২০১২ এর কথা, খুলনা যাচ্ছি রাতের গাড়ীতে। গাড়ী ফেরীতে উঠেছে রাত তখন আড়াইটা। আমি ফেরীর একেবারে উপরে চলে গেলাম। বসে আছি, চারিপাশ প্রায় ফাকা; লোকজন তেমন নেই, বেশিরভাগই গাড়ীতে ঘুমাচ্ছে। হঠাত একটা ছেলে আমার পাশে এসে দাড়ালো।
-স্যার, জুতাটা পালিশ করে দেবো?
-না বাবা, জুতা পালিশ করতে হবে না
সে গেলো না, আবার
-স্যার, জুতাটা পালিশ করে দিই?
-বললামতো লাগবে না
ছেলেটা চলে গেলো। ৮/১০ মিনিট পর আবার আসলো।
-স্যার, জুতাটা পালিশ করে দিই, ট্যাকা লাগবো না
আমি আবছা অন্ধকারে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। ১৩/১৪ বছর বয়স হবে। সে বলতে লাগলো
-স্যার জুতাটা দেন পালিশ করে দিই। আজ একটাও পালিশ করি নাই। এটা তিন নম্বর ফেরীতে উঠছি, বৃষ্টির মধ্যে কেউ গাড়ি থেকে নামে না।
-তুমি কি পড়ালেখা করো?
- জে স্যার
-কোন ক্লাসে পড়ো?
-এইটে
-বাড়ি কোথায়?
-ফরিদপুর
-এতদূর কেনো আসো জুতা পালিশ করতে?
-এলাকায় মান-সন্মানের ভয়তে করি না
-রাতে কিছু খেয়েছো?
-না স্যার
-চলো ফেরীর ক্যান্টিনে তোমাকে খাওয়াবো
-না স্যার, আমি ভিক্ষা করিনা
-কে বলল আমি তোমাকে ভিক্ষা দিচ্ছি
ছেলেটাকে জোর করে ক্যান্টিনে নিয়ে এসে বসালাম। খাবারের অর্ডার করলাম। ছেলেটা তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করলো।
-স্যার আপনি খাবেন না?
-না, আমি বাইরের খাবার খুব একটা খাইনা
-স্যার আপনি খান, আপনার বিল আমি দেবো
-তোমার কাছে তো টাকা নাই, আজ তো কোনো পালিশ কোরোনি, তুমি বিল কোথা থেকে দেবে?
-আমার কাছে জমানো ট্যাকা আছে, বইনের পাঠানোর জন্য রাখছিলাম।
-তোমার বোন কি করে?
-গেলোবার ডাক্তারিতে ভর্তি হইছে
-কোন মেডিকেলে?
-খুলনা মেডিকেলে
-তোমরা কয় ভাই বোন?
-দুই ভাইবোন। বইন আর আমি
-বাবা মা আছে?
-জে, বাবা আরেক জায়গায় আরেক মহিলারে নিয়ে সংসার পাতছে; আমাগো দেখে না। আর মায়ে ক্যাথা সিলাই করে সংসার চালাইতো। একদিন মায়ের আঙ্গুলে সুই ফুটে ঘা হয়ে গেছে, পরে হাসপাতালে ডাক্তার আঙ্গুল কাইট্যা ফেলাইছে।
-হুম
-আমার বইনের মেট্রিক পরীক্ষার সময় এলাকার গুন্ডারা তুলে নিয়ে গেছিলো। এরপর বইন অনেকবার গলায় ফাস লাগায় মরতে গেছে; পারে নাই। বইনরে বিয়েও দিতে পারিনা এরকম ঘটনার জন্য।
পরে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে ডাক্তারিতে ভর্তি হইছে। আমারও ডাক্তারি পড়ার অনেক ইচ্ছা। আমি গেরামের সবচেয়ে ভালো স্কুলে পড়ি। আমি সেভেনের ফাইনালে পঞ্চম হইছি। আমার বইনও ওই স্কুলে পড়তো। স্যার খাওনের পর আপনার জুতাটা পালিশ করে দিই?
ফেরী ঘাটে চলে এসেছে। আমার গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে। একটা শব্দও মুখ থেকে বের করতে পারছি না। ঠিকমত ঢোক গিলতে পারছি না। ছেলেটার মুখের দিকে একবার তাকালাম, ধীর শান্ত ভাবে ভাতগুলো গুছিয়ে খাচ্ছে আর দুই গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি দ্রুত উঠে গেলাম, ক্যান্টিনে খাবারের বিলটা দিয়েই গাড়ীতে উঠে বসলাম।
২০১৬, ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করিনি। তার বোন হয়তো ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছে। ছেলেটাও হ য়তো ডাক্তারি পড়ছে। এক সময় দুই ভাইবোন মায়ের ট্রিটমেন্ট করবে।
ভালো থাকুক সবাই।
আজ জুম্মার নামাজ পড়তে গেছি মসজিদে। ঈমাম খুতবা পড়ছে। আমার পাশে ১৩/১৪ বছর বয়সী দুটা ছেলে খোশ গল্পে মেতে আছে। দুইজনের হাতে দামি স্মার্ট ফোন, তারা অনেক ব্যস্ত ফাইল শেয়ারিং নিয়ে।
জানি না ফাইল গুলো কি!!!