somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আর্মেনিয়ানদের ফেলে যাওয়া ঢাকা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভাস্কো দা গামা ভারতে আসারও আগে টমাস কান নামের এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী ভারতীয় উপকূলে এসে পৌঁছান। তবে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি এ অঞ্চলে। পরে সম্রাট আকবরের সময় ভাগ্যান্বেষণে কিছু আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা ভারতে আসেন। তাদের একজন আকবরের দরবারে প্রধান বিচারপতির পদ লাভ করেন। ম্যারী নামে আকবরের নাকি এক আর্মেনিয়ান স্ত্রীও ছিলেন।

আর্মেনিয়ানরা জাত ব্যবসায়ী। সম্রাট আকবরের অনুমতি সাপেক্ষে তারা ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা শুরু করে, নির্মাণ করে বসতি, স্কুল ও গির্জা। এদের কেউ কেউ ঢাকায় এসে পৌঁছায় ষোড়শ শতকে। গড়ে তুলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তৈরি করে প্রাসাদতুল্য সব অট্টালিকা। পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় লাভ করে কর্তৃত্ব। ব্যবসায়ীক জ্ঞান এবং ক্রমাগত পরিধিবিস্তারের আকাঙ্খা তাদের সাফল্যের উচ্চশিখরে তুলে নেয়। কেনা বেচা করতে থাকে চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র। কেউ কেউ ব্যাংকের আদলে গড়ে তুলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

অতিক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও (১৮৩২ সালে মাত্র ৪২ টি আর্মেনিয়ান পারিবারে ১২৬ জন সদস্য ছিলেন) ঢাকা শহরে আর্মেনীয়রা ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী। অষ্টাদশ শতকে ঢাকায় ছয়জন ইউরোপীয় জমিদারের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন আর্মেনীয়। বরিশালেও ছিল তাদের কিছু জমিদারি।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখল নিয়ে নিলে আর্মেনিয়ানরা লবণ উৎপাদন ও বিতরণের ঠিকাদারী নেয়। সাথে সাথে চালায় পান ও পাটের ব্যবসা। আর্মেনিয়ানরা পণ্য হিসেবে পাটের উজ্জ্বল সম্ভবনা ধরতে পেরেছিল। বাংলাদেশে পাটের ব্যবসাতেই তারা ছিল অগ্রগণ্য।

উনিশ শতকের ঢাকায় প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে কয়েকটি আর্মেনী পরিবার ছিল সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি,লুকাস, মানুক, সিরকোর এবং সার্কিস। ফরাসগঞ্জে রূপলাল হাউস গড়েছিল আরাতুন। বুড়িগঙ্গার তীরে এখন বুলবুল একাডেমী অফ ফাইন আর্টস যে দালানে অবস্থিত, সেটি ছিলো নিকি পোগজের কুঠি। স্টিফানরা থাকতো আনন্দরায় স্ট্রিটে। তাজমহল সিনেমাহল যেখানে আছে এখন, সেখানে অট্টালিকা গড়েছিল পানিয়াটি। মানুক থাকতেন সদরঘাটের পাশে এক দালানে। সিরকোর ১৮৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত হয় ‘ঠিকা গাড়ি’নামে। কিছুদিনের মধ্যে তার এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে। পরবর্তীতে ঢাকাইয়া কুট্টিরা এ ব্যবসায় আধিপত্য অর্জন করে।

উপনিবেশিক মনোবৃত্তির কিছুটা বাইরে এসে আরমানিয়ানরা ঢাকার স্থানিয়দের সাথে মিশে যাবার চেষ্টা করেছিল, নিজেদের যুক্ত করে নিয়েছিল শহরের বিভিন্ন কাজকর্মে ও সভাসমিতিতে। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল। আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আর্মেনীয়- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ।

ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমাগত উন্নতির ফলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারা এক পর্যায়ে বসবাসের সুবিধার্থে আর্মেনীয় স্থাপত্যরীতিতে বাড়িঘর তৈরী শুরু করে। ধীরে ধীরে এলাকাটি আর্মেনীয়দের একটি আবাসিক পাড়ায় পরিণত হয়, নাম হয়ে যায় আরমানিটোলা।

আরমানিটোলায় থিতু হয়ে বসার পর আর্মেনীরা এখানে এক গীর্জা নির্মাণ করে। গীর্জায় বড় একটি ঘণ্টা ছিলো যার শব্দ শুনে অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতো। ১৮৮০ সালের দিকে এই ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, আর বাজেনি।

আরমানিটোলার আগা-গোড়া সব পরিবর্তন হয়ে গেলেও একমাত্র গির্জাটিই তার আদিরূপ ধরে রেখেছে। গির্জার প্রাঙ্গনে রয়েছে ঢাকার বুকে মৃত্যুবরন করা আর্মেনীয়দের সমাধি। প্রতিটি সমাধির গায়ে কাব্যময় এপিটাফ লেখা। পাশে ছিলো একটি ঘড়িঘর, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে যা ভেঙে গেছে। গীর্জায় প্রাঙ্গণে অনেক কবরই শ্বেতপাথর সহ বিভিন্ন মুল্যবান পাথর দিয়ে বাঁধাই করা। তাছাড়া মৃত ব্যাক্তির নাম সহ ফুল পাখির বিভিন্ন নকশা করা আছে কিছু কবরে, লেখা আছে এপিটাফ। ভাঙ্গা হাতের এক নারী মুর্তি একটি কবরের এপিটাফের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

কেউ আসে না সমবেত হয়ে প্রার্থনা করতে তবুও রাখা আছে সারি সারি বেঞ্চ, আছে প্রার্থনা কক্ষ, প্রার্থনা কক্ষে আছে উঁচু বেদী, বেদির উপরে আছে যিশুখৃষ্টের চিত্র ও ধাতব ক্রস, এক পাশে আছে দুই তলায় ওঠার জন্যে একটি পেঁচানো সিঁড়ি। কবরগুলোর মাঝে একটি ছোট বেদির উপর একটি সূর্য ঘড়ি আছে। গির্জার এক পাশে লাল ইটের একটি বাড়ি আছে, যেখানে ‘ওয়ার্ডেন’থাকতেন। সর্বশেষ ওয়ার্ডেন ছিলেন মাইকেল জোসেফ মার্টিন যিনি ২০০৫ সালে কানাডায় মেয়েদের কাছে চলে গেছেন।

উনিশ শতকের শেষার্ধে আর্মেনীরা ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যাওয়া শুরু করে, ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে।

বর্তমান ঢাকা আর্মেনিয়ান শূন্য।







সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:২৭
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×