টার ধাক্কা।কি আর করা।আমরা তবে এতক্ষণ নির্জনতার সাথেই প্রেম করি।





ভেলা বানাতে ব্যাস্ত মাণিক দা



এই সেই মৎস্য যাকে ধরে বানিয়েছি বৎস



ঝংলং ফিরে আসতেই আমরা উঠে বসলাম ভেলায়।আমাদের কাছে একটা লাইফ জ্যাকেট আছে।সেটা দিয়ে দিলাম অগ্নিকন্যারে।মানিক দা আর আমি মাঝির ভূমিকায়।সাথে অনুপ দা আর অগ্নিকন্যা দুই যাত্রী।চারজন উঠে বসতেই দেখি ভেলা পানির নিচে ডুব দিয়ে দিল।আমরা হই হই করে উঠতেই দেখি ভেলা আবার ভেসে উঠছে।কিন্তু তখনও কয়েক ইঞ্চি পানির নিচে।কিছুক্ষণ ট্রায়াল দিয়ে দেখলাম ওটা আর নিচে যাচ্ছেনা।তারমানে সাহস করে বৈঠা তোলা যায় আর নইলে আবার এক ঘণ্টার ধাক্কা।মাঝি নাও ছাইড়া দে গাইতে গাইতে বৈঠায় দিলাম টান।যা আছে কপালে।আমিতো সাঁতার জানি।একজনের পড়নে লাইফ জ্যাকেট।বাকি থাকে অনুপ দা।ব্যাপারনা।সামান্য একটু এগিয়ে পানিতে লম্বা বাঁশ ফেলে দেখি মাটির তল পাইনা।এ কি করে সম্ভব!একটা ঝর্ণার পানির স্রোত কি করে এমন গভীর পানির ধারা তৈরি করতে পারে।বর্ষায় যখন এ পানির উচ্চতা আরও ২০ ফিট বেড়ে যায় তখন তো কয়েক টা বাঁশ জোড়া লাগালেও মাটির দেখা পাবেনা!প্রকৃতির এ এক অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি।দু’পাশে উঁচু পাহাড়ের দেয়াল মাঝে টকটকে নীল পানির স্রোত!আহা!আমিয়াকুমের উন্মত্ত পানির ধাক্কায় পাহাড় কেটে নেমে আসা এই স্বর্গীয় রাস্তায় যে একবার গেছে সে বারবার ফিরে যেতে চাইবে তার কাছে।দু’পাশে আকাশ ছুঁয়ে থাকা বিশাল সব পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।এই পথ যেন স্বর্গোদ্যানের পথে নিয়ে চলেছে আমাদের।আমরা সেই পথের অতি ভাগ্যবান যাত্রী।ইচ্ছে হচ্ছিল সময়কে আটকে রেখে অনন্তকাল ধরে এই পথ চলি।সবার কণ্ঠে তখন “এই পথ যদি শেষ না হয় তবে কেমন হত তুমি বলতো”।ঝংলং আমাদের পেছন পেছন আসছিল।আরও মজার ব্যাপার হল মাছের ঝাঁক আমাদের পিছু নিচ্ছিল একটু পর পরই।ভেবে পাইনা এতো মাছ কোত্থেকে আসলো এখানে।একবার ভাবছিলাম ঝাঁপ দেই আবার।কিছু তুলে নিয়ে আসি ডিনারের জন্য।বাকীদের কথা চিন্তা করে নিজেকে নিবৃত্ত করলাম।কারন আমার সাথে সাথে তাহলে সবাইকেই এই গভীর পানিতে মাছের সাথে সাথে ভাসতে হত।২০/২৫ মিনিট বৈঠা টানার পর সুন্দরীর গর্জনের শব্দ শুনতে পেলাম।বুজতে পারলাম, আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রেয়সীর থেকে খুব দূরে নেই।
টানা ৪দিন ৪ রাত পর অবশেষে তার দেখা পেলাম।যার দেখা পাব বলে অজানার রাস্তায় নেমেছিলাম আমরা।নানা বিপদসঙ্কুল পথ পেড়িয়ে যখন আমরা তার সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন আর মনে ছিলনা পেছনের ২ রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা।তখন কেবলি মনে হচ্ছিল এমন প্রিয়তমার দেখা পাওয়ার জন্য লক্ষ বছর ধরে অপেক্ষা করা যায়।হাঁটা যায় অনন্তকাল ধরে দুর্গম জনাকীর্ণ পথ।ওই মুহূর্তে আমরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ।যাদের সামনে রুপের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষমাণ অনিন্দ্য সুন্দরী “আমিয়াকুম”।এখন সময় শুধু আঁখি মেলে দেখার আর প্রেমের ফল্গুধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার।খুব কাছে গিয়ে ধরা দিতে গিয়েও শেষে আর সাহস হয়নি।ওই ভয়ঙ্কর স্রোতে একবার ঝাঁপালে শেষে আজীবনের মিতালী হয়ে যেতে পারে সুন্দরীর সাথে ভেবে আর ধরা দেইনি!কিংবা মুচকি হেসে সেও হয়তো বলছে ধরা দেইনি
শুরু হল স্বর্গোদ্যানের পথে যাত্রা



মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,চিরদিন কেন পাইনা



সুন্দরীকে নিয়ে লাঞ্চে ব্যাস্ত আমরা



দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সুন্দরীর সান্নিধ্যে







ধবল শাদা পানির বহমান ধারা,মনে হয় যেন ডাকছে তাহারে,আহারে !



রুপসুধা পান করতে করতে ভুলেই গেছিলাম আমরা খাওয়া দাওয়ার কথা।অটো চুলা কাজ করছেনা দেখে হাঁড়িতেই নুডলস বসিয়ে দিলাম।আজকে সুন্দরীর সাথে নুডলস দিয়েই লাঞ্চ সারবো!এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করে।দুপুর গড়িয়ে এল।আমাদের খাবারও প্রস্তুত।আমিয়াকুমের সামনে বসে তাকে সাথে নিয়ে আমরা লাঞ্চ টা সেরে নিলাম।আমার কাছে ছাড়া অন্য কারও দিকে সুন্দরী হাত দেয়নি এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।দু’জন মিলে ভাগাভাগি করেই খেয়ে নিলাম অমৃতসম নুডলস।এতো স্বাদের নুডলস আগে খুব কম খেয়েছি।আসলে পাহাড়ে নুডলসের টেস্ট কেমন করে যেন চেঞ্জ হয়ে যায়!আজ রাতটা এই নির্জন পাহাড়ের কোলে ঝর্ণার সাথে কাটাবো বলে একমত হলাম।শেষ বিকেলে তাঁবু গুলো টানিয়ে নিলাম।এখনও পূর্ণিমার রেশ কাটেনি।পড়ন্ত জ্যোৎস্নায় আজ গভীর রাতে প্রেমে মাতবো কন্যার সাথে।অনেক রাত পর্যন্ত তাবুর সামনে বসে থাকলাম নিশ্চুপ।কিছু মুহূর্ত থাকে যখন কিছু বলা যায়না।আনন্দে বাকরোধ হয়ে যায়!তখন শুধু উপভোগ করতে হয়।আমাদের সময়টাও এমনই ছিল।গভীর রাত পর্যন্ত সাক্ষী হলাম সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের।অবিরল কলকল ধ্বনি শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম!
ফেরার পথে আমরা,অতিরাম পাড়া পাড় হচ্ছি



বিকেলের হলুদ আলোয় এক নৈসর্গিক আবহের সৃষ্টি হয়েছিল পাড়াগুলো তে



সূর্যোদয়ের আগেই আবার জেগে গেলাম সুন্দরীর সকালের রুপের মাতন দেখব বলে।আশপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম।ফিরে এসে দেখি সবাই জেগে গেছে।শেষবারের মত নাস্তা সেরে নিলাম ওখানে।তারপর ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিলাম।বিদায়ের রাগিণী বেজে উঠলো।এবারের মত বিদায় সুন্দরী।আবার ফিরে আসবো কথা দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।এবারের গন্তব্য আরেক সুন্দরী নাফাকুম।যে পথে আসছি এবার আর সে পথে যাচ্ছিনা।অপেক্ষাকৃত সহজ পথে ফিরছি আমরা।মোটামুটি তিনটা বড় পাহাড় পাড় হতে হবে আমাদের।এই রুট টা খুব পরিচিত।যারা আমিয়াকুম আসে তারা সবাই এই রুট দিয়েই আসে।আমাদের হাতে সময় আছে।আস্তে ধীরে আমরা এগুতে থাকলাম।অতিরামপাড়া পাড় হয়ে আমরা যখন থুইসাপাড়ায় পৌঁছলাম তখনও বিকেল হয়নি।৫ দিনের টানা ট্রেকিং এ সবাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত।সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর সামনে এগোবোনা।এ পাড়াতেই থেকে যাব।এমনিতেও সারা দিন হেলেধুলে আসছি আমরা হাতে সময় থাকায়।আর তাছাড়া পাড়ায় এসে শুনি ওখানে আজ ওদের একটা অনুষ্ঠান চলছে।তাই ভাবলাম রাতটা তাহলে ওদের সাথেই কাটাবো।ওদের ঐতিহ্যের সাথে কিছুটা পরিচিত হওয়ার এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।রাতটা সুসাং দা’র বাড়িতে থাকার ব্যাবস্থা হয়ে গেল।আমাদের জন্য একটা বন্য মুরগী ধরে আনা হয়েছে।রান্নার দায়িত্বটা আমাদের তিন গাইড নিয়ে নিল।আর আমাদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য আশপাশের আরও কয়েকটা বাড়ি থেকে লোকজন এসে জড়ো হল।আমরাও তাদের নিরাশ করিনি।জমিয়ে আড্ডা দিলাম বেশ রাত পর্যন্ত।রান্না হয়ে যেতেই ডাক পড়লো আমাদের।ক্ষুধায় ততক্ষণে পেট জ্বলছে আমাদের।তারচেয়েও বড় কথা ৬ দিন পর আমরা ভাত খাব।আহা! মাছে ভাতে বাঙালী আমরা মাছ না পেলেও ভাত ছাড়া থাকা যে আসলেই কত কঠিন তা পাহাড়ে গেলেই ভালো করে টের পাই।ঝুম চালের ভাত।মাণিক দা মুরগীর ঝোল টা যখন সামনে আনল দেখলাম বিশাল সমুদ্রের মধ্যে যেন মুরগীর ছোট বড় টুকরা গুলো সাঁতার কাটছে মনের আনন্দে।সে যাই হোক।ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।এই মুহূর্তে ভাতের ক্ষুধা আমাদের তাড়া করে ফিরছে।আহা!কি খেলাম।সমুদ্র থেকে তুলে আনা পানিও মনে হচ্ছিল ঢাকার থাই স্যুপ।কয়বার নিলাম ঠিক মনে নেই।যেহেতু মুরগীর ওপর যুদ্ধ করেও পারিনি তাই স্যুপের উপর দিয়েই চালিয়ে দিলাম পরম তৃপ্তি ভরে।



সেই মুরগীর স্যুপ দিয়ে ডিনার



শীতের কুয়াশাভেজা সকালকে সাক্ষী করে এগিয়ে চলছে অভিযাত্রী দল নতুন সুন্দরীর খোঁজে





নতুন সুন্দরী নাফাকুমের কাছে আমরা সবাই









সুখস্মৃতি গুলো কে সাথে নিয়ে ফিরছি আমরা





ফেরার পথে এভাবেই এই দুজনকে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়





সূর্য্যি মামা জাগার আগেই শেষ দিনের যাত্রা শুরু করে দিলাম আমরা।এই ট্রেইল টা অসম্ভব সুন্দর।আমাদের গন্তব্য আর এক সুন্দরী নাফাকুম।শীতের ভেজা কুয়াশা মাথায় নিয়ে ট্রেকিং করতে চমৎকার লাগছিল।রেমাক্রি খাল ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা।মাঝে মাঝেই আমাদের নামতে হয়েছে রেমাক্রির ঠাণ্ডা কোমল পানিতে।৫/৬ বার পাড় হতে হয়েছে আমাদের রেমাক্রি খাল।কোথাও হাঁটু পানি কোথাও তার চেয়েও বেশি।শীতের সকালে অসাধারণ লাগছিল।শীতের ঘন মেঘ দলকে সাথে করে এগুচ্ছি।বেশ কয়েকবার আমরা যাত্রাবিরতি নিলাম ফটোসেশান এর জন্য।এরকম সুন্দর প্রকৃতিতে ছবি না তুললে প্রকৃতি মাইন্ড করতে পারে।আমরাও তাই অকৃপণ ক্লিক করে গেলাম।নাফাকুম পৌঁছতে আমাদের প্রায় দশটা বেজে গেল।আমিয়াকুমের ছোট বোন নাফাকুম কে’ও আমরা বরণ করে নিলাম ভালবাসার বাহুবন্ধনে।যদিও আমিয়াকুম দেখে আসার পর নাফাকুম কে অতটা আকর্ষনীয় নাও লাগতে পারে।তবে সুন্দরীদের আমি কোন ক্যাটাগরিতে ফেলতে চাইনা।আমি সুন্দরের পুজারী।তাকে কম বেশি ক্যাটাগরিতে ফেলে কাউকে কষ্ট দিতে চাইনা।তাই তাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু ছবি নিয়ে নিলাম।
এবার ফেরার পালা।৫ দিনের এক রোমাঞ্চকর যাত্রার প্রায় শেষ পথে আমরা।এখান থেকে যাব রেমাক্রি।প্রায় তিন ঘণ্টার পথ রেমাক্রি খালের ছায়া ধরে।রেমাক্রি পৌঁছে ওখান থেকে ইঞ্জিন চালিত ভোটে তিন্দু হয়ে থানচি।অসম্ভব সুন্দর আর একটা পথ।ফেরার গল্প কারও ভালো লাগেনা।তাই শর্ট কাটে শেষ করে দিচ্ছি।সময় হলে অন্য কোথাও এই গল্প নিয়ে আসবো আবার।সাথে নিয়ে যাচ্ছি এমন কিছু স্মৃতি যাতে মরিচা ধরবেনা কখনও।জ্বলজ্বল করে জ্বলবে স্মৃতির মণিকোঠায়।









খুব শান্তি শান্তি লাগছে এই বড় সিরিজটা শেষ করতে পেরে

দ্বিতীয় পর্ব এখানে
http://www.somewhereinblog.net/blog/Tushar007007/30033405


প্রথম পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/Tushar007007/30024457
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৫ রাত ১:১২
৩৭টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×