এক.
পাটুরিয়া ফেরী ঘাটে যখন সুজয়দের বাসটি পৌঁছে তখন বাজে রাত পৌনে একটা আর সুজয় ছিল গভীর ঘুমে অচেতন। ঈদের ছুটি শেষে ভার্সিটিতে ফিরছে সে, বাস ভর্তি মেডিকেল, খুলনা ভার্সিটি আর কুয়েটের ছাত্রছাত্রী, দু একজন বাদে। আজ মনে হয় ভাগ্য ভালো, বড় ফেরীতেই উঠেছে ঈগল পরিবহনের চেয়ারকোচ ননএসি এই বাসটি। পেছনের সিট থেকে মাথায় চাটি মেরে বলে কাউসার বলে, “দোস্ত, বড় ফেরী চল নামি; একটু ফুঁইকা আসি”
- কাচা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে সুজয়, দুই হাত উপরে ছুড়ে জয়েন্ট ফুটিয়ে নেয় বার দুয়েক, টি-সার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলে, “চল; রায়হান, রতনেরা কৈ?”। পাশে মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। “আংকেল, আংকেল একটু জায়গা দেন, নামবো”।
ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে ভদ্রলোক, কিছুক্ষণ সময় নেন ধাতস্থ হতে, বিরক্তি ভাব নিয়ে উঠে জায়গা করে দেয় সুজয়কে নামার জন্য। দেরি না করে আবার ঘুমিয়ে পড়েন উনি। বেচারা মনে হয় খুলনা গিয়েই অফিসে দৌড়াবে তাই বাসেই ঘুমিয়ে নিচ্ছে যতটুকু সম্ভব।
“ওরা আগেই নাইমা গেছে। জলদি চল, শেষ শালাদের খুঁইজাই পামু না।”, তাড়া দেয় কাউসার।
বাসগুলো এতো চাপাচাপি করে রাখা, মাঝখান দিয়ে চলাচলই কষ্ট কর। চিপা দিয়ে জোড় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কাউসার, পেছনে সুজয়, “কতক্ষণ লাগবে দৌলতদিয়া পৌঁছতে?”
“মাত্র তো ছাড়ল, বড় ফেরী তো মনে হয় দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে”, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে কাউসার। হঠাৎ ঘুরে পেছনে তাকিয়ে বলে, “দোস্ত, আমাদের বাসে দুইটা নেপালি মাইয়া উঠছে দেখছস?”
- হুমম, দেখছি
মনে হয় মেডিক্যালে পড়ে, কি যে বগড় বগড় হি হি চিঁ চিঁ করতেছিল সারা রাস্তা ধইরা। দেখতে কিন্তু জোস মামা।
- হুমম, খুলনা ভার্সিটির ও হইতে পারে। পাপড়িরে জিজ্ঞেস করলেই পারিস।
আরে, ধুর ওর কাছে এই সব কোন খবরই পাবি না, ওরে জিগাইলে আকাশ থাইকা পরবো; মাথায় হাত দিয়া কইবো, “নেপালি মেয়ে? আমাদের বাসে? কখন উঠছে? আমাদের কলেজে?” ও তো আছে খালি শিমুলরে নিয়া। শালার শিমুলও একটা জিনিস মামা, আমাদের ভার্সিটি বাদ দিয়ে পটাইছে গিয়া মেডিক্যালের মাইয়া কবে যে মেডিক্যালের পুলাপাইন ধইরা এরে বানাইবো আল্লায় জানে। বিশাল ক্যাচাল লাগতে পারে। আমি তো খবর পাইছি মেডিক্যালের এক বড় ভাই ছাত্রদলের ছোটখাটো নেতা, পাপড়িরে পছন্দ করে।
- আরে লীগ এখন পাওয়ারে; কিচ্ছু করতে পারবে না।
সেটাই তো ভরসা মামা, কিন্তু সময় সব সময় এক রকম যায় না। আর প্রেমে পড়লে মাথা ঠিক থাকে না। ক্যাচাল লাগলে দেখবি একদিকে মেডিক্যাল আরেক দিকে কুয়েট মাঝে আর কিছু নাই; শিমুলরে সাবধান কইরা দিতে হইবো।
কথা বলতে বলতে একদম উপরের ফ্লোরে চলে এসেছে তারা। এখানে বসার ভালো ব্যবস্থা আছে, আগেই চলে এসেছে রায়হান, রতন, পাপড়ি, শিমুল। আরও অনেকেই আছে, নানান বয়েসের নানান রঙের মানুষ।
প্রচুর বাতাস, খোলামেলা চারদিক, মধ্যরাত শান্ত নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের ফেরী, মাঝেমাঝে বিকট শব্দে হুইসেল দিচ্ছে, কলাবাদুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে কানে তালা লেগে যাবার মত শব্দ হচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। বিশাল দুইটি ফ্লাডলাইট সোজা সামনের দিকে তাক করা, শান্ত নদীর বুকে যেন ছুরি হাতে রক্তাক্ত করছে কৃত্রিম যান্ত্রিক দানব।
রেলিং এ হেলান দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে সুজয়, হাতের সিগারেট জ্বলেই যাচ্ছে খেয়াল নেই তার, চাঁদের আলোয় কি অদ্ভুত সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে চারদিক! পদ্মার এই দিকে নাকি মাঝেমাঝে ডলফিন দেখা যায়, এতদিন অনেক চেষ্টা করেও এমন কিছুর দেখা পায়নি সে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে তার। বিষণ্ণ। প্রতিবার এমন হয়। যখনই লম্বা ছুটিতে বাড়ি যায় প্রথম দুএক সপ্তাহ বেশ উৎফুল্লেই কাটে, বিপত্তি বাধে তারপর, কিছুই ভাল লাগে না। হলের ফিরে যাওয়ার জন্য মন আকুপাকু শুরু করে দেয়। টিভি রুমে হৈ হৈ করা, টেবিল টেনিসের দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি, রাত হলে ডাব চুরির মিশনে নামা, দল বেঁধে পুকুরের গোসল করা, শহুরে জীবনে এই সবের স্থান কোথায়? আবার ভার্সিটি ফেরার সময় ঘনিয়ে এলেই দেখা দেয় আবেগের বিপরীত স্রোত। তখন মনে হয় ইস ছুটি তো শেষ হয়ে এলো? প্রিয় মানুষদের ছেড়ে চলে যেতে হবে কিছুদিনের মধ্যেই! জীবনটাই মনে হয় এমন, শুধুই দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি।
পেছনে ছ্যার ছ্যার একটা শব্দ শুনে আচমকা ঘুরে দাড়ায় সুজয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর বা তারও কিছু বেশি বয়সের এক বৃদ্ধ ডান পা টেনে টেনে হেটে যাচ্ছে। একটি সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দেয়া লোকটার, তেমন বিশেষ কিছু নজরে পড়ার মত না। ডান পায়ে একটু সমস্যা আছে, মনে হয় হাঁটু ভাজ করতে পারে না, তাই টেনে টেনে চলাচল করছে। এক নজরে এর চেয়ে বেশি কিছু চোখে পড়ার মত বিশেষ আর কিছু নেই। আবার নদীর দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাপড়ির দিকে চোখ যায় তার, হেসে হেসে হাত নেড়ে কথা বলছে শিমুলের সাথে। উদ্দাম বাতাসে উড়ছে খোলা চুল, নাকের ফুলটা চাদের আলোয় চিকচিক করে উঠছে মাঝেমাঝে, অদ্ভুত লাগছে তাকে যেন রূপকথার কোন চরিত্র। নাক ফুলের জন্মই হয়েছে এমন কোন নাকে জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য। চাঁদের আলো, হলুদ জামা, উড়ন্ত চুল, মাঝ নদী, নাক ফুল সর্বোপরি চোখের চশমা সর্বসুন্দরের কি সর্বনাশা সমাহার!
আরেকটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নদীর দিকে দৃষ্টি ফেরায় সে। কিছুক্ষণ পরেই মৃদু কোলাহলে আবার পিছনে তাকায় সুজয়। শিমুল ধমকাচ্ছে একটু আগে তার পাশ দিয়ে যাওয়া পঙ্গু ঐ লোকটাকে। বেশ সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে, এগিয়ে যায় সে, “কি হয়েছে, দোস্ত?”
- “আরে কোথেইকা পাগল ছাগল আইসা জুটছে এখানে”, বলে শিমুল, আশেপাশে বন্ধুদের দেখে গলার জোর আরও বেড়ে যায় তার। ওদিকে পাপড়ি অস্থির হয়ে ব্যাগে কি যেন খুঁজে যাচ্ছে এ পকেট সে পকেট হাতিয়ে।
“আরে বাদ দাও না, কি হয়েছে? একটা টাকায় তো চাচ্ছে, সমস্যা কোথায়? দাঁড়ান, চাচা আমার ব্যাগেই আছে, খুঁজে নেই”, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে পাপড়ি।
- “বাদ দিব মানে? এগুলো হলো নতুন ব্যবসা, নতুন নতুন ভং। আর কিছু না”, চিৎকার করতে করতে বলে শিমুল।
কি হয়েছে বলবি তো?
- আরে, এই লোকটা হঠাৎ পাপড়ির সামনে এসে হাত পাতে, আর পাপড়িও দশ টাকার একটা নোট বের করে দেয়। তারপর দেখ কত সাহস এই ভণ্ডটার! বলে কি, না আপা দশ টাকা নিব না; আমাকে এক টাকা দেন। পাপড়ি যতোই জোর করে সে বলে না আপা আমাকে এক টাকাই দেন। বল আমরা কি এর জন্য গণ্ডায় গণ্ডায় এক টাকার নোট নিয়ে ঘুরবো? দশ টাকা না নিলে নিবি না সমস্যা কোথায়? নাহ, এখন সে এক টাকা না নিয়ে নড়বে না। চিন্তা কইরা দেখ কত বড় ফাজিল!
এবার সুজয় ভালো করে তাকায় লোকটার দিকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে মোটা কাল ফ্রেমের চশমা, পায়ে স্যান্ডেল, কাঁধে একটি ঝোলা। মুখে বেশ শক্ত কঠোর একটা ভাব। চোখে দৃঢ় প্রত্যয় ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। কোন ভাবেই সাধারণ ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছে না। সে শুধু এক টাকায় চাচ্ছে কেন? নিশ্চয় কোন কারণ আছে।
এরই মধ্যে ব্যাগ হাতড়ে একটাকার একটা কয়েন পেয়ে গেছে পাপড়ি; হাঁপ ছেড়ে বাচে যেন সে। “এই নেন চাচা, এখন দয়া করে যান তো।”, বলে সে।
“ধন্যবাদ”, প্রায় শোনা যায় না এমন করে বলে বৃদ্ধ লোকটি।
কিছুটা অবাক হয় সুজয়, সাধারণ ভিক্ষুকরা কিছু নেয়ার পর ধন্যবাদ বলে না। লোকটি ঘুরে যাবার সময় দুটি শব্দের একটি বাক্য উচ্চারণ করে প্রায় ফিসফিস করে। সুজয় কান পেতে ছিল বলে শুনতে পায়, ভয়ানক চমকে উঠে সে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠে তার। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ডান পা টেনে টেনে ছ্যার ছ্যার শব্দ করে হেঁটে চলা বৃদ্ধের দিকে। কিছু গড়মিল আছে পুরো বিষয়টাতে, বড় ধরনের কোন গড়মিল, সুজয়ের অনুসন্ধিৎসু মন কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে, লোকটির পেছন পেছন যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শিমুল বলে, “আরে দোস্ত, ফেরী তো দৌলতদিয়া ঘাটে চলে এসেছে; চল চল জলদি চল, বাস ছেড়ে দিলে আবার সমস্যা হয়ে যাবে”
লোকটির পেছন পেছন যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাটিকে ধামাচাপা দিয়ে দৌড়িয়ে বাসে উঠে সবার সাথে, কিন্তু মনের মাঝে একটা অস্বস্তি মিশনো কৌতূহল রয়েই গেছে।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় ফুলবাড়ি গেটে এসে থামে বাসটি। একে একে কুয়েটের সকল ছাত্র ছাত্রী নেমে আসে বাস থেকে শুধু শিমুল বাদে। সে পাপড়িকে মেডিক্যালে নামিয়ে দিয়ে আসবে। বিশ্রী একটা গালি দিয়ে কাউসার বলে, “শালায় পুরাই গেছে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাইতেছে এরে পাপড়ি”।
আহারে বেচারা কাউসার, এমন দড়ির খোঁজ পেলে সবার আগে যে সেই বর্তে যাবে সেটা সবাই জানে। এত সকালে রিক্সা বা ভ্যান পাওয়া দুষ্কর। দশ বার জনের দলটি হেঁটেই হলের দিকে রওনা দেয়।
লম্বা করে একটা দম নেয় সুজয়; ভোরের মুক্ত স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার। দুপাশে শত শত নারিকেল গাছ, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ, চলে গেছে একে একে খানজাহান আলী হল ছাড়িয়ে, পুকুরতলা পার হয়ে রশীদ হল, তারপর ফজলুল হক হয়ে লালন শাহ পর্যন্ত। আহ! প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস, বুকের ভেতর চিন চিন করে উঠে তার, সেই পরিচিত পাখির কিচিরমিচির, শত চেনা নারিকেল গাছের রিনঝিন শব্দ, কত আপন টলটলে পুকুরের জল, মাঠের দূর্বা গুলো যেন আরও সবুজ আরও ঘন হয়ে গেছে; ডাকছে যেন আয় বাছা একটু মাড়িয়ে যা আমায়।
দুই.
সময়! আহ সময়! সময়ের আঘাতে বদলায় সবকিছুই, মানুষ থেকে প্রকৃতি কিছুই থাকে না অক্ষত। যে বন্ধুটি এক সময় ধনুকভাঙ্গা পণ করেছিল মাটি কামড়ে দেশের সেবায় আত্মোৎসর্গ করবে সেই দেখা গেল সবার আগে টোফেল-জিআরই দিয়ে বাইরে পাড়ি দেবার লাইনে দাঁড়িয়ে। লাজুক হাসি, আরে দেশে থেকে হবেটা কি, দোস্ত? এখানে না আছে নিরাপত্তা; না আছে ভবিষ্যৎ। আরে নিজের জীবন তো পার করেই দিলাম যেনতেন করে, এখন পরবর্তী জেনারেশনের জন্য চিন্তা করতে হবে না? যাক এতটা স্বার্থপর হয়ে যায়নি, নিজের জন্য তো আর দেশ ত্যাগ করছে না, বরং এই আত্মত্যাগ সবই পরবর্তী বংশধরদের জন্য।
পাশ করার পরপরই সুজয় ঢাকায় একটি প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করে। কেটে যাচ্ছে ভালোই, মাঝে একটি প্রমোশনও হয়েছে। প্রাইভেট চাকুরী প্রচুর কাজের চাপ, ফুরসত মেলা ভার, এরই মাঝে একদিন শিমুলের ফোন। “দোস্ত, কেমন আছিস?”
- ভালো আছিরে বন্ধু, বেশ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? পোস্টিং কোথায় এখন?
পোস্টিং তো এখন কুয়াকাটায়, কেটে যাচ্ছে ভালোই। তবে এলজিআরডির চাকরী তো কনট্রাক্টরদের জ্বালাতন একটু বেশি। কিছুদিন হলো একটা অফিস থেকে বাংলো পেয়েছি একটা।
- তাহলে তো জম্পেশ আছিস! পাপড়ির খবর কী?
কিছুক্ষণ নীরবতা। এক কাজ কর না! চলে আয় এখানে কিছুদিনের জন্য। বাংলোতে একা থাকি, দুজনেরই ভালো লাগবে।
- পাপড়ির সাথে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, পাশ করার পর সব বন্ধুবান্ধবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় দেশে বিদেশে, প্রথম প্রথম সপ্তাহে একবার আড্ডা হত, সেটা ধীরে ধীরে মাসে গিয়ে ঠেকে, আর এখন বছরেও হয় না। সবাই ব্যস্ত, সবাই দৌড়াচ্ছে। মন্দ হয় না কুয়াকাটায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলে। “ঠিক আছে, আমি দেখি ছুটি নিতে পারি কি না। তোর ঠিকানাটা এখনি মেসেজে পাঠিয়ে দে”
বাস থেকে নেমেই শিমুলকে ফোন দেয় সুজয়; “দোস্ত, কই তুই। চলে এসেছি তো তোর এখানে”
দোস্ত, একটা জরুরী কাজে আটকা পড়েছি; এক কাজ কর, বাসস্টেন্ড থেকে একটা রিকশা নিয়ে সোজা এলজিআরডির বাংলোয় চলে আয়, সবাই চিনে।
- ধুর! আমি তো ভেবেছিলাম তুই গাড়িটারি নিয়ে হাজির হবি আমাকে নিতে! আচ্ছা আসছি।
ফোন রেখে একটি টং এর দোকানে সিগারেট নিতে ঢুকে সুজয়। হঠাৎ ছ্যার ছ্যার একটা শব্দ শুনে চমকে পেছনে তাকায় সে। একটি বৃদ্ধ লোক ডান পা টেনে টেনে হেঁটে যাচ্ছে, কাঁধে একটি ঝোলা। কোথায় যেন দেখেছে এই দৃশ্য, ঠিক মনে করতে পারছে না। স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে থাকে সে। কিছু না ভেবেই চট জলদি সিগারেটের দাম মিটিয়ে লোকটির পিছু নেয় সে।
কিছু দূর এগিয়ে লোকটি বসে থাকে একটি মেয়ের কাছে হাত পেতে বলে “মা একটি টাকা দেন”
ভীষণ চমকে উঠে সুজয়। কাকতালীয় বুঝি একেই বলে। না হলে তিন চার বছর আগে ফেরীতে দেখা হওয়া সেই লোকটির দেখা পাবে এখানে কে জানতো? সময়ের আবর্তে ভুলেই গিয়েছিল। দূর থেকে তাকে অনুসরণ করতে থাকে সে। লোকটি মেয়েটির কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। তখনই পাশ থেকে একজন যুবক পাঁচ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলে সেটি না নিয়েই চলে যায় বৃদ্ধ লোকটি। যুবকটি পেছন থেকে ঢেকে বলে, “কি মিঞা, টাকাটা নিয়ে যান!”
“নাহ, তোমার টাকা নিব না”, বলেই সামনে বাড়ে বৃদ্ধ। পেছনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে যুবক।
বৃদ্ধ লোকটি কিছুদূর এগিয়ে আরেকটি মেয়ের কাছে গিয়ে বলে, “মা, একটা টাকা দেন”। মেয়েটি একটি দুই টাকার নোট এগিয়ে দিলে সে বলে, “নাহ, আমাকে এক টাকার নোট দেন”। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে শেষে এক টাকার একটি কয়েন হাতে তুলে দেয় মেয়েটি।
কিছু একটা অসঙ্গতি আছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাতে। বুঝতে হবে। জোরে হেঁটে লোকটির কাছে যায় সুজয়। আগেই হাতে বের করে রেখেছে এক টাকার একটি নোট। পেছন থেকে ডেকে বলে, “চাচা, এই যে নেন এক টাকা”
বৃদ্ধ তাকে এক নজর দেখেই বলে, “নাহ, তোমার কাছ থেকে নেব না”।
সুজয় যেমনটা ধারনা করেছিল সেটাই ঠিক হলো। রহস্যের কিছুটা ধরতে পারলেও সেটা যেন আরও ঘনীভূত হয়েছে। এমন সময় শিমুলের ফোন, “আরে, দোস্ত কৈ তুই? আমি তো বাসায় চলে এসেছি। তোর তো এতক্ষণ লাগার কথা না!”
আশপাশ দেখে সুজয় বলে, “মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছি”।
- পথ হারিয়ে ফেলেছিস মানে? রিকশা তো সোজা এখানে নিয়ে আসার কথা, মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা
দোস্ত আমি আসলে হেঁটেই রওনা দিয়েছি।
- আরে বলিস কী? দাঁড়া, আমি গাড়ি নিয়ে এক্ষণই আসছি। তুই বাসস্টেন্ডেই থাক।
কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সুজয়। লোকটিকে অনুসরণ করবে? ধরে নিয়ে গিয়ে কোথাও বসে তার এমন আচরণের কারণ জানতে চাবে? আরে ধ্যাত, লোকটি মনে হয়ে এই এলাকাতেই থাকে, শিমুল অবশ্য জানতে পারে এর ব্যাপারে। আর এত দিন পর কাকতালীয় ভাবে যেহেতু দেখা পেয়েই গেছে নিশ্চয় আবারও দেখা হবে
কতদিন পর দুই বন্ধুতে দেখা, কতশত কথা জমা হয়েছে, কত স্মৃতিকাতরতা; তোর বাবুর্চি তো ভালোই রান্না করেছে! মনে আছে হলের ডালের কথা? দেখে মনে হতো লবণ পানিতে হলুদ দিয়ে গরম করেছে শুধু! আর সেই আণুবীক্ষণিক মুরগীর পিস? আর যেদিন মাংসে আলু পাওয়া যেতে সেদিন ছিল ঈদের আনন্দ! আহা কি সব দিন গেছে।
- ছুটি কয়দিনের তোর?
আপাতত এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছি, যদি বেশি ভাল লাগে তাহলে আরও তিন চারদিন অটো নিয়ে নিব।
- আহা! অটোর কথা মনে করিয়ে দিলি! তাই বলে চাকরিতেও অটো? হা হা হা।
দোস্ত, একটা মজার কাণ্ড ঘটেছে। মনে আছে বছর তিনেক আগে আমরা ফেরীতে করে খুলনায় যাচ্ছিলাম। তখন এক বৃদ্ধ ফকির এসে পাপড়ির কাছে একটা টাকা চাচ্ছিলো। এক টাকায় নিবে সে আর সেটা নিয়ে তুই বেশ হুলুস্থুল করেছিলি?
- হুমম, মাথা চুলকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে শিমুল। নাহ! মনে পড়ছে না।
না কী পাপড়ির স্মৃতি মনে করতে চাচ্ছিস না! আরে ঐ যে লোকটার একটা পা এ সমস্যা ছিল। টেনে টেনে হাঁটছিল।
- ওহ! হু, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। কাঁধে একটা ঝোলা ছিল লোকটার, বৃদ্ধ বয়সের।
ঠিকই মনে করেছিস। আজকে ঐ লোকটার দেখা পেয়েছিলাম বাসস্টেন্ডে। একই কাজ করে বেড়াচ্ছে, শুধু এক টাকা নিচ্ছে তাও কেবল মাত্র মেয়েদের কাছ থেকে। আমি নিজে ঘাটিয়ে দেখেছি, আমার কাছ থেকেও এক টাকা নেয়নি।
- ব্যাপার কী বলতো? কোন সাইকো টাইকো কেস না তো?
কি জানি, তবে আমার কাছে সাইকো কেস মনে হচ্ছে না। তুই খেয়াল করেছিস কি না জানি না। পাপড়ির কাছ থেকে এক টাকার নোটটা নিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময় লোকটি ফিসফিস করে বলেছিল, “জয় বাংলা”।
- বলিস কী? পেছনে বড় ধরনের কোন কাহিনী আছে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। এ এলাকাতেই যেহেতু থাকে তুই কিছু জানিস না কী এর ব্যাপারে?
- কি জানি এতো দিন তো আমার চোখেই পড়েনি। অবশ্য এখানে আমার পোস্টিং ও তো হয়েছে বেশি দিন হয়নি।
হুম, ইন্টারেস্টিং! সে যাই হোক, এখানকার স্থানীয় হলে এমন একটি চরিত্র কয়েক দিনের মাঝেই তোর নজরে পড়তো যে করেই হোক। তাহলে তো মনে হয় লোকটি এখানে স্থানীয় না। আমার ধারনা লোকটি ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যাযাবরের মতো। আমি যেহেতু ফ্রি আছি আট দশ দিন তাই এটার পেছনে সময় দিতে পারবো। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
তিন.
- “কি নাম আপনার?”, জিজ্ঞেস করে সুজয়।
ভাত মাখাচ্ছিল লোকটি। সুজয়ের এমন আচমকা প্রশ্নে কিছুটা ভড়কে যায় সে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক নলা ভাত মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে, “সুলায়মান”।
- এখানেই থাকেন?
নাহ; প্লাস্টিকে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে নিঃস্পৃহ কণ্ঠে উত্তর দেয় বৃদ্ধ লোকটি। চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি ভাব।
- সুজয় বুঝতে পারে এভাবে হবে না। অকস্মাৎ অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে সে; জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা, কত নাম্বার সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন?”
ভয়ানক চমকে উঠে লোকটি। এদিক সেদিকে চকিত দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি ডিবির লোক?” কেমন যেন ভীতসন্ত্রস্ত ভাব।
- নাহ আমি ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকায় একটি প্রাইভেট চাকরি করি।
ও, তাহলে আমার কাছে কি চান?
- আপনার সাথে বছর তিনেক আগে একবার দেখা হয়েছিল, পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া যাবার সময়। আপনার মনে আছে কি না জানি না তবে আমার ঠিকঠিকই মনে আছে আপনার কথা। সেদিন আমার এক বান্ধবীর কাছ থেকে আপনি একটা টাকা চাচ্ছিলেন, আর তা নিয়ে আমার আরেক বন্ধুর সাথে প্রায় মারামারি হতে যাচ্ছিল।
কি জানি, ঠিক মনে নেই; আর এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। গত দশ বছর ধরেই ঘটে যাচ্ছে।
- মানে আপনি দশ বছর ধরে পথে পথে হেঁটে শুধু মহিলাদের কাছ থেকে এক টাকা করে নিচ্ছেন? কেন?
খাওয়া শেষ হয়েছে লোকটির। প্লেটেই পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়। পত্রিকা কেটে বানানো টং এর টিসু পেপার দিয়ে হাত মুছেই বুক পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে। লাজুক হাসি দিয়ে বলে, “পাতাবিড়ি, সহজে নষ্ট হয় না; যুদ্ধের সময় থেকে অভ্যাস হয়েছে”
- “ঠিক আছে”, আর কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির চোখে চোখ রেখে, উত্তরের অপেক্ষায়।
“এই যে আমার ডান পাটা দেখছেন, এটা কিন্তু আগে খোঁড়া ছিল না। তখন যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়; আমাদের ক্যাম্প ছিল কুষ্টিয়ার বর্ডার পার হয়ে ভারতের দুই তিন কিলোমিটার ভেতরে কেঁচুয়াডাঙ্গায়। আমরা সীমান্ত পার হয়ে ত্রিশ বত্রিশ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে ভেড়ামারায় ছোট একটা দল নিয়ে রাস্তার দুপাশের ধান ক্ষেতে এম্বুশ পেতে বসে ছিলাম। কিন্তু আমাদের এম্বুশের খবর রাজাকার বাহিনী আগেই পাক সেনাদের জানিয়ে দিয়েছিল।”, ফুসফুসের সবটুকু ধোঁয়ায় ভরে নেয় সুলায়মান তারপর আয়েস করে ছাড়তে ছাড়তে আবার বলে, “বুক সমান পানি, তার মাঝে ধানক্ষেত; আমরা ছিলাম খালি গায়ে আর লুঙ্গিতে কাছা দেয়া, ধান গাছে পাতার ধারালো কোনার আঁচড়ে গা থেকে রক্তে স্রোত বয়ে যাচ্ছিল”
একটু বিরতি দিয়ে চোখ কুচকে তাকায় সে সুজয়ের দিকে, বলে, “জানেন তো, ধান গাছের পাতা দেখতে সাদামাটা হলেও এর কোনা ছুরির মত ধারালো? আর অনেকক্ষণ পানিতে খালি গায়ে থাকার দরুন সেগুলো হয়ে উঠেছিল আরও ভয়ংকর। যাক সে কথা”, যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থনে চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে তার, জবাবের অপেক্ষায় না থেকে আবার শুরু করে, “মশা, আর জোকের মিলিত আক্রমণ আর পাতার আঁচড়ে যখন চরম দুর্গতি তখন সাক্ষাৎ আজরাঈলের মত পেছন থেকে আক্রমণ করে পাক সেনা”
খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে সুজয়, যুদ্ধের চিরাচরিত গল্প, রক্তের ঘ্রাণ, আবেগের সাহসের বীরত্বের গল্প; যত শুনে ততোই মুগ্ধ হয়।
“কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বেশিভাগ মারা পড়ে, না হয় আহত হয়। আমার পাশের একজনের মাথার পেছন দিয়ে গুলি ঢুকে কপাল দিয়ে বের হয়ে যায়, সাথেসাথে মৃত্যু। খুব বড়লোকের ছেলে ছিল, তখনকার আমলে গল্ডলিফ সিগারেট টানত। এক প্যাকেট গোল্ডলিফের তখন দাম ছিল এক টাকা”। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুলায়মান। হাতের বিড়ি পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। একটি কাঠি দিয়ে দাঁত খিলাতে শুরু করে সে আপন মনে।
চুপ করে আছে দুজনেই। সুজয় অপেক্ষা করছে কখন সুলায়মান আবার কথা শুরু করবে। মনে হচ্ছে পুরোটা আপন মনে গুছিয়ে নিচ্ছে সে। নিজেও একটা সিগারেট ধরায় সুজয়, গল্প কোন দিকে টার্ন নিবে বুঝা যাচ্ছে না।
কোন উপায় না দেখে পানির ভেতর মাথা অর্ধেক ডুবিয়ে মড়ার মত পরে রইলাম, কিছুক্ষণ পরেই পাক বাহিনী খুব সতর্কতার সাথে এগিয়ে আসে, আর যাকেই আহত অবস্থায় পাচ্ছে তাকেই বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। টের পেলাম আমার ঠিক পেছনে একজন এসে দাঁড়িয়েছে; মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি, দম বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলাম। তখন বুট দিয়ে আমার ডান পায়ের হাঁটুতে গায়ের জোরে পারা দেয়। সাথেসাথে জয়েন্টের জায়গায় হাঁটু ঘুরে যায়। আমি প্রাণপণে ঠোঁট কামড়ে পড়ে থাকি। আমি মৃত নিশ্চিত হয়ে তারা সামনে এগিয়ে যায়। ঘণ্টা খানেক পর আমি ধীরে ধীরে ধান ক্ষেত থেকে বের হই। সাথে আরেক জনকে কাঁধে করে নিয়ে হাঁটতে থাকি খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ত্রিশ কিলোমিটার হেঁটে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার মত অবস্থা আমার ছিল না। কিছুদূর এগিয়ে একটি বাড়ির উঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই, তারপর আর কিছু মনে নেই। সে বাড়িতে এক সপ্তাহের মত থাকি, তারপর অনেক কষ্টে বর্ডার পার হয়ে যখন ক্যাম্পে পৌঁছাই ততদিনে আমার ডান পায়ের হাড় শক্ত হয়ে ফিক্স হয়ে যায়; সেই থেকে আমি এই হাঁটু ভাজ করতে পারি না।
হঠাৎ কি হয়, উঠেই পাশে রাখা ঝোলাটা কাঁধে চাপিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে যায় লোকটি। পেছন পেছন বের সুজয়ও বের হয়ে আসে। অকস্মাৎ এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয় সে। পেছন থেকে ডেকে বলে তারপর কি হলো? হঠাৎ কৈ চলে যাচ্ছেন?
আর কোন কিছু নেই। এখানেই আমার যুদ্ধের কাহিনী শেষ। আমার আর কোন গল্প নেই। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। কি যেন লোকাতে চাচ্ছে সুলায়মান। পেছনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সুজয়।
চার.
কুয়াকাটায় নির্ভীগ্নে কাটছে সুজয়ের দিনকাল। ভোরে সমুদ্রের তীরে ঘন্টাদুয়েক হাঁটাহাঁটি করে। তারপর শহরময় ঘুরে বেড়ায়। টুকটাক কেনাকাটাও করে। বিকেল হলে আবার ফিরে যায় সমুদ্রের পাড়ে। অনেকটা নেশার মত হয়ে গেছে ব্যাপারটা, সমুদ্রের গর্জনে ঘোরলাগা একটা বিষয় আছে, সমুদ্রের ঢেউ, তীরে নারিকেল গাছের পাতার দোলা, তীব্র বাতাসের শো শো শব্দ সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। এখানে বাকী জীবনটা এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে যায়, এর মাঝে সুলায়মানের আর দেখা পায় না সুজয়। অনেক খুঁজেছে এখানে সেখানে, কিন্তু লোকটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একেবারে।
আগামীকাল ঢাকা রওনা হচ্ছে সুজয়, এমন প্রকৃতি ছেড়ে যেতে হচ্ছে, সুলাইমানের কাহিনী শেষ পর্যন্ত জানা হলো না, ঢাকায় ফিরেই আবার ছকে বাধা জীবন সব মিলিয়ে বেশ বিষণ্ণ সে। আপন মনে হেঁটে বেড়াচ্ছে বালুর মাঝে খালি পা ডুবিয়ে। কয়েকটা পুচকে লাল কাঁকড়া ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখনই শিমুলের ফোন।
দোস্ত, কৈ তুই? জলদি বাংলোয় আয়। সুলাইমানকে পাওয়া গেছে, আমি বাসায় নিয়ে এসেছি। আর কিছু শোনার দরকার ছিল না সুজয়ের। এক মুহূর্ত দেরী না করে প্রায় দৌড়ে বাংলোয় পৌঁছে সে।
সুজয় পৌঁছেই দেখে পিরিচে করে চা খাচ্ছে সোফায় পা ভাজ করে। পাশে বসে শিমুল।
তাকে দেখেই শিমুল বলে সকাল সকাল থানায় গিয়েছিলাম একটা কাজে; গিয়ে শুনি একজন খোঁড়া বৃদ্ধকে গতকাল রাতে নীলগঞ্জ খেয়া ঘাট থেকে আটক করে পুলিশ কয়েকটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার কারণে। সারা রাত হাজতে রেখেছিল। ঘটনা শুনেই বুঝতে পারি এটা সুলায়মান ছাড়া আর কেউ না। মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছি।
দুজন দুপাশের সোফায় বসে সুজয় ও শিমুল। আজ আপনাকে বলতেই হবে সব কিছু।
- নীরবে চা পান করে যাচ্ছে সুলায়মান, নিশ্চুপ, কি যেন ভাবছে; হঠাৎ মাথা তুলে বলে, “আছিয়া, আমার একমাত্র বোন, এক বছরের ছোট ছিল আমার। যুদ্ধ থেকে ফিরে দেখি বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজাকার বাহিনী, বাবাকে মেরে ঘরের সাথে পুড়িয়ে দিয়েছে, মা কে খুঁজে পাওয়া যায়নি; আমার দেশের বাড়ি ভৈরব, যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের পতন হলে সেখান থেকে আসিয়াকে উদ্ধার করে যৌথবাহিনী”
চোখ টলটল করে উঠেছে সুলায়মানের। গলা ধরে এসেছে তার। তার দুঃখ যেন রুমের বাতাসও টের পেয়েছে, স্তব্ধ যেন সব কিছু।
- সেই থেকে আসিয়া পঁচিশ বছর কোন কথা বলেনি, একেবারে বোবা হয়ে ছিল নিষ্পাপ আমার বোনটি, বাকিটা জীবন।
চমকে উঠে সুজয়, শিমুল দুজনেই, আসিয়া কি বেঁচে নেই? অক্ষম একটি ক্রোধ দানা বাধছে মনের কোনে। কেমন যেন অসহায় বোধ করতে থাকে। চুপ করে শুনে যাচ্ছে সুলাইমানের গল্প আর ক্ষণে ক্ষণে হাত মুষ্টিবদ্ধ করছে অজান্তেই।
- পঁচিশ বছর পর একদিন সকালে কথা বলে আসিয়া তারও একটা মাত্র বাক্য। সেটাই ছিল তার জীবনের শেষ কথা। এবার ঝরঝর করে
পানি পড়ছে দুচোখ বেয়ে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে।
- শুধু বলেছিল, “ভাইজান, গতকাল টিভিতে যে লোকটা দেশ গঠনে অবদান রাখার জন্য জাতীয় পুরুষ্কার নিয়েছে সেই আমাকে পাকিস্তানী আর্মির হাতে তুলে দিয়েছিল বিনিময়ে মেজর জানোয়ারটা এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট দিয়ে ছিল এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে।”
- দুহাতে চোখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠে সুলায়মান। যে দেশের জন্য এত কষ্ট করলাম, এত ত্যাগ স্বীকার করলাম, যুদ্ধ করলাম সেই স্বাধীন দেশে আমার বোনের এমন অপমান? যে আমার বোনকে এক টাকার বিনিময়ে পাকিস্তানি আর্মির হাতে তুলে দিয়েছিল সেই রাজাকারই কি না পায় জাতীয় পুরষ্কার? সেই রাতেই আত্মহত্যা করে আসিয়া।
- “ঐ জানোয়ারটা এখন বিশাল শিল্পপতি, দেশের সেবায় নিয়োজিত, বাড়ি গাড়ি পরিবার নিয়ে দাপটের সাথেই দিন কাটাচ্ছে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পরের দিন রাতেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসি। এখন সারা দেশ ঘুরে ঘুরে মেয়েদের কাছ থেকে এক টাকা করে যোগাড় করছি। যেদিন দুই লক্ষ টাকা জোগাড় হবে সেদিন একটি পিস্তল কিনবো।”, মুখটা কঠোর হয়ে যায় তার, চোয়াল শক্ত করে চোখ তুলে তাকায়; বলে, “আমি এখন উঠবো”
বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সুজয়, থ মেরে বসে থাকে শিমুল। নীরবতা ভেঙ্গে খুব ধীরে ধীরে সুজয় বলে, “আমরা যদি পুরা টাকাটা একসাথে জোগাড় করে দেই?”
- নাহ! আমি চাই দেশের দুই লক্ষ মা বোনেরা আমার এই প্রতিশোধের সাথে যুক্ত হোক। বেশি দিন বাকী নেই আর জানোয়ারটার, জাহান্নামের দরজা খুলে গেছে। বড় জোড় কয়েকটা বছর মাত্র।
ডান পা টেনে টেনে ছ্যার ছ্যার শব্দ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সুলায়মান। একজন ভাই, একজন মানুষ বাঙ্গালী।
পাঁচ.
সকাল সকাল বউ এর চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে দৌড়িয়ে ড্রয়িং রুমে আসে সুজয়। কি হয়েছে? চিৎকার করছ কেন?
হাতের পত্রিকাটি এগিয়ে দেয় সুজয়ের দিকে।
প্রথম পাতা জুড়ে একটাই নিউজ, লালা কলিতে হেড লাইন, “বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পপতি ও সমাজ সেবক আততায়ীর গুলিতে নিহত”
নিজের অজান্তেই সুজয়ের মুখ দিয়ে ফিসফিস শব্দে বের হয়ে আসে, “জয় বাংলা”
বউ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মুহূর্তক্ষণ, জিজ্ঞেস করে, “বিড়বিড় করে কি বলছ?”
এবার বেশ জোরেই বলে, “জয় বাংলা”। আবার চিৎকার করে বলে, “জয় বাংলা”; আকাশের দিকে মুখ করে আরও জোরে চিৎকার করে বলে, “জয় বাংলা”; গলা ফাটিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে দুই হাত শূন্যে ছুড়ে বারবার বলতে থাকে, “জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা”
------------- সমাপ্ত -------------