somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্বশানঘাট, আমি ও একটি সাদা বিড়াল। রাত্রি দ্বি-প্রহর। (ভুতুড়ে কাহিনী)।

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের বাড়ির পাশেই একটি পুরোনো শ্বশান-ঘাট আছে। এখানে হিন্দু ধর্মালম্বীদের শেষকৃত্য করা হতো; সে অনেক আগের কথা।

গ্রামের বয়স্কদের মুখে শুনেছি দেশ বিভাগের পূর্বে আমাদের এই এলাকায় হিন্দুদের বসতি ছিল এবং তারা সবাই ছিল মুক্তাগাছার জমিদারের প্রজা। জমিদারের প্রজা হলেও তারা বেশ অবস্থা সম্পন্ন ছিলেন; গ্রামের শেষ মাথায় পুরোনো মন্দিরটি দেখলেই তাদের তৎকালীন বিত্ত-বৈভবের চেহারা বোঝা যায়। দেশ বিভাগের পর '৭৫ পরবর্তী সময়ে মারো/মাউরা, চঙ, খালাসিরা তাদের জমি-জমা বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যায়। এলাকার বাদ বাকি যারা থেকে যায় তারা নামমাত্র মুল্যে তাদের জমি জমা কিনে নেয়। আমার দাদাও কিছু কিনেছিলেন এবং উত্তরাধিকারসুত্রে (দাদার কেনা সম্পত্তির উত্তরাধিকার) আমার বাবাও সেই সম্পত্তির কিছু অংশ পান যার মধ্যে এই শ্বশান ও আছে। পরিত্যাক্ত এই শ্বশানটির প্রায় ৪০০ গজের ধারে কাছে কোন বাড়ি-ঘর নেই। স্থানটির ৫ কদম নিচেই বিল, বিলের পূর্ব পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, দক্ষিনে দুরে আমার দাদার বাড়ি আর উত্তরে আমাদের বাড়ি/বাবার বাড়ি/আমার বাড়ি। শ্বশানঘাটে আছে একটি বহুবর্ষী হিজল গাছ। গাছটির বয়স কেউই অনুমান করতে পারে না। গাছের ভেতরটা সম্পূর্ণরুপে খোলা। দিনের বেলা বেজি/গুইসাপ এই গাছের খোড়লে লুকোচুরি খেলে। বর্ষাকালে হিজলের লম্বা লাল ফুল বিলের জলে পড়ে পানির উপর লাল আবরন তৈরী করে। আর গাছ থেকে ঝুলন্ত ফুলগুলো একই সাথে বৃদ্ধি করে সৌন্দর্য্য আর বাতাসে ছড়ায় সুগন্ধ। যিনি আজো হিজলের ফুল দেখেননি, তার জীবনটা চারভাগের একভাগই বৃথা।

এই হিজল গাছটা আমাকে টানে। এ কেবল দিয়েই গেল। কতো লোকের শেষকৃত্তের শেষ ছায়া যে ও দিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। শুনেছি গ্রামের কারো গরু-ছাগল হারিয়ে গেলে তা প্রায়ই ওই গাছের নিচে পাওয়া যায়। আমার মতে এই গাছের কাছের দুইটা জমি চাষ-বাস হয়না তো, তাই ঘাসও হয় লম্বা লম্বা। আর গরু-ছাগল সেই লোভে সেখানে....
কোন কারণে ওদিক দিয়ে গেলে আমি গাছটার গোড়ায় বসি, বিলের উপর দিয়ে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আর গাছের শীতল ছায়ায় শরীর জুড়ায়। তবে ভরদুপুরে বা রাত্রে সেখানে যাই না। শ্বশান তো এখন আর নাই, পতিত জমি হয়ে গেছে। যখন কলেজে পড়ি, তখনও আমাদের বাড়িতে টিভি আসেনি। তাই টিভি দেখতে যেতাম কাকার বাড়ি, যেখানে শ্বশানের একটু দুর দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে যেতে হতো। তখন ইটিভি একুশে তার টেষ্টেরিয়াল সম্প্রচার চালু করেছে, রাত্রে ভালো অনুষ্ঠান হয়। ডিস ছাড়া রাত্রে ভালো অনুষ্ঠান, তাই দেখি আরকি!! তো তেমন একদিন টিভি দেখে রাত ১১.৪০ বা ১১.৪৫ হবে বাড়ি আসছি। সে সময় আমার হাতে থাকতো একটা পুরোনো-নষ্ট টিউব লাইট। আমি তখন মনে করতাম এটাই আমার শক্তি!!! এটা দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকেই বধ করতে পারি!!!! তো আসার সময় খেয়াল হলো যে প্রকৃতি আমাকে ডাকছে। তাই তার উদার্ত আহ্বানে সাড়া দেয়ার জায়গা খুজে পেলাম সেই শ্বশানঘাট। এতো রাত্রে কেউ তো আর দেখবে না আমি কি করছি। তাছাড়া আমার হাতে তো সুপার পাওয়ার নষ্ট টিউব লাইট আছেই। পায়ে চলা রাস্তা থেকে শ্বশানের দিকে হেঁটে যেতে যেতে পাশের লতা-গুল্মের ছোট ঝোপ-ঝাড়ে আমার টিউব লাইট দিয়ে বাড়ি মারছি যেন শব্দ হয় এবং আর পথে সাপ থাকলে যেন শব্দ পেয়ে চলে যায়। এমন সময় হঠাত সামনে চোখ চলে গেল। দেখলাম আমাদের শ্বশান জমি থেকে দুজন মানব অবয়ব (কালো রংয়ের) উঠল এবং বিলের ধার দিয়ে হেটে চলে যাচ্ছে। ভয় পাইনি; ভেবেছি কেউ হয়ত মাছ ধরতে এসে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল অথবা কোন প্রেমিক যুগল অথবা কোন দেহপসারিনী আর তার খদ্দের এই স্থানে তাদের পোতাশ্রয় পেতেছিল। আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা, তাই চাঁদ থাকলেও তার আভা ছিল না ভুমিতে। আলো থাকলে বোঝা যেত ছায়া পড়ে কিনা। তাই ঠিক ঠাউরে উঠতে পারি নি। রাত্রে যারা বিল ঝিলে মাছ ধরে তাদের মুখে সবসময় বিড়ি থাকে যার গন্ধ দুর থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু ওই দুজনের কাছ থেকে কোন গন্ধ পাইনি। শুধুই দেখেছি তাদের চলে যাওয়া। তাই ২য়+৩য় সন্দেহটাই আমার তীব্রতর হয়েছিলো।
হিজল গাছটা অবস্থান ছিলো একেবারে বিলের ধারে দুটি জমির আইলের মধ্যবর্তী স্থানে। যেখানে আইলটি/বাতর হিজল গাছকে মাঝখানে রেখে দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে। মানে এমন জায়গায় গাছটির অবস্থান, এটি অর্ধেক আমাদের জমিতে বাকি অর্ধেক অন্যের জমিতে। আমি যখন গাছটির কাছাকাছি পৌঁছাই, তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর বা প্রায় দ্বিপ্রহর। গ্রামাঞ্চলে এমন সময় কেউ ই জেগে থাকে না। শুধু মাত্র রোগী বা নব-বিবাহিতরা অথবা আমার মতো বাউন্ডুলে। ছোট বেলায় শুনেছি কোন গাছের নিচে কখনো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হয় না। তাই গাছটার কাছে গিয়েও আবার একটু দুরে সরে আসতে যাবো, এমন সময় গাছের পাতার ভেতর দুটি সরসর আওয়াজ শুনতে পেলাম, একটু শব্দ করেই থেমে গেল। মনে হলো দুটি পাখি বসেছিলো, আমার আওয়াজ পেয়ে উপর দিকে উঠে গেল। কিন্তু আর কোন শব্দ বা পাখির ডাক শুনলাম না। রাত্রে সাধারণত লক্ষ্মী পেচাঁ বা হুতোম পেচাঁ ডাকে। কিন্তু এতো রাত্রে ওখানে কোন পাখির ডাক শুনলাম না। একটা পা বাড়ালাম আমাদের জমিটা থেকে (শ্বশান) পাশের জমিতে। একটু দুরের আউশ ক্ষেত থেকে হুক্কা হুয়া ডেকে উঠল। সাথে সাথেই সারা এলাকার সব শিয়াল ডেকে উঠল। শিয়ালরা প্রতি প্রহরে ডাকে। এক প্রহর = ৩ ঘন্টা। (তাদের প্রহরের হিসাব তারা কিভাবে রাখে সে বিষয়ে আমি যাবো না।) যাক বাবা, যে ভয়টা পেতে যাচ্ছিলাম শিয়াল মামা সেই ভয়টা কাটিয়ে দিল। তারপর যখন আমাদের জমিটা ছেড়ে গেলাম তখনই ওই জমিটার মাঝখানে ঝড় উঠল। তীব্র বাতাস, ধুলা, শুকনো পাতা ও খড়কুটো উড়ে পাক খাচ্ছে সেই বাতাসে। বাতাসের ঝাপটা হালকা লাগছে আমার গায়ে। পিছনে তাকিয়ে দেখি হিজল গাছটার মাথায় যেন বান্দর নাচ উঠেছে। পুরাই তছনছ হয়ে যাচ্ছে গাছটার মাথা। বাতাসটা আমার দিকে ভারী থেকে ভারীতর হচ্ছে। আমি আমার হাতের নষ্ট টিউবলাইটটা বাতাসে সাই সাই করে চালিয়ে দিলাম। কাজ হলো না। বোঝতে পারলাম যে টিউব লাইট টা আসলে টিউব লাইটই; এর কোন শক্তি নেই। একদিকে প্রাকৃতিক চাপ আর অন্যদিকে অপ্রকৃতিস্থ বাতাস; আমি তো পুরাই ঘেমে অস্থির। একটু পিছনে সরে এসে আমাদের জমির উপর উঠে আসলাম। বাতাস ২/৩ মিনিট স্থায়ী হয়ে আস্তে আস্তে কমে গেল। গাছের পাতা ঝাপটানোও কমে গেল। তারপর বোঝতে পারলাম যে এখানে কিছু একটা হয়েছে বা আছে। এবার এখান থেকে বাড়ি ফিরব কেমন করে? ধীরে পিছন না ফিরে অর্থাৎ হিজল গাছের দিকে মুখ করে পিছু হটতে থাকলাম। এরই মাঝে দ্রুত এক চক্কর চারিদিকে ঘুরে নিলাম। এভাবেই আরো দুইটা জমি পার হয়ে পায়ে চলা পথে এসে পড়লাম। দেখি আমার টি শার্ট/গেঞ্জি ভিজে একাকার। আমার পায়ের খুব কাছেই দেখি একটি ধবধবে সাদা বিলাই/বিড়াল। হাতের টিউব লাইট তুলে মারতে যাবো এমন সময় এক লাফে চারহাত সামনে পড়ে গিয়ে দুলকি চালে আমার বাড়ির দিকে চলতে শুরু করেছে। আমি ও ওর পিছু পিছু হাঁটা দৌঁড়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বাড়ির কাছে এসে বিড়াল চলে গেল আরো সামনে মাউরাদের বাড়ির দিকে। আর আমি আম্মাকে ডেকে তুলে গোসল করে আম্মা আব্বার ঘরে ঘুমালাম।

এ ঘটনার কথা কাউকে বলি নাই। পরে আমি সেই জমিতে আকাশী বাগান করেছি। গাছ বড় হয়ে গেছে। ১২৩টা লাগিয়েছিলাম, ৮৮টা বেচেঁ আছে।

ছবি: ফ্রম গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×